Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Indian Economy

সরকারি পরিসংখ্যান কতটা নির্ভরযোগ্য? বেসরকারি হিসাব বিপাকে ফেলছে সরকারকে

সরকারি পরিসংখ্যানে অসংখ্য ফাঁক, হিসাবে গলদ ধরে দিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সমীক্ষা। ভারতের ‘ডেটা বাজার’ কি সরকারের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে? 

গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২২ ১০:২৭
Share: Save:

ভারতের ‘ডেটা মার্কেট’ বা ‘পরিসংখ্যানের বাজার’ কি ক্রমেই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে পড়ছে? অনেকের তেমন মনে হলেও বিষয়টি সম্পূর্ণ সত্য নয়। কতগুলি ব্যাপার এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখা প্রয়োজন। ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইকনমি’ (সিএমআই) কর্মনিয়োগ সংক্রান্ত সেই সব পরিসংখ্যানকেই প্রকাশ্যে এনে রেখেছে, যেগুলি সরকারি সমীক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রাখে।

ভারতের স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ে তথ্য ও পরিসংখ্যানের ব্যাপারে সম্ভবত সব থেকে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র হল ‘প্রথম’। এটি একটি অ-লাভজনক সংস্থা। এর কাজ হল প্রতি বছর শিক্ষা বিষয়ে এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা, যার সারবস্তু প্রত্যাশিত। তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা ‘আইএইচএস মার্কিট’-এর ‘পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স’ (যার দ্বারা পাঁচটি সূচকের গড় হিসাব জানা যায়। যথা: নতুন বরাত, উৎপাদনক্ষমতা, নিয়োগ, সরবরাহ ব্যবস্থা এবং খরিদকৃত পণ্যের আয়তন)-এর দেওয়া পরিসংখ্যানে্র নির্ভরযোগ্যতাকেও এ ক্ষেত্রে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, আইএইচএস মার্কিট-এর পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স অর্থনীতির গতিছন্দের অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য নির্দেশক।

‘ক্রিসিল’ নামে এক তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহণের যোগ্যতা তথা ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বস্ত খতিয়ান দেয়। আর সেন্টার ফর টেকনোলজি, ইনোভেশন অ্যান্ড ইকনমিক রিসার্চ (সিটিআইইআর)-এর চাইতে প্রযুক্তি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান দেওয়ার ব্যাপারে বেশি নির্ভরযোগ্য কেউ রয়েছে বলে মনে হয় না।

ইতিমধ্যে ‘স্কাইমেট’-এর মতো আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানকারী এক বেসরকারি সংস্থা কয়েক বছরে সরকারি আবহাওয়া দফতরের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। এবং যখন ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ (হু) জানাচ্ছে যে, ভারতে কোভিড-জনিত কারণে মৃতের সংখ্যা ভারত সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি, তখন অনেকেই সরকারি পরিসংখ্যানের ব্যাপারে ভুরু কোঁচকাবেন। এমনকি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, যাকে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অন্যতম প্রধান সূত্র বলে মনে করা হয়, সে-ও কর্পোরেট ক্ষেত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দ্রুততা এবং দক্ষতার ব্যাপারে পিছু হঠছে। এই সব উদাহরণ মনে রেখেই বিষয়টির দিকে তাকানো যেতে পারে।

সিএমআইই, প্রথম, ক্রিসিল, স্কাইমেট, আইএইচএস মার্কিট, সিটিআইইআর এবং তাদের মতো অন্যান্য সংস্থা গত দুই বা তিন দশকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অথবা নজরে এসেছে। এমনই হওয়ার কথা। এক উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে পরিসংখ্যানের সূত্র যে বিবিধ হবে, সেটা কাঙ্ক্ষিত। ডিজিটাল সূত্রকে অবশ্যই এর মধ্যে ধরতে হবে। সরকার তার দিক থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ‘হাঙ্গার ইনডেক্স’-এর মতো আন্তর্জাতিক অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানের পেশ করা তালিকা বা পরিসংখ্যানের সত্যতা বা যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে। কিন্তু তার নিজের দেওয়া পরিসংখ্যানগুলি যে ক্রমাগত বিতর্ক উস্কে চলেছে, সে কথাও তাকে মনে রাখতে হবে।

সরকারের তরফে দেওয়া কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান স্বভাবতই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, কার্যত তাদের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ সব পরিসংখ্যানের আবার কোনও বেসরকারি বিকল্প পাওয়া যায় না যে, যেগুলিকে সরকারি পরিসংখ্যানের পাশে রেখে তুলনা করা যেতে পারে। ২০১১-’১২ সালের পর থেকে এ দেশের ভোক্তাজগৎ সম্পর্কে কোনও সমীক্ষা-ভিত্তিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না (২০১৭-’১৮ সালের পরিসংখ্যান সযত্নে চেপে দেওয়া হয়েছে)। একই ছবি চোখে পড়বে যদি কর্মনিযুক্তি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যায়। সে ক্ষেত্রেও সরকার যথাযথ পরিসংখ্যান চেপে গিয়ে কিছু পুরনো, ইতিপূর্বেই জানা (সেগুলিও নিখুঁত নয়) পরিসংখ্যান সামনে এগিয়ে দেয়, পাশাপাশি ‘ফাউ’ হিসেবে কত জনের প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকাউন্ট রয়েছে— এমন কিছু হিসাব দাখিল করে। এবং সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, মোট গৃহজ উৎপাদন (জিডিপি) সংক্রান্ত ক্ষেত্রে গত বেশ কিছু বছর ধরে একই পরিসংখ্যান বার বার পেশ করা হচ্ছে।

জনগণনার মতো ভিত্তিগত স্তরের পরিসংখ্যান গ্রহণের প্রক্রিয়াও ১৮৮১ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রতি দশকে নির্বাহ হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০২১-এ তা হয়নি। কারণ হিসেবে কোভিড অতিমারির কথা বলা হয়েছে। কিন্ত এক বছর হল দেশের মানুষ তুলনামূলক ভাবে আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেছেন। দেশে চিনের কায়দায় লকডাউনও করা হয়নি। তা সত্ত্বেও আগামী বছরের আগে জনসমীক্ষার কাজ শুরু হবে বলে মনে হয় না। জনগণনা থেকে শুধু মাত্র দূষণ সংক্রান্ত তথ্যই নয়, আরও বহু রকমের আর্থ-সামাজিক পরিসংখ্যান উঠে আসে। এই ধরনের ভিত্তিগত পরিসংখ্যানের অনুপস্থিতি একই সঙ্গে দেশের তথ্য-পরিসংখ্যান ব্যবস্থা এবং নীতি বিশ্লেষণের মতো জরুরি কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং করে চলেছে।

তবে সব কিছুই যে খারাপের দিকে গিয়েছে, এমন নয়। সরকারের তরফে কিছু পরিসংখ্যানের প্রকাশ বেশ নিয়মিত (যার মধ্যে ত্রৈমাসিক জিডিপি অন্যতম। আগে এই হিসাব নেওয়া হত না)। কোনও কোনও পরিসংখ্যান গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে আবার পদ্ধতিগত উন্নতি দেখা গিয়েছে, যা থেকে বাণিজ্য সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের মতো বিষয় দ্রুত হাতে পাওয়া যাচ্ছে। কর ও রাজস্ব সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে আরও বেশি স্বচ্ছতা এসেছে। এ সব স্বীকার করেও যদি কেউ অর্থমন্ত্রকের ওয়েবসাইটে গিয়ে মান্ধাতার আমলের সব পরিসংখ্যান পেতে থাকেন এবং আবিষ্কার করতে থাকেন যে, সেগুলিও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় এবং তিনি যদি সন্দেহ করেন যে অস্বস্তিকর তথ্য ধামাচাপা দিতে এমন সব কাজ করা হচ্ছে, তা হলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো পরিসংখ্যানেরও রাজনীতিকরণ ঘটে গিয়েছে।

ডিজিটাইজেশনের পর কিন্তু পরিস্থিতি বিপুল ভাবে বদলে গিয়েছে। ইতিপুর্বে যে সমস্ত ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের বিষয়গুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, ডিজিটাইজেশন সেখানে আলো ফেলেছে। এর একটি উদাহরণ হল, ক্রেডিট ব্যুরোগুলি (ঋণদানকারী সংস্থা) বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তিগত স্তরে গিয়ে ঋণ সংক্রান্ত রেকর্ডগুলি খতিয়ে দেখার সুযোগ পাচ্ছে। সেই সূত্র ধরে তারা যে কোনও রকমের ঋণদাতাদের সাহায্য করতে পারছে। একই ভাবে অনলাইন কেনাবেচা এবং অর্থপ্রদান ব্যবস্থার প্রসার থেকে নতুন প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের আচরণ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের লক্ষ্য নিয়ে যে দেশ গত এক দশকে এগিয়ে চলেছে, প্রকৃত তথ্য ও পরিসংখ্যান ছাড়া সেই লক্ষ্য পূরণ হতে হতে পারে না। সঠিক পরিসংখ্যানের দ্বারাই উন্নয়নের ক্ষেত্রে দ্রুত গতি পাওয়া সম্ভব, পরিসংখ্যানই পারে উন্নয়নের মুখচ্ছবিকে নিয়মিত ভাবে তুলে ধরতে, বিশ্বস্ত করে তুলতে এবং সম্পূর্ণ করতে। বেসরকারি স্তরে পরিসংখ্যানের সূত্র তৈরি হওয়া অবশ্যই একটি ইতিবাচক ধাপ। সরকারে তরফে যথাসময়ে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান তুলে ধরার কাজটির সামনে সেটা এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। সরকার সেই চ্যালেঞ্জ কতটা গ্রহণ করতে পারে, সেটাই দেখার।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Economy GDP Census Data market
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy