Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Maa Sarada

শুধু ভক্তের নয়, বিপ্লবীরও মা

উনিশ শতকের নারী, সব সময় আড়ালে থাকা মেয়ে, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল পূর্ণমাত্রায়। তাঁর আশীর্বাদপ্রার্থী হয়েছেন সে কালের বহু বিপ্লবী, দীক্ষিত হয়েছেন পরে।

চিরশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:১২
Share: Save:

শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না।... মা ঠাকুরানী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে,” বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর এ উক্তির সত্যতা আজও মনকে নাড়া দেয়, যখন এই একুশ শতকে যন্ত্র-পুঁথির পাতা উল্টে দেখি কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে সারদা দেবীর জীবন ঘিরে, ঔপনিবেশিক ভারতে লিঙ্গপরিচয় ও হিন্দু রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সারদা দেবীর মূল্যায়ন করছেন বিদেশি গবেষক!

বিবাহোত্তর জীবনে সবার চোখের আড়ালে নিজে স্বশিক্ষিতা হয়ে নারীশিক্ষার পথিকৃৎরূপে এগিয়ে এসেছিলেন, অবগুণ্ঠনবতী হয়েও নারীর মুক্তির কথা বলেছিলেন, বিপ্লবই তো বলব একে! মেয়েরা প্রকৃত শিক্ষা পেয়ে, নিজ আয়ে স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচুক, এই ছিল সারদা দেবীর অন্তরের কামনা। এই বৈপ্লবিক আন্দোলনের পুরোধা হয়ে এসেছিলেন যিনি, সেই নিবেদিতাকে প্রথম দর্শনেই কন্যারূপে গ্রহণ করেছিলেন তিনি, ‘খুকি’ বলে কাছে টেনেছিলেন।

উনিশ শতকের নারী, সব সময় আড়ালে থাকা মেয়ে, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল পূর্ণমাত্রায়। তাঁর আশীর্বাদপ্রার্থী হয়েছেন সে কালের বহু বিপ্লবী, দীক্ষিত হয়েছেন পরে। মানিকতলা বোমা মামলায় জড়িত দুই বিপ্লবী মঠে যোগ দেবেন, শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের মধ্যেই কেউ কেউ অমত করলেন। সারদা দেবীর ‘আদেশ’-এ সেই বাধা দূর হয়। উত্তরকালে সেই দু’জনই— স্বামী প্রজ্ঞানন্দ ও স্বামী চিন্ময়ানন্দ। ১৯০৯ সালে, আলিপুর বোমা মামলার রায় প্রকাশের পরে বাগবাজারে মায়ের বাড়িতে নেমেছিল বিপ্লবীদের ঢল। সবাই মায়ের আশীর্বাদ চান। ভগিনী নিবেদিতার লেখায় আছে, সকল মহান জাতীয়তাবাদীই তাঁর চরণ স্পর্শ করে যেতেন। স্বামী সারদানন্দ— মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব যাঁর— কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না, যদিও জানতেন এ খুব ঝুঁকির কাজ। সারদা দেবীও বিপ্লবীদের সাহস নিয়ে গর্ব করতেন, বলতেন, দোষ যদি কারও হয়, সে তো ওদের, ব্রিটিশের! অন্যায়ের প্রতিবাদী তিনি চিরদিনই, ব্রিটিশের পরোয়া করতেন না। ১৯১৬ সালে বেলুড় মঠ রাজরোষে পড়লে তিনি স্বামী সারদানন্দকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ঠাকুরের আশ্রয় পাওয়া সন্ন্যাসীদের তিনি কোনও ভাবেই ত্যাগ করতে পারবেন না। তারা মঠ থেকে বিতাড়িত হলে গাছতলায় থাকবে, কিন্তু সত্যভঙ্গ করবে না। সারদা দেবী বড়লাটকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে লোক পাঠালে বড়লাটের আদেশ উঠে যায়।

ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব তিনি, বিশেষ করে নারীর অসম্মানের ক্ষেত্রে। এক বার স্বদেশি মামলার জেরে যুথবিহার গ্রামের দেবেনবাবুর স্ত্রী ও বোনকে পুলিশ হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে থানায় বন্দি করল, দুই মহিলার এক জন ছিলেন আসন্নপ্রসবা। শুনে সারদা দেবী রেগে বলেছিলেন, “এটা কি কোম্পানির আদেশ, না পুলিশ সাহেবের কেরামতি? নিরপরাধা স্ত্রীলোকের উপর এত অত্যাচার মহারানি ভিক্টোরিয়ার সময় তো কই শুনিনি! এ যদি কোম্পানির আদেশ হয় তবে আর বেশি দিন নয়।” এও বলেছেন, “এমন কোনও বেটাছেলে কি সেখানে ছিল না যে দু’চড় মেরে মেয়ে দু’টিকে ছাড়িয়ে আনতে পারত?”

বহু বিপ্লবী এসেছেন তাঁর সান্নিধ্যে— বিভূতিভূষণ ঘোষ, বিজয়কৃষ্ণ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, রজনীকান্ত প্রামাণিক। আশীর্বাদ পেয়েছেন অরবিন্দ ঘোষ। অরবিন্দের কারারুদ্ধ হওয়া মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করেছিল তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে, পরে সারদা দেবীর কাছে মন্ত্রদীক্ষা পেয়ে তিনি শান্তি পেয়েছিলেন। বাঘা যতীনকে একান্ত প্রিয় সন্তানজ্ঞানে তিনি একাধিক বার প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করেছেন। ১৯১৫ সালে এক বার পলাতক অবস্থায় বাগনান থেকে যাত্রাকালে যতীন্দ্রনাথ সেই ট্রেনে মায়ের উপস্থিতির কথা জানতে পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেখা করেন তাঁর সঙ্গে। একান্তে তাঁদের কথা হয়। পরে কেউ মাকে ‘কী কথা হল’ জিজ্ঞেস করলে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে শুধু বলেন, “দেখলাম আগুন!”

বিদেশি দ্রব্য পোড়ানো বা হিংসাত্মক ঘটনার বিরোধী ছিলেন তিনি, সশস্ত্র বিপ্লবেও শঙ্কিতা। ক্ষুদিরামের ফাঁসিতে অন্তরে আহত তিনি তাঁর ছেলেদের জীবননাশের আশঙ্কায় আতঙ্কিত থাকতেন। কোয়ালপাড়ার ছেলেদের ও অন্যদেরও চরকায় সুতো কাটা, তাঁত বোনার পরামর্শ দিতেন। মায়ের সমর্থনেই মুর্শিদাবাদের সারগাছি আশ্রম তরুণ দেশসেবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছিল।

মাতৃরূপই তাঁর সব ছাপানো পরিচয়, তাই বলেছিলেন, “আমি মা হয়ে কাউকে উচ্ছন্নে যেতে কী করে বলব, ইংরেজ কি আমার সন্তান নয়? আমি বলি, সকলের কল্যাণ হোক।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Maa Sarada canada Swami Vivekananda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE