—প্রতীকী চিত্র।
মনে করে দেখুন বিশ্বযুদ্ধের পরের দশকগুলির কথা। আমেরিকা ইউরোপে তখন ধনতন্ত্রের স্বর্ণযুগ। সদ্য স্বাধীন হওয়া তৃতীয় বিশ্ব পশ্চিমের দেশগুলির নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। শুরু হয়েছে সাম্রাজ্য বিস্তারের নতুন অধ্যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আছে। ‘কোল্ড ওয়ার’ চলছে পুরোদস্তুর। কিন্তু ধনতন্ত্রের জন্য তা কোনও চ্যালেঞ্জ নয়। সবার বিশ্বাস আমেরিকার নেতৃত্বে রাষ্ট্রসংঘ বিশ্বব্যাঙ্ক ইত্যাদি সংগঠনগুলি গোটা বিশ্বকে নিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে। কোনও সমস্যাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
এমনই এক আধা-সমস্যা ধরা পড়ল আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ সাইমন কুসনেতস-এর গবেষণায়। লক্ষণীয় এই যে সমস্যার সমাধানও পাওয়া গেল অবিলম্বে। তিনি দেখলেন আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে অসাম্য বাড়বে। গরিব মানুষ আর ধনী মানুষের উপার্জন একই হারে বাড়বে না। যিনি ধনী তিনি দ্রুত আরও ধনী হবেন। যিনি দরিদ্র তিনি আরও পিছিয়ে পড়বেন। চিন্তার কারণ তো বটেই কিন্তু এই অসাম্য কোনও দিনই আর একটা ফরাসি বিপ্লব ঘটাতে পারবে না। কারণ অর্থনীতি একটা উন্নত স্তরে পৌছলে অসাম্য আবার কমে আসবে। গোড়ার দিকে অসাম্য বাড়ার একটা বড় কারণ হবে কৃষি এবং শিল্পে উৎপাদন ক্ষমতার তফাত। পরের দিকে সর্বত্রই উৎপাদন-ক্ষমতা বাড়বে। গোটা ব্যাপারটাই ঘটবে বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষিতে। সরকারের বা ট্রেড ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে না।
কুসনেতস তাঁর তত্ত্ব প্রয়োগ করে দেখলেন উন্নত দেশগুলির উপর। অসাম্যের মাপ হিসেবে নেওয়া হল ‘গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট’। দেশে ধনী এবং দরিদ্রের উপার্জনের তফাত বেশি হলে এই সূচক হয় ১-এর কাছাকাছি। তফাত কমলে সূচক কমে শূন্যের দিকে যায়। গিনি সূচক শূন্য হলে বুঝতে হবে দেশে সবার উপার্জন সমান যা কিনা কার্যত অসম্ভব। উন্নত দেশগুলির অভিজ্ঞতায় তাঁর তত্ত্বের সমর্থন পেলেন কুসনেতস। অর্থনীতির অবস্থানের সঙ্গে গিনি সূচকের রেখাচিত্র হল উলটো করা ইংরেজি অক্ষর ‘ইউ’-এর মতো। এরা ‘কুসনেতস রেখাচিত্র’ হিসেবে খ্যাত হল। বলে রাখা ভাল, উপার্জনে অসাম্য সব অসাম্যের মূল নয়। জাতি বর্ণ লিঙ্গও বৈষম্যের কারণ। তা আমরা আলোচনার বাইরে রাখব।
কিন্তু ধনতন্ত্রের এক সমস্যা যেতে না যেতেই অন্য সমস্যা এসে হাজির। ১৯৬২ সালে র্যাচেল কারসন প্রকাশ করলেন তাঁর বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। ডিডিটির মতো কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা প্রথম জনসমক্ষে আনলেন কারসন। বইটি প্রকাশ হতেই ‘বেস্ট সেলার’ হয়ে গেল। এবং আলোচ্য বিষয় ডিডিটি-তে থেমে থাকল না। ধনতন্ত্রের ‘যে কোনও মূল্যে উৎপাদন বাড়াতে হবে’-এই মন্ত্র একটা বড় ধাক্কা খেল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বললেন রোসো। এত ভয় পাবার কী আছে! দেখা যাক না এখানেও কুসনেতস-এর রেখাচিত্র কাজ করে কি না। এমন তো হতেই পারে যে কোনও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে গোড়ার দিকে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরের দিকে ক্ষতির পরিমাণ আপনিই কমে আসবে। অনেকেই অনেক তথ্য পেলেন এই পরিবেশ সংক্রান্ত কুসনেতস রেখাচিত্রের সমর্থনে।
আজকে পরিবেশবিদের প্রধান দুশ্চিন্তা বিশ্ব উষ্ণায়নকে কেন্দ্র করে। উষ্ণায়নের কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং মিথেন গ্যাসের নিঃসরণকে। এই নিঃসরণ কিছুটা হয় প্রাকৃতিক কারণে। বিগত তিনশো-সাড়ে তিনশো বছরে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কয়লা ও তেল পোড়ানো। তার সঙ্গে কয়লা, তেল ও খনিজ পদার্থের উৎপাদনের স্বার্থে জঙ্গল কেটে সাফ করা। এক দাগ উন্নয়নের জন্য পরিবেশের যত ক্ষতি করতে হয় তা যদি বেড়ে আবার কমে আসত তা হলে মন্দ হত না। কিন্তু অন্তত তিরিশ বছরের সম্মিলিত প্রচেষ্টার পরেও বিশ্ব উষ্ণায়নের হার কমানো যায়নি। টার্গেট নেওয়া হয়েছে উষ্ণায়ন একটা সীমার মধ্যে রাখার। কিন্তু তার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে কেউই রাজি নয়। পরিণাম যা হবার ছিল তাই হয়েছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা সাইক্লোন ইত্যাদি সংখ্যায় বেড়েছে। তার জন্য ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে।
ফিরে আসা যাক অসাম্যের প্রশ্নে। আপনি হয়তো বলবেন কেন অসাম্যের সঙ্গে কি সাইক্লোনের সম্পর্ক নেই? আছে। নিশ্চয়ই আছে। প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে অসাম্য বাড়িয়ে দিয়ে যায়। কারণ ক্ষতি হয় গরিব মানুষেরই বেশি। কিন্তু সে প্রসঙ্গে না-গেলেও চলবে। অসাম্যের উপর কাজের জন্য এখন যিনি সবার আগে, তিনি হলেন ফ্রান্সের টমাস পিকেটি। পিকেটি ২৫০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখলেন অসাম্যের আপনিই কমে যাবার ধারণা ঠিক নয়। অসাম্য বাড়তেই থাকবে যদি না সবাই মিলে এর মোকাবিলা করা যায়।
কুসনেতস আর পিকেটির সিদ্ধান্তে এই যে বড় ফারাক তা শুধু ব্যক্তি বিশেষের গবেষণা পদ্ধতির তফাত নয়। এ হল ধনতন্ত্রের দুই ভিন্ন পর্যায়ের পরিচায়ক। কুসনেতসের সময় ধনতন্ত্র দেখা দিয়েছে সঙ্কটমোচন অবতারের রূপ ধরে। পিকেটির সময়ে ধনতন্ত্রের সেই আত্মপ্রত্যয় আর নেই। বিশেষ করে অসাম্যের ক্ষেত্রে ধনতন্ত্রের রেকর্ড একেবারেই ভাল নয়। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ১০ পারসেন্ট মানুষের উপার্জন মোট উপার্জনের ৫২ পারসেন্ট। যেখানে নীচের ৫০ পারসেন্ট মানুষের আয় হল মোট আয়ের মাত্র ৮.৫ পারসেন্ট। কুসনেতসের গবেষণার সত্তর বছর পরে এই পরিস্থিতি নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য নয়। পিকেটি দেখালেন বিশ্বযুদ্ধের পরের তিরিশ বছর ফ্রান্সে অসাম্য উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। তার কারণ আর কিছুই নয়, চড়া ট্যাক্সের হার। বিশ্বজোড়া অসাম্যের প্রতিকারে তাই তাঁর পরামর্শ— মিলিয়নেয়ারদের উপর বিশেষ ট্যাক্স বসাও।
পিকেটি দেখিয়েছেন ভারতে স্বাধীনতার পরে অসাম্য লাগাতার কমেছে ১৯৮০ পর্যন্ত। তারপর অসাম্য বেড়েছে। এর কারণ আমরা জানি। ১৯৮০র দশকে ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধী শুরু করেন অর্থনীতিকে মুক্তকরণের কাজ। বৃদ্ধির হার বাড়ে। সেইসঙ্গে বাড়ে অসাম্য। পরে নরসিংহ রাও আর মনমোহন সিংহের জুটি অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেন। ফলে অসাম্যের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়। তার পর অসাম্য দ্রুত বেড়েছে। ২০১৭ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলে, সেই বছর যত সম্পদ তৈরি হয়েছে তার ৭৩ পারসেন্ট গেছে ১ পারসেন্ট মানুষের পকেটে। আর দেশের অর্ধেক মানুষের সম্পদ বেড়েছে মাত্র ১ পারসেন্ট। আমরা যদিও জানতাম যে মুক্ত অর্থনীতিতে অসাম্য বাড়বে, এতটা যে বাড়বে তা আমরা ভাবিনি। ২০১৭ সালের পরেও অক্সফ্যামের প্রতিবেদনে একই চিত্র ফুটে উঠেছে। শাসকের সঙ্গে ন্যারেটিভ না মিললে যা হয়, অক্সফ্যাম বাধ্য হয়েছে ভারতে তাদের কাজকর্ম গুটিয়ে নিতে।
কুসনেতসের গবেষণার পরে অনেকেই ভেবেছিলেন যে অসাম্য নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও মানে হয় না। দারিদ্র দূরীকরণ আমাদের অবশ্যই করণীয়। কিন্তু অসাম্য দূরীকরণ অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। এ কথা সবাই মানবে যে অসাম্য ছাড়া সঞ্চয় হবে না, বিনিয়োগ হবে না, বৃদ্ধি হবে না। পিকেটি কিন্তু বললেন, অসাম্য মাত্রা ছাড়ালে সে-ই হবে বৃদ্ধির অন্তরায়। আমাদের সৌভাগ্য আমরা এখনও সেই স্তরে পৌঁছইনি। কিছু সমীক্ষায় এ-ও মনে হচ্ছে যে গত দশকে আমাদের দেশে অসাম্য কিছুটা কমেছে। তার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এ কথা বলা যায় যে পিকেটির পরামর্শ মতো ট্যাক্স বাড়িয়ে একাজ হাসিল করা হয়নি। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার আজ দশ বছর হল কর্পোরেট ট্যাক্সে লাগাতার ছাড় দিয়ে চলেছে।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy