—প্রতীকী চিত্র।
উপভোক্তা বা বাণিজ্যমহলের মতামতের ভিত্তিতে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নির্দিষ্ট সময় অন্তর যে সমীক্ষা করে, তা বৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি সামগ্রিক অর্থনৈতিক (ম্যাক্রো ইকোনমিক) সংখ্যার তুলনায় প্রায়শই অনেক বেশি স্পষ্ট ছবি তুলে ধরে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলিতে দেখা গিয়েছে, বাণিজ্য ও আর্থিক ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কথাই উঠে আসছে। সেই সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে স্থিতিশীলতার দৃঢ় ইঙ্গিত এবং আয়-ব্যয় সংক্রান্ত পোক্ত হিসাবের খতিয়ান। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির পূর্বাভাস যাঁরা দিয়ে থাকেন, তাঁদের হাতেই এই সব সমীক্ষা হয়েছিল। সে দিক থেকে দেখলে, তাঁরাও এই আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির ব্যাপারে সায় দিচ্ছেন। অর্থনীতি বিষয়ে এই সার্বিক আশাবাদ উৎসবের মরসুমে সামগ্রিক অর্থনীতির পরিসংখ্যানেও প্রতিফলিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি কমে এসেছে, শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, বেকারত্ব হ্রাস পাচ্ছে, কর বা রাজস্ব আদায় বেশ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে এবং ক্ষেত্রভিত্তিক বৃদ্ধিও বেশ ভাল।
এই উজ্জ্বলতার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম সমস্যার ছায়া কিন্তু নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না। যেমন, শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের অংশে খানিক খামতি চোখে পড়ছে। এবং উত্তরণের প্রকৃত কোনও সূচক দেখা যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্যাপাসিটি ইউটিলাইজেশন পার্সেন্টেজ-এর সূচক ৭০ শতাংশের কোঠায় রয়ে যাচ্ছে (এই সূচক দ্বারা কোনও সংস্থা বা অর্থনীতি তার সম্ভাব্য উৎপাদনের কাছাকাছি পৌঁছচ্ছে কি না বোঝা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা অর্থনীতি ৮৫ থেকে ১০০ শতাংশে তার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে)। গত সাত-আট বছরে (কোভিড অতিমারির সময়কার পতনকে বাদ দিয়েও) এই পরিস্থিতি বহাল থেকেছে। নতুন পরিস্থিতিতে যদি লক্ষণীয় বিনিয়োগ ঘটেও থাকে এবং তা এই সূচককে বাড়ানোর জন্য সচেষ্টও হয়, তবুও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
নতুন পরিস্থিতিতে উৎপাদকদের দেওয়া রিপোর্টগুলি থেকেও এই থমকে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধি (গত বছরের পরিসংখ্যানকে মাথায় রেখেও দেখা যাচ্ছে) বিগত চারটি ত্রৈমাসিকে বেশ সঙ্কীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। কিন্তু, এই নিম্নগামিতা সত্ত্বেও বাণিজ্য সম্ভাবনার সূচক (এখন ১৩৫.৪) ২০১৫-১৬ সালের পরিসংখ্যানের তুলনায় (যে বিন্দু থেকে হিসাব নেওয়া শুরু হচ্ছে) সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে।
এরই সমান্তরালে উপভোক্তা বিষয়ক সমীক্ষাও কিন্তু ততখানি আশার সঞ্চার করছে না। ‘অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি’ সংক্রান্ত হিসেব-নিকেশ অবশ্য গত দু’বছরের তুলনায় দৃঢ়তর উন্নতির ইঙ্গিত দিলেও সূচক ২০১৯-এর শেষ দিকে যা ছিল, তার চাইতে বেশি উচ্চতায় পৌঁছতে পারছে না। মনে রাখা দরকার, ২০১৯ থেকেই বৃদ্ধির গতি শ্লথ হতে শুরু করেছিল। যাঁরা পরিস্থিতিকে উন্নতির দিকে ধাবমান বলে দেখাচ্ছেন, তাঁদের তুলনায় পরিস্থিতিকে সঙ্কটময় বলে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। কর্মনিযুক্তির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, আশাবাদীদের তুলনায় নিরাশাবাদীদের সংখ্যা সামান্য হলেও, বেশি।
সব থেকে বড় সমস্যা মুদ্রাস্ফীতিকে ঘিরে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের মত, পণ্যমূল্যের হার বাড়তির দিকেই। আগামী বছরেই যে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে, এমন কোনও সম্ভাবনা নেই। উপভোক্তা সংক্রান্ত রিপোর্ট জানাচ্ছে, ভোক্তাদের খরচের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধি একান্ত ভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে। জরুরি নয়, এমন পণ্য ক্রয়ের প্রবণতা তুলনায় কমেছে। আশার ব্যাপার এটাই যে, একটি দ্বিমাসিক সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ভোক্তাদের তরফে নেতিবাচক প্রবণতা কমছে। যাঁরা নিজেদের কঠিন পরিস্থিতির শিকার বলে মনে করছেন, সার্বিক ভাবে ধরলে তাঁদের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। অবশ্য এই অবস্থাও সাময়িক। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী প্রবণতা কিন্তু মোটের উপর বজায় থাকছে। বর্তমান পরিস্থিতির তুলনায় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে অনেক বেশি সংখ্যক ভোক্তাই দেখতে পাচ্ছেন।
পাশাপাশি, অন্য কিছু সূক্ষ্ম বিষয়েও নজর দেওয়া দরকার। যেমন, কর্মনিযুক্তির পরিস্থিতির উন্নতির পিছনে বিশেষ ভাবে কাজ করেছে একটি বিষয়। সেটি এই— স্বনিযুক্ত মানুষের সংখ্যা বেতনভুক মানুষের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। এর অর্থ এমন হতে পারে যে, ‘স্বনিযুক্তি’ বিষয়টি আসলে নিয়মিত কাজে নিযুক্ত হতে না-পারা মানুষ থেকে শুরু করে আংশিক সময়ের শ্রম দানকারীদের পর্যন্ত বোঝায়। আবার যাঁরা ছেড়ে আসা পেশায় ফেরার জায়গা খুঁজছেন, তাঁরাও এর মধ্যেই পড়েন। সুতরাং, নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নতির বিষয়টি বেশ ধোঁয়াটে ও বিভ্রন্তিকর।
অন্য অংশের থেকে এ কথাও শোনা যাচ্ছে যে, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ স্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। খুচরো ও ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণে বিপুল বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে। এর পিছনে এমন কারণও থাকতে পারে যে, বহু সংস্থাই আর্থিক দিক থেকে সমৃদ্ধ অবস্থায় রয়েছে এবং তাদের আপাতত ঋণের প্রয়োজন নেই। বিপরীত দিকে, আগের থেকে আরও বেশি সংখ্যক ভোক্তা তাঁদের ভবিষ্যৎ আয় সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত বোধ করছেন যে, ‘অ্যাসেট’ কেনার (মুখ্যত গাড়ি এবং জমি-বাড়ি) ব্যাপারে ঋণ নিতে দ্বিধা বোধ করছেন না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই পরিস্থিতিতে জানিয়েছে, ঋণ গ্রহণের বিষয়টি বেশ গোলমেলে এবং গৃহস্থদের ঋণগ্রস্ততা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে ঝুঁকির ব্যপার থেকে যাচ্ছে। এই সাবধানবাণী কিন্তু অমূলক নয়।
সার্বিক ভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আশাব্যঞ্জক বলে মনে হলেও, তার মধ্যে কিছু বিরোধাভাস থেকে যাচ্ছে। অর্থনীতি ক্রমে যে দিকে এগোচ্ছে, তাকে ‘নিউ-ওল্ড-নর্ম্যাল’ বৃদ্ধি বলে চিহ্নিত করাই যায়। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কিছু বেশি। বিশ্ব অর্থনীতির সাম্প্রতিক নিরিখে এই পরিসংখ্যান অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এই গতি বৃদ্ধির কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy