সালতামামি লিখতে বসলে অতঃপর যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধাকে উপেক্ষা করার কোনও প্রশ্নই উঠবে না, ২০২৪ সাল তা প্রতিষ্ঠা করে দিল। এআই এখন সৃষ্টিশীল— জেনারেটিভ; যাকে নির্দেশ দিলে সে সেই মতো ছবি, ভিডিয়ো, গান, লেখা, কথোপকথন তৈরি করে দেবে। এতে কার্যক্ষেত্রে সুবিধা প্রচুর হয়েছে। পাঁচশো পৃষ্ঠার বই থেকে কৃত্রিম মেধা নিমেষে ৫-১০ পৃষ্ঠার সারমর্ম বার করে দেবে; জানিয়ে দেবে যে কোনও বিস্তৃত বিতর্কের সারমর্মটুকু।যাচাই করে দেবে তথ্যের সত্যতা— তবে তার বিশ্লেষণও নিরপেক্ষ না হতে পারে। সেটা নির্ভর করছে সেই এআই মডেলকে কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তার উপরে।
স্টক মার্কেট গণনা থেকে বাণিজ্যেও এআই-এর ভূমিকা এখন চোখে পড়ার মতো। কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ স্টার্ট-আপ হয়তো কাজ শুরু করতে চাইছে। এআই জানিয়ে দিতে পারে, গত দশ বছরে ওই বিশেষ ক্ষেত্রে কোন কোন সংস্থা কাজ করেছে; তাদের স্টক মার্কেট, বার্ষিক রিপোর্ট সমস্ত ঘেঁটে হিসাব তৈরি করে জানিয়ে দেবে যে, ওই ক্ষেত্রে ব্যবসা শুরু করা লাভজনক হবে কি না। তা ছাড়া বেশির ভাগ স্টার্ট-আপই এখন এআই-কেন্দ্রিক। ফলে, নতুন প্রজন্মের চাকরির বাজারে এখন এআই শিখে আসা প্রায় বাধ্যতামূলক।
এ সবই ‘অ্যাসিস্টিভ টেকনোলজি’ বা সহায়ক প্রযুক্তি। একা মানুষের পক্ষে অসম্ভব এক সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে তথ্য যাচাই করা। সেখানেএই টুল সাহায্য করছে, বেশ কিছু তথ্য ঘেঁটে একটা পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত তৈরি করার। সেই পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা মানুষের উপরে। এআই মডেল আদর্শ বা নিরপেক্ষ কখনওই হবে না, কারণ মানুষই যন্ত্রকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। মানুষের পক্ষপাত দোষ থাকলে, তারও থাকবে। উত্তর পছন্দ না হলেতাকে অনুরোধ করা যেতে পারে, নিরপেক্ষ জবাব দিতে। চেষ্টা সে করবে, কিন্তু সেই চেষ্টাও তার সীমিতই হবে।
তবু পক্ষপাতদুষ্ট জবাব মানুষের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু কৃত্রিম মেধার সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগিয়ে ডিপ ফেক ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ছে। যা দেখে মানুষের পক্ষে কোনও ভাবেই বোঝা সম্ভব না তা আসল না নকল। ‘ভয়েস ক্লোনিং’-এর মাধ্যমে এক জনের নামে অন্য কারও কণ্ঠস্বর বসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। রাজনীতি থেকে পর্নোগ্রাফি, সর্বত্র এর ব্যবহার চলছে। তথ্য যাচাইয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বোঝা যেতে পারে, কোন ভিডিয়োটি আসল, আর কোনটি ভুয়ো। কিন্তু তা-ও যে নিরপেক্ষ হবে, সে নিশ্চয়তা নেই। তার উপরে, তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে মানবসম্পদ সীমিত। ফলে, তথ্য যাচাই করার আগেই তা ছড়িয়ে পড়ে, এবং যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়।
পড়াশোনার জন্য কৃত্রিম মেধার সাহায্য অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনের কাছে জানতে চাইলে সে কোনও ফর্মুলা বা থিয়োরি জানিয়ে দেবে। কিন্তু কোনও বিষয় পড়তে গেলে কী বিশেষ থিয়োরি দেখা যেতে পারে, কৃত্রিম মেধা সেটাও দেখিয়ে দেবে। অন্য ভাষা শেখাও এর মাধ্যমে সহজ হয়ে গিয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, পড়ুয়ারা নিজের মেধার বদলে কৃত্রিম মেধার সাহায্যেই পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর বানাচ্ছে। ফলে সার্বিক ভাবে তাদের বৌদ্ধিক বিকাশ বাধা পাচ্ছে। এমনকি শিক্ষকেরাও কৃত্রিম মেধার ভরসায় প্রশ্ন তৈরি করছেন, পড়াচ্ছেন। তাতে এক মস্ত সমস্যার সম্ভাবনা। ধরা যাক, কোনও শিক্ষক এআইকে কোনও বিষয়ে খুব কঠিন প্রশ্ন বানাতে বললেন। সে তেমন প্রশ্ন, তার উত্তর সবই তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু এআই যে-হেতু ‘হ্যালুসিনেশন’-প্রবণ, ফলে সে অবিকল ঠিক দেখতে ভুল উত্তর তৈরি করতে পারে। শিক্ষক সতর্ক না হলে ঘোর বিপদ।
এমনকি স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ‘চ্যাটজিপিটি’কে জিজ্ঞাসা করে চিকিৎসা করছেন হয়তো হাতুড়েরা। এ বার, চ্যাটজিপিটির উত্তর অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়। বিষয়ের প্রতি গভীর জ্ঞান না থাকলে তার ভুল ধরা প্রায় অসম্ভব। যাঁরা বিশেষজ্ঞ, চ্যাটজিপিটি তাঁদের জন্য খুব উপকারী। কিন্তু অল্প বিদ্যা সম্বল করে এর প্রয়োগ করতে গেলে ব্যবহারকারীকে এআই বোকা বানিয়ে রেখে দেবে। অনেক গবেষকও দেখা গিয়েছে অনেক সময়ে এআইয়ের অনেক ভুল ধরতে সক্ষম হননি।
কৃষির প্রগতিতেও এআই অপরিহার্য হয়ে উঠছে। নতুন সার তৈরি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, কৃষকদের কখন কোথায় কোন বীজ বোনা প্রয়োজন সে ব্যাপারে অবগত করা— এ সবই অনেক যথাযথ ভাবে সম্ভব এআইয়ের সাহায্যে। কৃষক শুধুমাত্র মাটির ছবি তুলে আপলোড করে দিলেই অ্যাপ বলে দেবে সেখানে চাষ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য।
সাধারণ মানুষের একাকিত্ব কাটাতেও কৃত্রিম মেধা পাশে দাঁড়াচ্ছে। পছন্দমতো মানুষের এআই ‘অবতার’ তৈরি করে মানুষ তার সঙ্গে মন খুলে কথোপকথন চালাচ্ছে নীতি পুলিশি বা সালিশির ভয় ছাড়াই। সেটা এক রকম ভাবে মানসিক থেরাপির কাজও করছে। আবার সেই চ্যাটবটের উপরে মানুষের নির্ভরতা এমন বেড়ে যাচ্ছে যে, কোনও সমস্যার অলীক সমাধানকেও সে গ্রাহ্য করছে না। ধরা যাক, চ্যাটবট কখনও পরামর্শ দিচ্ছে, এক তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে দিতে, তা হলে হয়তো বড় জোর পা ভাঙবে, কিন্তু তোমার সমস্যার গুরুত্ব বাকিরা বুঝবে। বা চ্যাটবটের পরামর্শে মাদক চক্রে জড়িয়ে পড়েছে ব্যবহারকারী, এমন দৃষ্টান্তও পাওয়া গিয়েছে। ফলে এর কথোপকথনের মানও এখনও যথেষ্ট নৈতিক বা গঠনমূলক নয়।
এআই ব্যবহার করে নতুন ওষুধ, রোগ নির্ধারণ পদ্ধতি, নতুন অণু-পরমাণু বানানো হচ্ছে। ফলে সমস্ত কাজেই এআই প্রযুক্তিকে এখন গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু অ-আ শেখানোর মতো করে এআই ব্যবহার করার সঠিক পদ্ধতি শেখাতে হবে। ইতিমধ্যে এআই নির্ভর ভবিষ্যৎ গড়ার নিরিখে গ্লোবাল ইন্ডেক্সে ভারত চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এআই ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করতে পারলে, ক্ষেত্র ভেদে তার আলাদা নির্দেশিকা বানাতে পারলে তবেই এ দেশে শুধু এর ব্যাপক নয়, সুষ্ঠু অতএব ইতিবাচক প্রয়োগ আশা করা যায়।
নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতেই হবে, কারণ সেটাই ভবিষ্যৎ। কৃত্রিম মেধার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু, তার সঠিক ব্যবহার বা প্রতি ক্ষেত্রে তার স্বীকারোক্তি উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। নৈতিক উপায়ে এআই ব্যবহার করারও নির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি প্রয়োজন শিক্ষায়, প্রশাসনিক কর্মসূচিতে, শিল্পে, আইনে, সংবাদমাধ্যমে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, দিল্লি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy