রাহুলের বিরুদ্ধে এই অতি সক্রিয়তা কেন? বিজেপি কি সত্যিই ভয় পেল? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সদ্য সদ্য খারিজ হয়েছে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ। খানিক হালকা চালে অনুজ সহকর্মী বললেন, ‘‘এ বার থেকে আমি কপির ফাইলনেমে ‘মোদী’ নয়, ‘মোদীজি’ লিখব!’’ তুলনায় সিরিয়াস সিনিয়র সহকর্মী বললেন, ‘‘রাহুল গান্ধীকে এরাই দায়িত্ব নিয়ে নেতা বানিয়ে দিল!’’
কয়েক ঘণ্টা পরে তৃণমূলের এক প্রথম সারির বিধায়ক আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘রাহুল গান্ধীকে নিয়ে এরা যা করল, এর পরে আমাদের মুসলিম ভোটটা না কংগ্রেসে চলে যায়! পাশা কোনও দিন উল্টোলে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে রাহুলই তো মুখ হয়ে গেল!’’
শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, সত্যিই তো। বিজেপি তো রাহুলকে ‘নেতা’ বানিয়েই দিল! পরক্ষণেই মনে হল, বানিয়ে দিল? না কি বানাতে চাইল? যেমন বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে, রাহুল ‘বিরোধী মুখ’ হলে বিজেপিরই সুবিধে! তাতে মোদীর টিআরপি চড়চড় করে চড়বে।
যে অপরাধে রাহুলকে কারাদণ্ড দেওয়া হল, ভারতের মতো ‘উদার গণতন্ত্রে’ সেই ধরনের খুচরো অপরাধের জন্য কোনও বিরোধী নেতাকে সাধারণত জেলে পাঠানো হয় না। অতঃপর যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ করা হল, তা-ও সাম্প্রতিক অতীতে বিরল। সরকারি কাগজপত্র এমনিতেই দীর্ঘসূত্রিতায় আক্রান্ত। কিন্তু গুজরাতের একটি নিম্ন আদালতের রায়ের (ঠিক দু’বছরের কারাবাসের শাস্তি। ঠিক যে সময়কাল শাস্তি পেলে একজন সাংসদের পদ খারিজ করতে পারে সংশ্লিষ্ট আইনসভা) ভিত্তিতে যে তৎপরতায় (মনে রাখতে হবে, সেই আদালত রাহুলকে দু’বছর কারাবাসের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশিই তাঁকে উচ্চতর আদালতে জামিনের আবেদন করার সুযোগও দিয়েছে) সরকারি প্রশাসনযন্ত্র গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে ঝটপট একের পর এক সিদ্ধান্ত নিতে থাকল, তা-ও নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। সাংসদ পদ খারিজ করে রাহুলকে যে চিঠি পাঠাল লোকসভার সচিবালয়, তাতে কেরলের ওয়েনাড় লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদকে সম্বোধন করা হল ‘প্রাক্তন সাংসদ’ হিসেবে। সাংসদ পদ খারিজ তো বটেই, রাহুলকে আগামী এক মাসের মধ্যে তাঁর সরকারি বাসভবন ছাড়তে বলে নোটিসও দেওয়া হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। এ সবই, যাকে বলে, ‘অতি সক্রিয়তা’! কিন্তু প্রশ্ন হল, রাহুলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের এই অতি সক্রিয়তা কেন?
বিজেপি কি তা হলে ভয়ই পেল? রাহুল নিজে বলছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী ভয় পেয়েছেন। আমি ওঁর চোখে সেটা দেখতে পাচ্ছি। সেটাই আসল কথা। সে জন্যই আমার সাংসদ পদ খারিজ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে আমার পরের বক্তৃতাটা নিয়ে ভীত। উনি আমায় সংসদে দেখতে চাইছেন না।’’ সত্যিই? না কি বিজেপি রাহুলকে ‘বাড়তি গুরুত্ব’ দিয়ে অন্য দলগুলোর থেকে কংগ্রেসের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিতে চাইছে? যা বুঝে ফেলে রাহুল বিরোধী দলের বৈঠকে আর্জি জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি সরে যেতে রাজি। বিরোধী জোট যেন না ভেঙে যায়।
কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন: কংগ্রেস কি এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারবে?
সেলুলয়েডে ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছাড়া হকি নিয়ে এখন এই উপমহাদেশে আর ততটা রোমান্টিসিজ়ম এবং আগ্রহ নেই। বহু দিন আগেই তার জায়গা নিয়ে নিয়েছে ক্রিকেট। কিন্তু রাহুলকাণ্ড এবং কংগ্রেসকে ব্যাখ্যা করতে গেলে সেই হকির মাঠেই যেতে হচ্ছে। হকির পরিভাষায়, কংগ্রেস আচম্বিতে একটা পেনাল্টি কর্নার পেয়েছে। সেটাকে তারা গোলে পরিণত করতে পারবে কি না, সেটাই দেখার।
যে পণ্ডিতেরা গত শুক্রবার দিনভর বলে গেলেন, কংগ্রেসের কাছে এটা একটা বিরাট ধাক্কা, তাঁদের প্রতি ভক্তিবিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম জানিয়েই বলি, ধাক্কা নয়। এটা ক্রমশ ডুবন্ত কংগ্রেসকে খানিকটা জরুরি অক্সিজেন দিয়ে গেল। নইলে কংগ্রেসের থেকে ক্রমশ দূরত্ব বাড়াতে-থাকা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে টুইট করতেন না। টুইট করতেন না এই সে দিনও রাহুল তথা কংগ্রেসকে ধারালো আক্রমণ-করা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার চেয়েও বড় কথা, রাহুল-প্রশ্নে কংগ্রেসের ডাকা বৈঠকে যোগ দিল তৃণমূল। এটা ঠিকই যে, কার্যত দুই ‘অরাজনীতিক’ সাংসদকে পাঠানো হল সেই বৈঠকে। কিন্তু পাঠানো হল। যা এই কিছু দিন আগে পর্যন্তও অভাবনীয় ছিল।
একই রকম অভাবনীয় ছিল নরেন্দ্র মোদীর সাপেক্ষে রাহুলের ক্রমশ পাল্টে পাল্টে যাওয়া। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখলে মনে হয়, একটা লোক একটা সময়ে গান্ধী পরিবারকে আক্রমণ করে বলেছিল, ‘নামদার’ নয়, ‘কামদার’ চাই। সেই লোকটাই বলেছিল স্যুট-বুটের সরকার চাই না। ঝোলা-কাঁধে ফকির চাই। কারণ, সে এমন একটা সময়ে ক্ষমতায় আসার বাজি ধরেছিল, যখন কংগ্রেস-শাসিত দেশ দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত। সেই লোকটির যুদ্ধ ছিল একটি পরিবারের কায়েমি ভোগবাদের বিরুদ্ধে। সারা দেশ তাকে সাদরে আলিঙ্গন করেছিল। কিন্তু ‘চা-ওয়ালা’ বলে নিজের পরিচয়-দেওয়া সেই লোকটিই দিনেকালে পিন-স্ট্রাইপ্ড স্যুটে সোনার আখরে নিজের নাম খোদাই করাল। নিজস্বী তোলায় দড় হয়ে উঠল। ‘জঙ্গল সাফারি’-তে মাথায় তুলল স্মার্ট এবং বাহারি স্ট্র হ্যাট। তার চোখে উঠল ব্র্যান্ডেড রোদচশমা। কোন অ্যাঙ্গল থেকে ছবি উঠলে তাকে সর্বোত্তম দেখায়, তা নিয়ে ভয়ঙ্কর রকমের সচেতনতা তৈরি হল তার মধ্যে। হাফ-হাতা কুর্তা ছেড়ে কব্জি পর্যন্ত ফুলস্লিভ লম্বাঝুলের কুর্তা পরা শুরু করল। তারই ‘ব্র্যান্ডেড’ জ্যাকেটকে গলার কাছে আরও একটু ছাঁটকাট করে অন্য রকম একটা রূপ দিল।
মোদ্দা কথায়, লোকটা নিজেকে সেই ‘নামদার’-এর জায়গায় নিয়ে গেল। লোকটার যত বয়স বাড়ল, তত তাকে দেখতে ভাল হতে থাকল (ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে বিশ্বাস করি, নরেন্দ্র মোদীই হলেন একমাত্র ভারতীয় রাজনীতিক, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যাঁকে দেখতে ভাল হয়েছে। স্রেফ দৃষ্টিনান্দনিকতার দিক থেকে দেখলে গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আনখশির তফাত রচিত হয়ে গিয়েছে। নিয়মিত চর্চায় বয়স্ক নরেন্দ্র মোদী চলনবলন, রাহানসাহানে নিজেকে প্রায় এক আলিশান বিগ্রহের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছেন)। চোখের সামনে লোকটা হ্যান্ডসাম থেকে হ্যান্ডসামতর হতে থাকল।
আর তার উল্টো দিকে অন্য একটা লোক শুধু ছাড়তে ছাড়তে গেল। কংগ্রেসের সভাপতির পদ ছাড়ল। লোকসভায় বিরোধী দলনেতার ভূমিকা ছাড়ল। উত্তর ভারতের মারুনে ঠান্ডায় শীতের পোশাক ছাড়ল। কনকনে ঠান্ডাতেও একটা সাদা টি-শার্ট আর ফ্যাতফ্যাতে ট্রাউজার্স পরে মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকল। হাঁটতেই থাকল। কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত মাসের পর মাস ৩,৪০০ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে, বিশাল দাড়ি-টাড়ি রেখে নিজেকে প্রায় একটা যোগীর পর্যায়ে নিয়ে গেল।
কালোর উল্টো দিকে লোকে সাদাই দেখে। যত চেষ্টাই করুন, লাল, নীল বা কমলা কেউ দেখে না। ‘সাদা সাদা’র সঙ্গে অনিবার্য ভাবে ‘কালা কালা’ই আসে। সেই কারণেই কি রাহুল ইদানীং সাদা টি-শার্ট ছাড়া আর কিছু পরেন না? সেটা কি গোটা দেশকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য যে, আমি সাদা। নিষ্কলঙ্ক। যাতে উল্টো দিকের লোকটাকে আরও কালো দেখায়!
সেই বিষয়টাই কি বিজেপিকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিল? গত সাধারণ নির্বাচনে প্রশ্নাতীত ‘জনাদেশ’ নিয়ে ক্ষমতায় আসা দল কি ভয়-টয় পেয়ে গেল? না কি এটা আসলে ভয় নয়, রাগ? যে, তুমি ব্যাটা ‘পাপ্পু’ ছিলে। সেখান থেকে তুমি বুদ্ধিমান হয়ে উঠছ! যাও, তোমায় আমি সংসদেই ঢুকতে দেব না!
আশ্চর্য নয় যে, রাহুল পরিস্থিতিটা বুঝেছেন। প্রথমত, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি এখনও পর্যন্ত সাজা মকুবের জন্য উচ্চতর আদালতে আবেদন করেননি। এর পর তাঁর জেল হলে তিনি নিজের রাজনৈতিক উচ্চতা আরও কয়েক ফুট বাড়িয়ে নিতে পারবেন। সরকারি বাসভবন ছাড়ার নোটিস আসার পর দিনই জানিয়েছেন, তিনি বাড়ি ছেড়ে দেবেন। অর্থাৎ, রাহুল নিজেকে আরও ‘কোণঠাসা’, আরও ‘আক্রান্ত’ বলে প্রতিপন্ন করতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত, গলার স্বর চড়িয়ে বলতে শুরু করেছেন, ‘‘আমি এদের ভয় পাই না। এরা যদি ভাবে আমায় ভয় দেখিয়ে, বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে, সাংসদের পদ খারিজ করে, ধমকে, জেলে পাঠিয়ে দমিয়ে দেবে, তা হলে এরা ভুল করছে। আমি প্রশ্ন তুলে যাব। আমি দেশের গণতন্ত্রের জন্য লড়ছি। এগুলো করে আমায় ভয় দেখানো যাবে না। আমার ইতিহাস তেমন নয়।’’ যত তাঁকে পেড়ে ফেলা হচ্ছে, মোদী-বিরোধিতা তত চৌদুনে তুলে নিয়ে গিয়ে রাহুল বলছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী একজন ভারতীয়। তিনি ‘ভারত’ নন। উনি যতই ঔদ্ধত্য দেখান, যতই বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করুন, উনি এই দেশ নন। এই দেশ ১৪০ কোটি জনতার। প্রধানমন্ত্রী, বিজেপি, আরএসএসকে আক্রমণ করলে সেটা ভারতকে আক্রমণ করা নয়। আই স্ট্যান্ড ফর দ্য ট্রুথ! দ্যাটস দ্য ওয়ে আই অ্যাম!’’
এবং কংগ্রেস এই পরিস্থিতির ফয়দা তুলতে পারবে কি না-র মতোই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, এর পরে কি রাহুলকে জেলে পাঠানো হবে?
না-পাঠালে তিনি তো আবার রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে পড়বেন! এখন তো লোকসভার অধিবেশনে থাকার তাগিদ, তাড়না বা দায়িত্বও নেই। সে তো আর এক বিপদ! কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর হয়েছে। এ বার যদি গুজরাত থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত আড়াআড়ি হাঁটা শুরু হয়?
দেখতে দেখতে এবং ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছিল, এত দিন বিজেপি রাহুলকে মমতা বা অরবিন্দ কেজরীওয়ালের তুলনায় অনেক কম ক্যালিবারের দুর্বল নেতা ভাবত। সেই বিজেপিই কি ‘নেতা’ হিসেবে রাহুলের পুনর্নির্মাণ করল? ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ রাহুলের মধ্যে কঠোর পরিশ্রমের স্ট্যামিনা দেখিয়েছিল। বিজেপি কি তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ক্যারিশমাটা জুড়ে দিল?
মাটির সঙ্গে অহরহ যোগ রেখে-চলা তৃণমূল বিধায়কের কথাটা মনে পড়ছিল, ‘‘পাশা যে দিন পাল্টাবে, সে দিন কিন্তু রাহুল গান্ধীই রাজা। এবং জনপ্রিয় রাজা। যেমন ওর বাবা ছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy