Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Process and Succes

ভালবাসার দোকান, প্রক্রিয়ার কারখানা আর ছোট ছোট আশা

এক রাজনীতিক ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে ভারত জোড়ার যাত্রা করেছিলেন। এক ক্রিকেটসাধক ম্যাচ হেরেও রয়ে গেলেন গ্যালারির হৃদয়ে। এক ক্রিকেটতপস্বী আইপিএলে দ্রুততম ৫০ করে নিজেকে বললেন, এখনও কিন্তু দেশের হয়ে খেলা হয়নি!

Mahendra Singh Dhoni, Rahul Gandhi and Yashasvi Jaiswal

‘ছিপ খান, তিন দাঁড়, তিন জন মাল্লা!’ গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৩ ০৮:১২
Share: Save:

ওই চলেছেন তিনি। গালে কাঁচাপাকা দাড়ি। ছোট করে ছাঁটা হলেও খানিক অবিন্যস্ত মাথার চুল। মৃদু হাসিমাখা ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে উদ্বেল সমর্থকদের ইঙ্গিত করছেন, বেশি হইহল্লার দরকার নেই। প্রয়োজন নেই উচ্চকিত বিজয়োৎসবের। যেন তিনি জানতেন, এমনই হতে চলেছে। হাসিমাখা মুখে বলছেন, ‘‘আমি খুশি, যে আমরা ভোটের প্রচারে কোনও ঘৃণাভাষণের আশ্রয় নিইনি। একটাও খারাপ কথা বলিনি। ভোট লড়েছি ভালবাসা দিয়ে। ঘৃণার বাজার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভালবাসার দোকান খুলেছে।’’

ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতেই ভারত জোড়ার যাত্রা করেছিলেন তিনি। রোদে-ঝড়ে-বৃষ্টিতে। অনেক সন্দিগ্ধুর মনে হয়েছিল ‘ইউটোপিয়া’। কিছু স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞের মনে হয়েছিল, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হন্টনই সার হবে তাঁর। ফলিত স্তরের রাজনীতিতে এর কোনও প্রভাব পড়বে না। গায়ে মাছি বসলে যেমন হেলাফেলায় হাতের এক চোপাটে উড়িয়ে দেওয়া যায়, তার চেয়েও কম মনোযোগ এবং গুরুত্ব পেয়েছিল তাঁর দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং স্মরণকালের মধ্যে নজিরবিহীন উদ্যোগ। সম্ভবত শুধু তিনি জানতেন, রাতারাতি কিছু হয় না। যে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে তিনি যাত্রা শুরু করেছেন, সেই পথও দীর্ঘ। সেই পথ বন্ধুরও বটে। কিন্তু তাতে তিনি ক্ষান্ত হননি। নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন। তাঁর অন্তরাত্মা বলেছিল, ফল তোমার হাতে নেই। কিন্তু ‘প্রক্রিয়া’টা আছে। প্রক্রিয়া। প্রসেস। প্রসেসটাই আসল। প্রক্রিয়াটাই আসল। তাতে যেন কোনও বিচ্যুতি না থাকে।

প্রসেস। প্রক্রিয়া।

শনিবারের সকাল যখন ক্রমশ গড়িয়ে যাচ্ছিল দুপুরের দিকে আর কর্নাটক নামক দক্ষিণ ভারতের একটি রাজ্য রাহুল গান্ধী নামে এক হাসিমুখ মধ্যবয়সির লালিত রাজনৈতিক এবং দার্শনিক বিশ্বাসে দিয়ে যাচ্ছিল নির্ভুল সিলমোহর, তখন আবার মনে হচ্ছিল, ঠিকই। ‘প্রক্রিয়া’টাই আসল। ওটাই আঁতুড়ঘর। নইলে কে ভাবতে পেরেছিল, আপাত সর্বশক্তিমান নরেন্দ্র মোদী বিন্ধ্য পর্বতের ও পারে এ ভাবে জমি ধরে নেবেন! ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর, সারা দেশে অস্তিত্বহীনতায় ভুগতে-থাকা এবং রাজনীতির রিঙে মার খেতে খেতে দড়ির উপর পড়ে যেতে-থাকা কংগ্রেস মহম্মদ আলির বিখ্যাত ‘রোপ আ ডোপ’-এর মতো এমন এক পাল্টা ঝটকায় ফিরে আসবে! উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মিজোরামকে (যার ক্ষমতায় এনডিএ-র শরিক মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট) ছেড়ে দিলে এর পর এই বছরেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং তেলঙ্গানায় বিধানসভা ভোট। যার মধ্যে একমাত্র মধ্যপ্রদেশ ছাড়া কোথাও ক্ষমতায় নেই বিজেপি। ২০২৪ সালের আগে কর্নাটক-ধাক্কা খেয়ে এই চার রাজ্যে মরিয়া হয়ে ঝাঁপাবেন মোদী। হতে পারে তার ফলে রাজস্থান ‘হাত’-ছাড়া হয়ে গেল (সেখানে অবশ্য এমনিতেও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার বদল হয়ে থাকে। ফলে এ বার কংগ্রেসের যাওয়ার পালা)। হতে পারে মধ্যপ্রদেশে প্রায় কুড়ি বছরের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সামলে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। হতে পারে কর্নাটকের ‘সুপবন’ ছত্তীসগঢ়ে বওয়াতে পারল না কংগ্রেস। কিন্তু তাতেও ‘প্রক্রিয়া’ থাকবে। ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খোলার প্রক্রিয়া।

ওই চলেছেন তিনি। পরনে উজ্জ্বল হলুদ জার্সি। ট্রাউজ়ার্সের বাঁ-পা হাঁটু পর্যন্ত গুটোনো। সেই হাঁটুতে শক্ত করে বাঁধা ব্যথাহরা ব্যান্ডেজ। এই মাত্রই একটা ম্যাচ হেরে উঠলেন তিনি। কিন্তু স্টেডিয়াম তা-ও তাঁর নাম ধরেই গর্জন করছে মুহুর্মুহু। টসের সময় গ্যালারিকে বলেছিলেন, খেলা শেষ হওয়ামাত্রই কিন্তু চলে যাবেন না! দক্ষিণের শহরে রাত নেমেছে। কিন্তু মুগ্ধ ভক্তকুল রয়ে গিয়েছে। তিনি গোটা দলকে নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করছেন। গ্যালারিতে ছুড়ে দিচ্ছেন রিস্ট ব্যান্ড। শক্ত গ্রিপে টেনিস র‌্যাকেটের হাতল ধরে দর্শকাসনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন হলদে টেনিস বল। হাসছেন তিনি। কারণ, তিনি জানেন, সেই রাতে ম্যাচের ফলাফল যা-ই হয়ে থাকুক, ‘প্রসেস’ ঠিক রয়েছে তাঁর। প্রক্রিয়ার ভাঁড়ারে তালা পড়েনি।

গত দেড় মাসে তিনি দেশের যে প্রান্তের ক্রিকেটমাঠে খেলেছেন, সর্বত্র ম্যাচের পরে মাঠকর্মীরা তাঁর সঙ্গে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন। তিনি কাউকে নিরাশ করেননি। কিন্তু আসল কথা হল, আপাততুচ্ছ সেই সমস্ত মাঠকর্মী ছবি তোলার আগে ভক্তিভরে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন। দেবতার মতো। বিগ্রহের মতো।

সেই আকণ্ঠ ভালবাসাই কি সেই গভীর রাতের আকাশ থেকে ঝরে পড়ছিল? এই কি তাঁর ঘরের মাঠে শেষ ম্যাচ? সে জন্যই কি তিনি সতীর্থদের নিয়ে ঘুরলেন সারা মাঠ? ভালবাসার জবাবে কৃতজ্ঞতা মাখা ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে? জল্পনায় সারা দেশ। তিনি মাঠ প্রদক্ষিণ করছেন। তাঁর বিদেশি সতীর্থের হাতে হলুদ রঙের পতাকা। তাঁর এক পাশে অভিজ্ঞ কিন্তু রক্ষণাত্মক বলে পরিচিত সেই ক্রিকেটার, যাঁকে তিনি পুনর্জীবন দিয়েছেন এই প্রতিযোগিতায়। যাঁকে ভালবেসে শিখিয়েছেন, ধ্রুপদী স্ট্রোক খেলেও আক্রমণাত্মক হওয়া যায়। একটু পিছনে হাঁটছেন পড়শি দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিক সেই তরুণ, যাঁর সম্পর্কে তিনি স্নেহ এবং উদ্বেগমাখা কণ্ঠে বলেছেন, ‘‘ও লাল বলের ক্রিকেট যত কম খেলে, ততই ওর পক্ষে ভাল!’’ যে তরুণ ডেথ ওভারে গুবলেট করে ফেললেও দৌড়ে দিয়ে তাঁর কাঁধে রেখেছেন অগ্রজের হাত। ভরসা-ভালবাসার হাত। তাঁর একটু আগে আগে হাঁটছেন এই কিছু দিন আগেও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিতির দোহারা চেহারার তরুণ। যাঁকে তিনিই বলের লাইনের নীচে গিয়ে, মাথা স্থির রেখে অনায়াস ছয় মারতে শিখিয়েছেন। কারণ, তিনি জানেন, প্রক্রিয়াটাই আসল।

কিংবদন্তি ক্রিকেটার দৌড়ে আসছেন তাঁর দিকে। যাঁর ব্যাটে পৃথিবীর ক্রিকেট মানচিত্রে বৃহত্তর পরিচিতি পেয়েছে একদা হরিজন ভারত, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম দশ হাজার রানের মতো অসংখ্য বিশ্বরেকর্ড যাঁর দস্তানায় গিজগিজ করছে, সেই তিনি কমেন্ট্রি বক্স থেকে দৌড়ে মাঠে নেমে এসেছেন তাঁর অটোগ্রাফ নেবেন বলে। সঙ্গে কাগজ নেই। মার্কার আছে তো? বুক টান করে দাঁড়ালেন তিয়াত্তরের বৃদ্ধ। হাসিমুখে তাঁর বুকের বাঁ-দিকে শার্টের উপর নীল মার্কার কলম দিয়ে সই করে দিলেন একচল্লিশ বছরের অস্তগামী ক্রিকেটসাধক। বাঁ-দিকে। যেখানে থাকে হৃদয়। তার কিছু আগে জার্সিতে তাঁর সই নিয়েছেন এক যুবক। মরণবাঁচন ম্যাচে এক ওভারে পাঁচ ছক্কায় যাঁর জীবনটাই পাল্টে গিয়েছে!

পর দিন স্টুডিয়োয় বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় আবির্ভূত সুনীল গাওস্করের হাতে তখনও ধরা রয়েছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির অটোগ্রাফ সংবলিত সেই শার্ট। রিঙ্কু সিংহ যত্ন করে রেখে দিয়েছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সই-করা মহার্ঘ জার্সি। ভক্তি? না ভালবাসা? ভালবাসা তাঁর মহাজাগতিক সাফল্যের জন্য? না কি ভালবাসা প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর একমুখিতার কারণে? যিনি বলেন, ‘‘দ্য প্রসেস ইজ় মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান দ্য রেজ়াল্ট। ইফ ইউ টেক কেয়ার অফ দ্য প্রসেস, ইউ উইল গেট দ্য রেজ়াল্ট।’’

প্রসেস। প্রক্রিয়া।

ওই চলেছেন তিনি। আইপিএলে দ্রুততম (সাকুল্যে ১৩টি ডেলিভারি) পঞ্চাশ করে এক হাতে হেলমেট, অন্য হাতে ব্যাট ধরে মাথা ঝুঁকিয়ে গ্যালারিকে ‘বাও’ করছেন একুশের তরুণ। শুষে নিচ্ছেন যাবতীয় আলো। তাঁর ব্যাটিংয়ের ধারাবিবরণী দিতে দিতে অভিভূত হয়ে পড়ছেন অতীতের দিগ্‌গজেরা। বিশেষণ কম পড়ছে।

সেই একুশের যুবকের দিকে কি তাকিয়েছিল এক এগারোর বালক? যে বড় ক্রিকেটার হবে বলে উত্তরপ্রদেশের ভাদোইয়ে তার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল মুম্বই। যার ঠাঁই হয়েছিল কলবাদেবীর এক দুধের দোকানে। বিনিময়ে ফাইফরমাশ খাটার কাজ। কিন্তু ক্রিকেটতপস্বী তো আগে অনুশীলন করবে। তার পরে খুচরো কাজ করবে। ফলে কিছু দিন পর সেই দোকান থেকেও তাকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। তার পরে তার আস্তানা হয়েছিল আজাদ ময়দানের এক প্রান্তে মালিদের তাঁবু। তা-ও মুসলিম ইউনাইটেড ক্লাবের কর্তাদের দাক্ষিণ্যে। সেই তাঁবুই ছিল তার পরের তিনটে বছরের ঠিকানা। যেখানে আলো নেই। খাবার জল নেই। একপেট খিদে নিয়ে যেখানে হাড়ভাঙা খাটুনির দিন শেষ হত তার। রাতে গরমে ঘুম আসত না। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় ছিল না। কারণ, কাছের ফ্যাশন স্ট্রিটের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই রাস্তার এজমালি শৌচাগারের দরজাতেও তালা পড়ে যেত। আজাদ ময়দানের সেই খুপরি থেকে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের আলো দেখা যেত। আর রাতের অন্ধকারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্যাডো প্র্যাকটিস করতে করতে সেই বালক নিজেকে বলত, এক দিন ওই স্টেডিয়ামে খেলতে হবে। খেলতেই হবে!

এগারোর বালক একুশের সফল এবং আচম্বিতে বিখ্যাত যুবককে সম্ভবত বলছিল, সেই দিনগুলো কখনও ভুলো না! মুম্বই শহরের সেই রগড়ানিই তোমাকে মানসিক ভাবে কঠিন করেছে। সেই পরিশ্রমই তোমায় বলেছে, নিজের লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখো। নিজের লক্ষ্যকে ভালবাসার প্রক্রিয়াটা জারি রাখো।

ক্যামেরার চোখের দিকে সটান তাকিয়ে নিষ্পলক যশস্বী জয়সোয়াল বলছিলেন, ‘‘গত দশ বছর ধরে আমি যা করেছি, সেগুলো কখনও ভুলি না। এখনও সেগুলোই করি। সেগুলোই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। খারাপ দিনে। ভাল দিনেও। প্রত্যেক রাতে ভাবি, আমাকে ভারতের হয়ে খেলতে হবে।’’ একুশ বছরের ক্রিকেটতপস্বীর গলা কানে বাজছিল— ‘‘শুধু এই একটা কারণেই আমি ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলাম। সেটাই আমার লক্ষ্য। আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নটাকেই আমি রোজ তাড়া করি। আই কিপ অন ওয়ার্কিং অন মাই প্রসেস। যাতে একটা সুযোগ এলেও সেটা হাতছাড়া না হয়ে যায়!’’

প্রসেস। প্রক্রিয়া।

দেখতে-দেখতে, শুনতে-শুনতে ছোট ছোট আশার জন্ম হচ্ছিল— প্রক্রিয়ার অনুশীলন জারি থাকুক। যেন আমাদের সকলের জন্য খুলে যায় ভালবাসার দোকান। একদিন! কোনও একদিন!

অন্য বিষয়গুলি:

Rahul Gandhi Mahendra Singh Dhoni Yashasvi Jaiswal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy