আমেরিকায় শেয়ার বাজারের বড় ফান্ড-ম্যানেজাররা মিলে বাজার-দর কমানোর অভিপ্রায়ে গেমস্টপ নামে এক সংস্থার শেয়ার বেচে দিচ্ছিলেন। ঠেকিয়ে দিলেন সাধারণ মানুষ। তাঁরা দল বেঁধে সংস্থার শেয়ার কিনলেন, ফলে দাম অনেক গুণ বেড়ে গেল। বিলেতে শতায়ু স্যর ক্যাপ্টেন টম ভেবেছিলেন যে, চ্যারিটির টাকা তোলার জন্য তিনি বাগানে হাঁটবেন— এবং, তাঁর সেই উদ্যোগকে সম্মান জানাতে পরিজন-বান্ধবরা মিলে কিছু টাকা স্থানীয় হাসপাতালে দান করবেন। লক্ষ্য ছিল শ-চারেক পাউন্ড; পরিবর্তে, সবাইকে চমকে দিয়ে, দু’-তিন সপ্তাহের মধ্যে সারা দেশের জনগণের সামগ্রিক দানের পরিমাণ দাঁড়াল প্রায় চার কোটি পাউন্ড! ইউরোপে ইংল্যান্ড, স্পেন, ইটালি আর জার্মানির মোট দশটি বড় দল মিলে স্থির করেছিল যে, তারা নিজেরা একটা নতুন লিগ চালু করবে, যাদের খেলা বছরভর সারা পৃথিবীর দর্শক পয়সা দিয়ে টিভিতে দেখবেন। বিপুল লাভের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, ঘোষণার দু’দিনের মধ্যেই তা ভেস্তে গেল— দলের সাধারণ সদস্য-সমর্থকরা জানালেন, ইউরোপীয় ফুটবলের সাবেক গরিমাই বেশি প্রিয় ।
এই তিনটে গল্প থেকে যে কথাটা বেরিয়ে আসছে, তা একেবারে হিতোপদেশের লাইন— সমষ্টিই শক্তি। রাজার ঐশ্বর্য দিয়ে যে দুর্ভিক্ষের সুরাহা হয় না, সেখানে ভিক্ষা-অন্নে বসুধাকে সত্যিই বাঁচানো যায়। রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে একে ‘পনেরো-আনা’র শক্তি বলা যায়।
বাজার-অর্থনীতির প্রসঙ্গে এক আনা আর পনেরো আনার কথায় মনে পড়বে, সংখ্যায় এক আনা হলেও সমাজের বা বাজারের ক্ষমতায় বিপুলাকৃতি, ধনী উৎপাদকদের শক্তির কথা। কয়েকটি উৎপাদকের ধুন্ধুমার প্রতিযোগিতা নিয়ে তৈরি বাজারের এই গঠনটির নাম ‘অলিগোপলি’। আমাদের মতো পনেরো আনা ক্রেতাদের সামগ্রিক চাহিদা জেনেবুঝে, এই এক আনা’রা নিজেদের মধ্যে যেন একটা ‘গেম’ খেলে জোগান (সাপ্লাই) দেন।
এক বনাম পনেরো-র আরও একটা ‘খেলা’র কথা আধুনিক গেম-থিয়োরিতে চর্চা হচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক এই গেমের এক দিকে আমাদের মতো পনেরো আনা; আমরা হলাম ‘অ্যাটমলেস’, যাদের কোনও ভর বা ভার নেই। অন্য দিকে, কয়েক জন ক্ষমতাশালী হল ‘অ্যাটম’ বা ওজনদার।
গোড়ায় উল্লেখ করা ফান্ড-ম্যানেজাররা বাজারের প্রভাবশালী ‘অ্যাটম’; আপনার-আমার মতো একা-একা কেনা-বেচা করা চুনোপুঁটিরা ভরহীন। চ্যারিটির জন্য অর্থ-সংগ্রহের বাজারে আবার অক্সফ্যাম, সেভ দ্য চিলড্রেন-এর মতো নামজাদা বড় সংস্থার পাশে ক্যাপ্টেন টম ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা নেহাতই ‘অ্যাটমলেস’। এটা সাবেক ‘অলিগোপলি’র চেয়ে ভিন্ন এক খেলা— একের বিপরীতে পনেরো; এর নাম ‘বাইলেটারাল অলিগোপলি’।
এই খেলায় আমরা এক আনা অ্যাটম-দের বিজয়ী হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। আজকের দুনিয়ায় যেমন, সমস্ত ক্রেতাদের যেন হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে গুগল, অ্যামাজ়ন, ফেসবুক, অ্যাপল আর মাইক্রোসফট-এর মতো গুটিকতক সংস্থা— বিশ্বের পনেরো আনা-র চাহিদা মেটাচ্ছে এবং বস্তুত সব বাজারের কেনা-বেচা নির্ধারণ করছে; তা-ই শুধু নয়, এই এক আনা-র নিয়ন্ত্রণের বাইরে আমাদের মতো পনেরো আনা-র পা ফেলাই মুশকিল।
তবু সাম্প্রতিক উদাহরণগুলোতে, দেশে-বিদেশে আমরা বেশ কয়েক বার দেখলাম যে, এক আর পনেরো আনার মধ্যের এই অসম খেলাটার মোড় ঘুরে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে, “কোনো-এক দল পনেরো-আনা” যেন ক্ষমতাশালী “এক আনা-র মতোই অশান্ত ও আবশ্যক” হয়ে উঠেছে।
তা হলে কি বুঝব যে, নিজেরা নিজেরা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলেই খেলায় জিতব? কিন্তু, সমাজের এই বৃহৎ গেমে আমরা প্রত্যেকে যদি নিজের-নিজেরটা বুঝে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে থাকি, তা হলে এই কোলে-ঝোল-টানার সামাজিক ফল তো বিরূপ হতেই পারে। যেমন ধরুন, লকডাউন হওয়ার আগে বা করোনার ঢেউ ওঠামাত্রই সবাই যদি খাবার বা অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়িতে জমিয়ে রাখেন, তা হলে তো বিপর্যয় আরও বাড়বে। একই ভাবে, আমাদের সকলের কাছে যদি ঠিক তথ্য না থাকে, তা হলেও তো আমাদের নিজে নিজে বেছে নেওয়া ঠিক বাজারি সিদ্ধান্তগুলো একত্রে মাঠে মারা যাবে।
অকাট্য যুক্তি। ঠিকই, এই জাতীয় ক্ষেত্রে গেম-থিয়োরি কাজ করে না; আক্ষরিক অর্থেই ব্যর্থ হয়, ‘ফেল’ করে— অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে, ‘মার্কেট ফেলিয়োর’।
আর তখনই প্রয়োজন সুশাসন— সরকারি ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। স্বাভাবিক ভাবেই তখন বিদেশের সঙ্গে দেশের নেতাদের তুলনা চলে আসে। যেমন মনে হয়, করোনা প্রতিষেধক বিলি করতে বিলেতে বা ইজ়রায়েলের সরকার নিশ্চয়ই আমাদের দেশের চেয়ে ভাল বন্দোবস্ত করেছে।
তবে, মনে রাখতে হবে, এই সব ক্ষেত্রে কাজটা ও দায়টা শুধু সরকারের নয়; দায়িত্ব তো আমাদেরও— ন্যূনতম কর্তব্য, ‘চলো নিয়মমতে’!
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy