অমর্ত্য সেন বার বার আক্ষেপ করেন, এ দেশে জনজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি— যেমন বুনিয়াদি শিক্ষা, ক্ষুধা, বা শিশুদের অপুষ্টি— গণপরিসরের আলোচনায় তেমন আসে না। ফলে সেগুলি রাজনীতির বিষয়ও হয়ে ওঠে না। রাজনৈতিক চাপ গণতন্ত্রে নীতিনির্ধারকদের বাধ্য করতে পারে বিশেষ বিষয়ে নজর দিতে। ‘ক্ষুধা’ বিষয়টি শেষ হইহই করে গণমাধ্যমে ঢুকে পড়ল বটে, কিন্তু হায়! বিরোধী নেতা থেকে ‘বিকল্প’ সংবাদমাধ্যমের ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, সবাই যে ‘কান নিয়ে গেল চিলে’ শুনে এ রকম মুক্তকচ্ছ হয়ে দৌড়বে, তা কে ভেবেছিল? ‘দেশভক্ত’দের বাদ দিলে আর এমন কেউ নেই, যিনি বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবনমন নিয়ে মোদী সরকারকে চারটি কথা শোনাননি। ঠিক এমনটা হয়েছিল এক বছর আগেও, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২১ বেরোলে। একই কুনাট্যের পুনরভিনয় যেন।
পর পর তিন বছরে যে সূচকের মান ৯৪ থেকে ১০১ হয়ে ১০৭-এ নেমে আসে, এবং যে সূচকের নাম ক্ষুধা সূচক, তা নিয়ে বিরোধীরা কিছুই বলবেন না, তা কি হয়? বিরোধীদের তোলা আওয়াজ সরকারকেও শেষে বাধ্য করেছে বিবৃতি দিতে। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনে কী বলল সরকার? বলল, সূচক নির্মাণে পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে। সঙ্গে এটাও জুড়ে দেওয়া হল যে, বিদেশি শক্তি উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ভারতকে কালিমালিপ্ত করতে চাইছে। দ্বিতীয় বাক্যটির বিশেষ সারবত্তা না থাকলেও প্রথমটি কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এখন ক্ষুধা সূচক নিয়ে আর বেশি দূর যাওয়া যাচ্ছে না বলে বিষয়টি যদি থিতিয়ে যায়, আশ্চর্য হব না। আর সেটা হবে চরম দুর্ভাগ্যের। কারণ, ‘ক্ষুধা’ থাক বা না থাক, এ দেশে শিশু অপুষ্টির সমস্যাটি যারপরনাই উদ্বেগের বিষয়। সে কথায় পরে আসছি। বস্তুত গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁরাও কিন্তু এই র্যাঙ্কিং-কে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গেই ব্যবহার করতে বলেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
‘ক্ষুধা’ বলতে আমরা সাধারণ বুদ্ধিতে যা বুঝি, ক্ষুধা সূচক কিন্তু তা দেখায় না। অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন যে, ক্ষুধা বেড়েছে বলছে, কিন্তু এত যে চাল গম বিলি হচ্ছে, শুনছি সে সব গরুকেও খাওয়াচ্ছে অনেকে, তার পরও মানুষ না খেয়ে থাকছে, এটা সত্যি? এখানে একটু বোঝার ভুল হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা সূচক নামক যৌগিক সূচকটির পেটে যে চারটি আলাদা সূচক রয়েছে, তা থেকে কিন্তু সরাসরি নিদারুণ অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকা মানুষের হিসাব পাওয়া যায় না। সূচকগুলির একটি হল, কত শতাংশ মানুষের পর্যাপ্ত ক্যালরি জোটে না (যা আবার একটি ছোট নমুনা সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে), দ্বিতীয়টি জন্ম থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার, তৃতীয়টি কত শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম, আর চতুর্থটি কত শতাংশ শিশুর ওজন উচ্চতার তুলনায় কম। শেষ দু’টি সূচক শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির আন্দাজ দেয়। পেট ভরে শুধু ভাত খাইয়ে ক্ষুধা দূর হতে পারে, অপুষ্টি নয়।
অনেকেই জানেন না যে, শেষ তিনটি সূচকের তথ্য প্রতি বছর সংগ্রহ করাও হয় না। অতএব, পর পর তিন বছরে এই সূচকগুলির মান কী ভাবে পরিবর্তন হল, সে প্রশ্নও কাউকে করতে দেখিনি। অন্য দিকে, প্রথম সূচকটি যে সমীক্ষা থেকে উঠে আসে তা প্রতি বছর করা হয় বটে, কিন্তু তাতে নমুনার সংখ্যা মাত্র ৩০০০। অতএব সেই সূচকে বছর বছর পরিবর্তনটি কতটা প্রকৃত পরিবর্তন, আর কতটা নমুনাজনিত ভ্রান্তির কারণে, সে সন্দেহও থেকে যায়। সব মিলিয়ে দেখতে গেলে এই তথাকথিত ক্ষুধা সূচককে গুরুত্ব দেওয়ার তেমন কারণ নেই। এমন নড়বড়ে সূচক আপনি-আমি বানালে কেউ ছোঁবেই না। সাহেবরা বানালে অবশ্য অন্য কথা। তবে বিবদমান দু’পক্ষের কথাবার্তা শুনেই ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে যে, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের পাতা ওল্টানোর সময় ও সুযোগ কোনও পক্ষেরই হয়নি। দশ লাইনের প্রেস ব্রিফ থেকে দশ কাহন বিবৃতিই এখনকার দস্তুর, অথচ হাতের কাছেই রয়েছে তথ্যের ভান্ডার।
এ বার আসল কথায় আসি। ক্ষুধা সূচককে যে এত সহজে ধরাশায়ী করে ফেলা যাচ্ছে, এটাই উদ্বেগের বিষয়। এর ফলে আসল সমস্যায় দৃষ্টি আকর্ষণের কাজটি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের অপুষ্টির সমস্যাটি এ দেশে ব্যাপক ভাবে আছে, এবং তা যে যারপরনাই গভীর, এই কথাটি বার বার তুলে ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার দরকার ছিল। আর তা করতে গেলে যে তথ্য লাগবে, তাও নাগালেই আছে— ক্ষুধা সূচকের মতো গোলমেলে বস্তুর উপর নির্ভর না করলেও চলে। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার (এনএফএইচএস) বিভিন্ন রাউন্ডের তথ্য একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। কিন্তু বিরোধীরা সহজ রাস্তা ধরলেন।
আগেই বলেছি, কত শতাংশ শিশুর উচ্চতা তাদের বয়সের তুলনায় কম (যাদের ‘স্টান্টেড’ বলা হয়), এবং কত শতাংশের ওজন তাদের উচ্চতার তুলনায় কম (‘ওয়েস্টেড’), এই দুই সূচক থেকে পাঁচ বছর বা তার কম বয়সি শিশুদের অপুষ্টির আন্দাজ পাওয়া যায়। এর সঙ্গে অবশ্য আর একটি সূচক যোগ করা যায়— বয়সের তুলনায় ওজন কম। সাম্প্রতিক এনএফএইচএস (২০১৯-২১) অনুসারে ভারতীয় শিশুদের ৩৫.৫ শতাংশ স্টান্টেড, আর ১৯.৩ শতাংশ ওয়েস্টেড। আগের রাউন্ডের (২০১৫-১৬) সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, অনুপাতগুলি কমেছে অতি সামান্য। শতাংশের হিসাবে এত বেশি ওয়েস্টেড শিশু বিশ্বের আর কোনও দেশে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ওয়েস্টেড শিশুর অনুপাত ১৫ শতাংশের বেশি হলেই তা ‘অ্যালার্মিং’।
পরিবারগুলিকে আর্থনীতিক শ্রেণি অনুসারে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করলে দেখা যাবে যে, সর্বোচ্চ ২০% পরিবারের মধ্যে বয়সের তুলনায় খর্বকায় শিশু যেখানে ২৩.১%, সেখানে দরিদ্রতম ২০ শতাংশের মধ্যে তা ৪৬.৪%। আর্থনীতিক শ্রেণিভেদ অনুসারে অপুষ্টির এমন চরম বৈষম্য বিশ্বের কম দেশেই দেখা যায়। এই পরিসংখ্যান কিন্তু সরকারের পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই; কারণ সমীক্ষাটি সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা করে থাকে।
উচ্চতার সঙ্গে অপুষ্টির এই সম্পর্ক নিয়ে জনমানসে যথেষ্ট বিভ্রান্তি আছে। অনেকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আশেপাশে অতি সচ্ছল, এমনকি ধনী পরিবারেও খর্বকায় মানুষ দেখতে পাই যে? ধনী ও মধ্যবিত্তের মধ্যে যেমন বিভিন্ন উচ্চতার মানুষ দেখা যায়, তেমনই দেখা যায় দরিদ্রদের মধ্যেও। কিন্তু গড়পড়তা হিসাব নিলে অবশ্যই দেখব যে, গরিবদের গড় উচ্চতা ধনীদের তুলনায় কম। ঊনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্যের কার্টুনগুলি দেখলে বোঝা যায়, এই ব্যাপারটা কার্টুনিস্টরা জানতেন। দরিদ্র সাধারণ মানুষকে সর্বদাই খর্বকায় দেখি তাঁদের কার্টুনে। ইংরেজিতে ‘লুক ডাউন অন’ এই বাক্যাংশটি ভাবুন। এর অর্থ অবজ্ঞা বা হেয়জ্ঞান। কিন্তু এই বাক্যাংশটিকে যদি আক্ষরিক অর্থে নিই, একটা ছবি দেখতে পাই। ‘ক’ দেখছেন ‘খ’কে, একটু উচ্চতা থেকে নীচে। শব্দের উৎস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরাও এমনই ইঙ্গিত করছেন— ‘লুক ডাউন অন’-এর দু’দিকের দুই ব্যক্তির দৈহিক উচ্চতার পার্থক্য আর্থসামাজিক অসাম্য নির্দেশ করে। উচ্চতার পার্থক্য যে পুষ্টির পার্থক্যের কারণে, এবং পুষ্টির পার্থক্য যে পর্যাপ্ত খাদ্যগুণসম্পন্ন খাদ্যের সহজলভ্যতার তারতম্যের কারণে, যা আবার আর্থসামাজিক অসাম্যের সঙ্গে জড়িত, সে কথা ঊনবিংশ শতকে অজানা ছিল না। পশ্চিমের দেশগুলিতে আর্থনীতিক প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার গড় মানের উন্নতি হতে থাকলে মানুষের গড় উচ্চতাও বাড়তে থাকল। সেই দেশগুলিতে শিশুদের বাড়ন্তকালে পুষ্টির অভাব যতই দূর হতে থাকল, আর্থনীতিক শ্রেণি অনুসারে উচ্চতার পার্থক্যও কমে এল। যা এখন চিন জাপান সম্পর্কেও বলা যায়।
শৈশবের অপুষ্টির প্রভাব যে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়, সে কথা অজানা নয়। দৈহিক ক্ষমতা থেকে মানসিক ধারণাশক্তি, সব কিছুকেই তা প্রভাবিত করে। তবু সরকারি নজরে তা সামান্যই আসে। আইসিডিএস প্রকল্প, যার ওই বয়সি শিশুদের পুষ্টির অভাবটি পূরণ করার কথা, চলছে প্রায় অর্ধ শতক ধরে। তার পরও শিশুদের অপুষ্টি ‘অ্যালার্মিং’ স্তরেই রয়ে গেল। এই বিষয়টি জনপরিসরে সে ভাবে এল কি?
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy