এই প্রথম ‘ওটিটি’ প্ল্যাটফর্মে অভিনয় করলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। হিন্দি ভাষায় স্মরণকালের মধ্যে দ্বিতীয় অভিনয় তাঁর। মূল ছবি: ‘জুবিলী’র পোস্টার।
তাঁকে নিয়ে কি এখনও কিছু লেখার আছে? ‘জুবিলী’ দেখে মনে হল— আছে। তাঁকে নিয়ে এখনও কিছু লেখার আছে।
অ্যামাজ়ন প্রাইমে বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানে পরিচালিত ১০ পর্বের সিরিজ়ের সময়ের যোগফল প্রায় ১০ ঘণ্টা। এই সময়কালের অনেকটা জুড়ে রয়েছেন তিনি। অভিনয়ের গুণে বীরদর্পেই রয়েছেন। তাঁর অভিনীত ‘শ্রীকান্ত রায়’ চরিত্রটির মতোই। যাঁকে সিরিজ়ের চরিত্রেরা ‘রয়বাবু’ বলে ভক্তিমূলক এবং সম্ভ্রমসূচক সম্বোধন করে।
এ কি আশ্চর্য যে, সিরিজ়ের অন্যতম চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে তিনিও দর্শককুলের কাছে সেই ভক্তি এবং সম্ভ্রম দাবি করেন?
আঠারো বছর আগে ২০০৫ সালে পর পর মুক্তি পেয়েছিল ‘সরকার’ এবং ‘ব্ল্যাক’। এমনিতেই অমিতাভ-বিমোহিত এক যুবক ছবি দু’টি দেখার পর নম্বর জোগাড় করে হিন্দি ছবির সুপারস্টারকে মুগ্ধ টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিল। তার পরে ভুলেও গিয়েছিল। যেমন হয়ে থাকে। সারা দেশ থেকে কত শত মেসেজ নিয়ত ঢোকে তাঁর ফোনে। সেখানে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য থেকে পাঠানো নেহাতই অপরিচিত এক যুবক তো তুশ্চু! জবাবের কোনও আশাও ছিল না। কিন্তু অঘটন কখনও-সখনও ঘটে যায়। বা অলৌকিক। সেই সন্ধ্যায় যুবকটি যখন মোবাইল ‘সায়লেন্ট মোড’-এ দিয়ে (এবং উল্টো করে রেখে) দৈনিক এডিট মিটিংয়ে মগ্ন, ফোন করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বার দুয়েক। অনবধানে ফোন না-তোলায় বার্তা পাঠিয়েছিলেন ‘কল্ড ইউ। নো রেসপন্স!’
মিটিং থেকে বেরিয়ে মোবাইলে সেই বার্তা দেখে খাবি খেতে খেতে যখন ফোন করেছিলাম, দীর্ঘ সময় ‘সরকার’ এবং ‘ব্ল্যাক’ নিয়ে কথা বলেছিলেন অমিতাভ। স্বাভাবিক। বেলপাতায় স্বয়ং ঈশ্বরও তুষ্ট হন। অমিতাভ তো রক্তমাংসের মানুষ! অভিনয়ের ঈশ্বরের কাছে কিছু বোকা প্রশ্নও ছিল। ভক্তের যেমন থাকে। যেমন ‘সরকার’ না ‘ব্ল্যাক’— কোনটায় নিজের অভিনয়কে এগিয়ে রাখবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অমিতাভ বালখিল্যের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ধৈর্য ধরে। খুব যে মারকাটারি কথা বলেছিলেন তা নয়। কিন্তু জবাবগুলোর মধ্যে কোথাও একটা তাঁর নিজস্ব ভাল লাগা ছুঁয়ে ছিল।
আঠারো বছর পর আবার সেই মুহূর্তটি রচিত হল। যখন ‘জুবিলী’ দেখে টেক্সট পাঠালাম প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে (আপামর ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে ‘বুম্বাদা’ বলে ডাকলেও এবং তিনিও তাতে অকাতর প্রশ্রয় দিলেও কেন জানি না, ওই নামটায় আমি খুব একটা স্বচ্ছন্দ নই। তার চেয়ে ‘প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়’ অনেক ভাল মনে হয়। সম্ভবত তাঁর কাজের ওজন এবং তাঁর প্রতি তজ্জনিত শ্রদ্ধার কারণেই। একই কারণে তাঁকে কখনও আপাত-নৈকট্য দেখিয়ে ‘তুমি’ সম্বোধনও করতে পারি না। বাধো-বাধো লাগে)। খুবই সংক্ষিপ্ত এক লাইনের টেক্সট। তার জবাবে দু’টি জোড়হাতের ইমোজি। অতঃপর এ পাশ থেকে আরও দু’টি লাইন। তার উত্তরে একটি ধন্যবাদজ্ঞাপক ২১ সেকেন্ডের ভয়েস নোট। খুব যে মারকাটারি তা নয়। বরং প্রসেনজিৎ-সুলভ সংযত। কিন্তু তার মধ্যেও কোথাও একটা আন্তরিক ভাল লাগা ছুঁয়ে ছিল। সেই আঠারো বছর আগের মতো।
এই প্রথম ‘ওটিটি’ প্ল্যাটফর্মে অভিনয় করলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। হিন্দিতে স্মরণকালের মধ্যে দ্বিতীয়। এর আগে কিছু মনে না-রাখার মতো হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন বটে প্রসেনিজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তবে সেগুলো ওই, মনে না-রাখার মতো। কিছু আগে দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালিত ছবি ‘সাংহাই’-তে ছিলেন তিনি। তবে সেই উপস্থিতি ঔপচারিকতার বেড়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ‘শ্রীকান্ত রায়’ সেই বেড়া ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
‘জুবিলী’ সিরিজ়টি হল পরিচালক বিক্রমাদিত্যের হিন্দি ছবির দুনিয়াকে পরম যত্নে লেখা এক দীর্ঘ প্রেমপত্র। যে চিঠি তিনি লিখেছেন চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকের মোহনায়, যখন ভারত তার স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পাশাপাশিই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য দেশভাগের যন্ত্রণা এবং দাঙ্গার ক্ষতও দ্রুত তৈরি করে নিচ্ছে। নাটকীয়তা, মোচড় এবং তৎকালীন সময়ের সঙ্গে অমিত ত্রিবেদী সুরারোপিত লাগসই গান মিলিয়ে ‘জুবিলী’-কে ওয়েব সিরিজ় ফরম্যাটে তৈরি আগাপাশতলা হিন্দি ছবি বললে কেউ সম্ভবত খুব আপত্তি করবেন না। নইলে কি আর পাঁচ পর্বের পরে সিনেমার মতোই মধ্যান্তরের সূচক ‘ইন্টারভ্যাল’ আসে!
ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ভাল একটা সিরিজ় দর্শককে কী দেয়? বিভিন্ন চরিত্রের মিশেলে তৈরি একটা দুনিয়া দেখার সুযোগ করে দেয়। সেই পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা তৈরির একটা অবকাশ দেয়। পরিসর দেয়। একদা সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন (সেই কারণেই তাঁর পরিচালিত এই সিরিজ়ে ভন্সালী-সুলভ ‘পিরিয়ড ড্রামা’র অনিবার্য ছোঁয়াচ রয়েছে) বিক্রমাদিত্যের তৈরি সিরিজ়ও দিয়েছে। খানিকটা ধীরগতির বটে। অত লম্বা না-হলেও বোধহয় চলত। কিন্তু এই সিরিজ় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গ্ল্যামার আর আলোর পাশাপাশি অন্ধকার দিকের কথাও বলে। আর সেই আলো-আঁধারি থেকে ছিটকে বেরোন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ‘সেপিয়া টোন’-এ বানানো এই সিরিজ় একটা পুরনো বইয়ের মতো গন্ধ বিলি করে স্ক্রিনে। যে গন্ধের সঙ্গে মিলে যায় খানিক নাকউঁচু এবং অহংসর্বস্ব শ্রীকান্ত রায়ের অ্যাটিটিউড। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত চরিত্র সেপিয়ার চাদর এক ঝটকায় টান মেরে খুলে ফেলে আরও বহু রং নিয়ে আসে!
বিক্রমাদিত্য বিরচিত স্বাধীনতা-পূর্ব বম্বের বাসিন্দা ‘শ্রীকান্ত’ (জনশ্রুতি: চরিত্রটি ‘বম্বে টকিজ’-এর মালিক হিমাংশু রায়ের আদলে নির্মিত) চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং স্টুডিয়ো ব্যবসায়ী। চল্লিশের দশকে ভারতীয় সিনেমার তথাকথিত ক্রান্তিকালে ‘রয় টকিজ়’-এর মালিক। যখন ভারতীয় জনতার কাছে বিনোদনের মাত্র দু’টি উপাদান ছিল— সিনেমা এবং রেডিয়ো। শ্রীকান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সুযোগসন্ধানী, ক্রূর। কখনও জটিল, কখনও ভঙ্গুর, কখনও অনুপ্রাণিত, কখনও দৃঢ়, কখনও দুর্বল। আবার কখনও কখনও খল। একই সঙ্গে ভূয়োদর্শী (যিনি ছবিতে নেপথ্যগায়নের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারেন। প্লে-ব্যাক বোঝানোর জন্য যে ভাবে পটভূমিতে বাজতে-থাকা গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে ‘মদন কুমার’-এর চরিত্রাভিনেতা অপারশক্তি খুরানার সঙ্গে তিনি নেচেছেন, তা অনায়াসতায় বিরল গোত্রের), দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম, নিজের দুনিয়ার অবিসংবাদিত সম্রাট। ভেঙে পড়তে-থাকা বিবাহের আলগা বন্ধন (পরপুরুষে আসক্ত অভিনেত্রী-স্ত্রী সুমিত্রা কুমারী তাঁর মুখের উপর বলেন, ইউ আর আ ডিজ়গাস্টিং ম্যান! জবাবে তাঁর দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্রীকান্ত বলেন, জাস্ট আ বিজ়নেসম্যান), স্টুডিয়োর বস্, বশংবদ সাইডকিক (যাঁকে তিনি মামুলি স্পটবয় থেকে সুপারস্টার বানিয়ে দেবেন)— এই সমস্ত বিভিন্ন আলো-আঁধারি মেখেজুখে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তাঁর চার দশকের অভিনয়প্রজ্ঞা নিংড়ে যা বার করেছেন, তাকে ফেলে দেওয়ার উপায় নেই।
পরনে সব সময় থ্রি-পিস স্যুট। কোটের হাতার ফাঁক থেকে উঁকি মারে ফুলস্লিভ শার্টের হাতার প্রান্তের মহার্ঘ কাফলিঙ্ক। ঠোঁটে পাইপ। ফিল্মি পার্টিতে কখনও বো-টাই। হাতে হুইস্কির গ্লাস। ঘন ভ্রু। তার নীচে খর দু’চোখ। যে চোখে ট্যালেন্ট খোঁজার জন্য জহুরির নজর। ঠোঁটের উপর ঈষৎ মোটা এবং দু’প্রান্তে যত্নে সুচালো করা গোঁফ। দৃঢ়সংবদ্ধ চোয়াল (দাঁতে দাঁত চেপে সংলাপ বলার কারণে তাঁকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি রসিকতাও চালু থেকেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেটা সম্ভবত তাঁকে এই চরিত্রে পরোক্ষে সাহায্যই করে গিয়েছে। যদিও হিন্দি সংলাপে খানিকটা বাঙালি ছোঁয়া থেকে গিয়েছে)। চোখে বাণিজ্যলিপ্সা। যে চরিত্র সটান বলে, বিবাহ এবং ব্যবসার মধ্যে ব্যবসাটাই তার অগ্রাধিকার। যে চরিত্র তারই নির্মিত তারকার থুতনি শক্ত পাঞ্জায় ধরে নির্দ্বিধায় ফরমান দেয়, ‘‘তোকে স্টার বানিয়েছি। স্টার হয়ে থাক। অভিনেতা হতে যাস না!’’
বয়সকালের শ্রীকান্তের গোঁফ নেই। চোখে রেট্রো ফ্রেমের চশমা। নিজের দীর্ঘলালিত সাফল্যহেতু তৈরি হওয়া জেদ আর তার বশে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তার ফলে ফ্লপ ছবির ভার বহন করতে হওয়ার ফলে খানিক বেশি ভঙ্গুর। খানিক বেশি দুর্বলও। নইলে কি আর শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নেন! কিন্তু সেখানেও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অনায়াস। ঘোড়া তাঁকে পিঠ থেকে ফেলে দিতে চাইছে। কিন্তু তিনি, শ্রীকান্ত রায়, তাকে বশ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখার মতো।
মনে রাখতে হবে, প্রখর সংযম এবং শৃঙ্খলায় চেহারাটা ছমছমে রাখলেও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বয়স এখন ষাট। চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে অভিনয় জীবনের (এই সময়ে লোকের অবসরকালীন স্কিম চালু হয়ে যায়)। হিন্দি ওয়েব সিরিজ়ের পোস্টারে তাঁর ছবি থাকলেও একটু নীচে, কোনার দিকে থাকে। সিরিজ়ের কথা বলার সময় তাঁর উল্লেখ করা হয় ‘বেঙ্গলি সুপারস্টার’ বলে। কলাকুশলীর সারিতে তাঁর আগে লেখা হয় অপারশক্তি খুরানা, সিদ্ধান্ত গুপ্ত, অদিতি রাও হায়দরিদের নাম। কিন্তু প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সাফল্য এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার খিদে হাতির মতো। ও সব খুচখাচ বিষয় তাঁকে দমাতে পারেনি। আঞ্চলিক ভাষার সুপারস্টারদের অনেক ধরনের প্যাখনা থাকে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও সব ইগো-টিগোর ধার ধারেননি। ‘জুবিলী’-তে অভিনয় করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘‘অ্যানাদার অপরচুনিটি টু রিইনভেন্ট মাইসেল্ফ।’’ নিজেকে পুনরাবিষ্কার করার আরও একটা সুযোগ।
‘জুবিলী’-র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তা হলে কী শিখলাম?
শিখলাম, বিনা আয়াসের জীবন মোটে ভাল নয়। জীবনে একটু শ্রম, একটু চ্যালেঞ্জ, একটু ভাঙাগড়া প্রয়োজন। নিজেকে ভাঙচুর করে পুনরাবিষ্কার করা দরকার। নইলে জীবনটা বড্ড আলুনি হয়ে যায়।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy