শিল্পোৎপাদনের ঘাটতি পুষিয়ে দিচ্ছে অর্থনীতির অন্য ক্ষেত্র। ছবি: সংগৃহীত।
নৌশাদ ফোর্বস তাঁর মনোযোগ আকর্ষণকারী গ্রন্থ ‘দ্য স্ট্রাগল অ্যান্ড দ্য প্রমিস: রেস্টোরিং ইন্ডিয়াজ় পোটেনশিয়াল’-এ ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর মাসিক কলাম ‘দ্য ইম্পর্ট্যান্স অব ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’-এ কথিত বিষয়গুলির উপরেই জোর দিতে চেয়েছেন। বৃহৎ পরিসরে আলোচনা করতে গিয়ে ফোর্বস মার্শাল সংস্থার এই কর্ণধার দেখাচ্ছেন, ভারতীয় সংস্থাগুলি বিপণন ও মুনাফার তুলনায় গবেষণা ও উন্নয়নের খাতে অর্থবিনিয়োগের ব্যাপারে কী পরিমাণ দুর্দশাগ্রস্ত এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় তারা কতখানি পিছিয়ে রয়েছে। যদিও ভারতের শিল্পোৎপাদনের পরিকাঠামো উন্নয়নশীল অর্থনীতির একান্ত লক্ষণগুলির চাইতে অনেক বেশি প্রযুক্তি ও দক্ষতা-নির্ভর, তবু ফোর্বস-উল্লিখিত বিষয়টিকে অস্বীকার করা যাবে না।
ফোর্বসের গ্রন্থে এই পিছিয়ে থাকার পিছনে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন কারণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে (যার মধ্যে সরকারি নীতি, সংস্থাগুলির আয়তনের ক্ষুদ্রতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ), কিন্তু একটি বিষয়ে গিয়ে তা এ বিষয়ের আর এক কলাম-লেখক অশোক দেশাইয়ের সিদ্ধান্তের প্রতিই সমর্থন জানায়। সেটি হল এই যে, ভারতীয় সংস্থাগুলির পরিচালনগত ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত গতিশীলতার বিশেষ অভাব রয়েছে। শুক্রবার গ্রন্থটির প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে খানিক আলোচনা হল যে, এই পিছিয়ে থাকার পিছনে এ দেশের জাতপাত সংক্রান্ত বিষয়ের কোনও ভূমিকা রয়েছে কি না।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘দি ইকনমিস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আমেরিকার বৃহৎ এবং প্রযুক্তি-নির্ভর সংস্থাগুলিতে কর্মরত ভারতীয়দের জাতপাতকেন্দ্রিক একটি আলোচনা স্থান পেয়েছিল। সেই নিবন্ধে এমন দাবি ছিল যে, এই সমস্ত সংস্থায় ব্রাহ্মণসন্তানরা খুবই সফল হয়েছেন। সেই পত্রিকায় আরও দেখানো হয়েছিল যে, ভারতের ‘প্রোমোটার’-পরিচালিত কর্পোরেট ব্যবস্থায় যেখানে বৈশ্যরা অগ্রণীর ভুমিকা নিয়ে থাকেন, তার তুলনায় আমেরিকান সংস্থায় ঘটে চলা বিষয়টি একেবারেই আলাদা। গবেষণা এবং উন্নয়নের বিষয়ে ফোর্বসের তোলা প্রশ্নটির সঙ্গে এই বিশেষ যুক্তিটির কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না বা এই যুক্তি দিয়ে ফোর্বসের বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবতে বসলে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এ বিষয়ে ব্রাহ্মণদের যুগ যুগ ধরে জ্ঞানচর্চার সঙ্গে বৈশ্য বা বানিয়া সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক কাজকর্মের, বিশেষত ব্যবসায় অর্থের জোগান বিষয়ে তাঁদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিগত পার্থক্যের কোনও ভূমিকা রয়েছে কি?
ফোর্বস বিষয়টির সঙ্গে একমত নন। তিনি দেখাচ্ছেন যে, ভারতের ব্রাহ্মণ-পরিচালিত সফ্টঅয়্যার ব্যবসাতেও গবেষণা ও উন্নয়নের খাতে খুব কমই অর্থ ব্যয় করা হয়। তাঁর গ্রন্থে ফোর্বস-এর একটি সম্ভাব্য কারণও উল্লেখ করছেন— বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংস্থাগুলি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা, পণ্য উৎপাদক সংস্থা নয়। যদি ফোর্বসের ব্যাখ্যা সত্য হয়, তবে এ-ও সত্য যে, এই সংস্থাগুলি তাদের কর্মচারী পিছু আয়কে দ্বিগুণ বা তিন গুণ করে তুলতে পেরেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তাদের শুরুর দিনগুলির তুলনায় এই সব সংস্থা উন্নততর গুণগত মানের কাজ করে উঠতে সমর্থ হয়েছে।
ভারতের কর্পোরেট সেক্টরের সমস্ত সংস্থা সম্পর্কে অবশ্যই এ সব কথা বলা যাবে না। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ দেশে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বিপুল পরিমাণে উন্নত হয়েছে। এর পিছনে অবশ্য বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। ভারতের ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি পেটেন্ট-সুরক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে ‘রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ ওষুধ তৈরির ব্যাপারে সফল হয়েছে, টেলিকম সংস্থাগুলি অবিশ্বাস্য কম মূল্যে তদের পরিষেবা দিতে পেরেছে। কিন্তু এগুলিকে নিছক ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে।
তা হলে গুরুত্বের জায়গা ঠিক কোনটি? এর উত্তরে বলা যায়, ভারত পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় উন্নয়নের ভিন্নতর কোনও পথ অবলম্বন করেছে এবং করে চলেছে। এই পথ ভারতকে শ্রমনিবিড় উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে কম বিনিয়োগে উৎপাদনের দিশা দেখিয়েছে। এই ধরনের শিল্পোৎপাদনে সাফল্য অর্জন ভারতের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্যই ছিল। কারণ, এ দেশের খুব কম শিল্পক্ষেত্রেই ‘স্কেল ম্যানুফ্যাকচারিং’ (উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণের উপর নির্ভর করে নির্মিত উৎপাদন ব্যবস্থা) চালু ছিল এবং সেগুলি মোটরগাড়ি নির্মাণশিল্পের মতো শ্রমনিবিড়ও ছিল না। তার উপর আবার এখানে এক বিচিত্র দ্বন্দ্বাবস্থা বিরাজ করছিল— প্রায় অশিক্ষিত শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অবস্থান করছিল শিক্ষিত, ‘হোয়াইট কলার’ এবং সস্তা শ্রমিকবাহিনী। দ্বিতীয় শ্রেণির শ্রমিকেরাই পরিষেবার রফতানিকে সাফল্যের স্তরে নিয়ে যায়। পণ্য রফতানির ক্ষেত্র স্থবির হয়ে পড়লেও পরিষেবা রফতানি ব্যবসায় সাফল্য লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর প্রতিফলন হিসাবে দেখা যায়, গত দু’বছরে পণ্য রফতানিতে যেখানে এক অঙ্কের বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল, সেখানে পরিষেবা রফতানির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষণীয় ছিল।
সাধারণ ভাবে দেখলে, পণ্যবাণিজ্যে বিপুল ঘাটতি ভারতীয় টাকার বাহ্যিক মান কমিয়ে দিয়েছে এবং কম বিনিয়োগে শ্রমনিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান পরিষেবা রফতানি থেকে আগত ডলারের স্রোত আবার টাকার মূল্যবৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই ব্যয়সাপেক্ষ পরিকাঠামো এবং পরিমাণ-নির্ধারকের অভাবে পর্যুদস্ত শ্রমনিবিড় উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তাকে অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি, যদি ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ নীতি কিছু পরিমাণে শ্রমনিবিড় উৎপাদনের সুযোগ তৈরিও করে দেয়, ভারতের বাণিজ্য সাফল্য অধিকতর সফল রফতানির দিকেই ইঙ্গিত রাখবে, নৌশাদ ফোর্বস উল্লিখিত উদ্ভাবন এবং গবেষণা ও উন্নয়ন ঘটিত যুক্তিগুলি এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়েই দেখা দেয়, সন্দেহ নেই।
এ থেকে হয়তো ভারতে একান্ত প্রয়োজনীয় লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে না। কিন্তু চাকরির বাজারে ব্যর্থতা যে অতীতে সযোগের সদ্ব্যবহার না করারই ফল, সে কথা মানতে হবে। এখন কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ হয়তো শিল্পের বিপরীতে কৃষির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। যদি ভারত উচ্চ বিনিয়োগের, কর্মনিযুক্তি-নির্ভর কৃষির বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে, তা হলে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি ও মজুরি, দুই-ই বাড়বে। বিশ্ববাজারে পণ্য উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেতে গেলে ভারতকে কৃষিক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনের বিষয়ে ভাবতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy