যুদ্ধের পিছনে অন্য অঙ্ক? ফাইল চিত্র
আমেরিকায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বিষয়ে অনুসন্ধানরত দুই সাংবাদিককে ‘ডিপ থ্রোট’ হিসেবে পরিচিত সূত্র (যত দূর জানা যায়, ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই-এর তৎকালীন অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর মার্ক ফেল্ট ওই ছদ্মনামের পিছনে কাজ করছিলেন) পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘‘টাকার উৎসকে অনুসন্ধান করো।’’ এই মুহূর্তে ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বুঝতে চাইলেও সেই পরামর্শটির কথাই মনে পড়ছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর থেকে ইতিহাসে বিভিন্ন পতন-অভ্যুদয়ের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলেও ‘ডিপ থ্রোট’-এর পরামর্শই বার বার কানে বাজছে। কারণ, যদি কোনও দেশ যদি কিছু গোষ্ঠীপতির (আদতে কিছু ব্যবসায়ী যাঁরা রাজনীতি ও প্রশাসনিক নীতিনির্ধারণের দুই ক্ষেত্রকেই নিয়ন্ত্রণ করেন) হাতে গিয়ে পড়ে, তবে সেই দেশটি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় ভুগতে শুরু করে বা সোজা ভাবে বললে, তার মধ্যে বিভ্রান্তি, বিক্ষিপ্ত ও পরস্পরবিরোধী ভাবনার বহিঃপ্রকাশ দেখা দেয়। জাতিগত ভাবে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে এবং অংশত রাশিয়াতেও এই অবস্থা দেখা দিয়েছিল। আর তা থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে এক টানাপড়েনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
কাহিনির সূত্রপাত সম্ভবত ২০০৬ সালের একটি বৈঠকে, যেখানে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইউশেঙ্কো তাঁর প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্যান্য কয়েক জন মন্ত্রী এবং ডিমিত্রি ফিরটাশ নামে এক গোষ্ঠীপতির সঙ্গে মিলিত হন। ফিরটাশ সেই সময় দেশের চেম্বার অব কমার্সের প্রধান ছিলেন। সম্প্রতি ফিরটাশ ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-কে জানিয়েছেন, সেই বৈঠকে পশ্চিমপন্থী ইউশেঙ্কো বলেছিলেন, রাশিয়ার ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে বাধা দেওয়ার আগেই ইউক্রেনের তরফে ‘ন্যাটো’-তে যোগ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। ও দিকে আবার রাশিয়াপন্থী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ভিন্ন মত ব্যক্ত করে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান।
তুর্কমেনিস্তান থেকে ইউক্রেনে গ্যাস নিয়ে এসে বিক্রি করাই ছিল ফিরটাশের প্রধান ব্যবসা। এই কাজে তিনি রাশিয়ার অন্যতম প্রধান শক্তি সরবরাহকারী সংস্থা ‘গ্যাজপ্রোম’-এর পাইপলাইন ব্যবহার করতেন। গ্যাজপ্রোম বহুজাতিক সংস্থা হলেও তার মালিকানার সিংহভাগ ছিল রুশ সরকারের হাতে। ইয়ানুকোভিচের পরে প্রধানমন্ত্রিত্ব ইউলিয়া টিমোশেঙ্কোর হাতে যাওয়ার পর তিনি ফিরটাশের গ্যাস ব্যবসার ইতি ঘটিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন এবং গ্যাজপ্রোম-এর সঙ্গে এক প্রত্যক্ষ বন্দোবস্তে আসেন। এর ফল দাঁড়ায় ভয়াবহ। ইউক্রেনে জ্বালানি গ্যাসের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করে। টিমোশেঙ্কো পশ্চিম ইউরোপে ২০০৪ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত ‘অরেঞ্জ রেভোলিউশন’-এর ‘নায়িকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। সেই ‘বিপ্লব’-এ রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাচ্যুত হন। ইউক্রেনের অভ্যন্তরে টিমোশেঙ্কো পরিচিত ছিলেন ‘গ্যাস প্রিন্সেস’ নামে। পুতিনের মতো এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তিনি বোঝাপড়ায় আসতে সমর্থ হয়েছিলেন, এটিই ছিল তাঁর খ্যাতির প্রধান কারণ। দুই পরস্পর-বিরোধী শিবিরকে নিয়ে তিনি খেলতে জানতেন, খেলায় জয়ী হতেও জানতেন। কেবল ফিরটাশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ব্যাপক শত্রুতায় গিয়ে দাঁড়ায়।
২০১০ সালে ‘গ্যাস প্রিন্সেস’ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন। ফিরটাশ তাঁর প্রতিপক্ষের দিকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এই প্রতিপক্ষকে হারিয়েই এক সময়ে টিমোশেঙ্কো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজিত করেছিলেন। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফেরটিশ জানান, ইয়ানুকোভিচের প্রতি তাঁর সমর্থনের পিছনে রাশিয়া-প্রীতি বা রাশিয়া-বিরোধিতা খুঁজতে চাওয়া ভুল হবে। টিমোশেঙ্কোর সঙ্গে বোঝাপড়াই তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল। গ্যাস চুক্তির কারণে টিমোশেঙ্কোর কারাদণ্ড হয়। দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে অনেকেই ঘটনাটিকে রাজনৈতিক আলোকে দেখেছিলেন। অনেকটা যে ভাবে ভারতের ‘এজেন্সিগুলি’ নিলামদারি পরিচালনা করে, সে ভাবেই।
ইউক্রেনের অসংখ্য গোষ্ঠীপতির মধ্যে ফিরটিশ একটি উদাহরণ মাত্র। তাঁর থেকে অনেক বড় মাপের খিলাড়ি হলেন রিন্যাট আখমেটভ। যিনি কার্যত ডনবাসের শাসনভার পরিচালনা করেন। ডনবাস ইউক্রেনের ভারী শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। পুতিনের নজর অনেক দিন ধরেই ডনবাসের দিকে। এই দুই গোষ্ঠীপতি ইয়ানুকোভিচের দলের পার্লামেন্ট সদস্যদের অর্ধাংশকে এবং সেই সঙ্গে মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টিকেও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। এঁদের দু'জনেরই আর্থিক উন্নতি ঘটে উল্লেখযোগ্য ভাবে। জার্মানির সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘স্পিগেল’ এঁদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে ‘যৌথ বাণিজ্যোদ্যোগ’ বলে বর্ণনা করে। ধুরন্ধর খিলাড়ি হওয়া সত্ত্বেও ২০১৪ সালের মাইডান বিপ্লবের (‘রেভোলিউশন অব ডিগনিটি’ হিসেবেও পরিচিত) প্রাক্কালে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক ঘুঁটি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফিরটাশ ‘গ্যাস প্রিন্সেস’-এর ক্ষমতায় ফেরার ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলেন। ঘটনার গতি বদলালে ইয়ানুকোভিচকে পালিয়ে গিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে হয়। ক্রুদ্ধ পুতিন ক্রিমিয়া দখল করেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের ডনবাসে ফিরিয়ে আনেন।
এই সময় রঙ্গমঞ্চে তৃতীয় গোষ্ঠীপতির প্রবেশ ঘটে। ইগর কোলোমোইস্কি। ১৯৯০-এর দশকে হেনাডিই বোহোল্যুবভ নামের এক চতুর্থ গোষ্ঠীপতির সঙ্গে তিনি গাঁটছড়া বেঁধে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় নেমেছিলেন। তাঁদের ব্যাঙ্কটিই পরে ইউক্রেনের বৃহত্তম ব্যাঙ্কে পরিণত হয়। ঘটনা পরম্পরায় কোলোমোইস্কি নতুন প্রসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কোর বিষনজরে পড়ে যান। পোরোশেঙ্কো নিজেও একজন গোষ্ঠীপতি। তিনি আবার ‘চকোলেট কিং’ নামে পরিচিত ছিলেন। কোলোমোইস্কি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। অর্থ তছরুপের কারণে তাঁর ব্যাঙ্কের ২০১৬ সালে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ ঘটে।
কিন্তু ২০১৯ নাগাদ যখন নির্বাচনের সময় উপস্থিত, কোলোমোইস্কি ফিরে আসেন এবং আবার রাজনীতির খেলায় যোগ দেন। তাঁর টেলিভিশন চ্যানেল পোরোশেঙ্কোর প্রতিদ্বন্দ্বী, পেশায় কৌতুকশিল্পী ভোলোদিমির জেলেনেস্কির হয়ে প্রচার শুরু করে। জেলেনেস্কি এই মুহূর্তে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সংবাদ শিরোনামে। দুর্নীতি দূরীকরণকে হাতিয়ার করে জেলেনেস্কি তাঁর নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও ইউক্রেনের এই ইতিহাসের ধারায় এক লাগসই ব্যক্তিত্ব। প্রথমত, ২০২১-এ ‘প্যান্ডোরা পেপারস’ থেকে জানা গিয়েছিল প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর অন্তরঙ্গ সম্প্রদায় সাগরপারের বেশ কিছু বাণিজ্য সংস্থার নেটওয়ার্ক থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত। দ্বিতীয়ত, জেলেনেস্কি তাঁর প্রাক্তন পৃষ্ঠপোষকের থেকে নেকনজর সরিয়ে নেন এবং দু’মাস আগে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেন।
উপরের এই কাহিনি থেকে এ কথাই স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায় যে, ইউক্রেন সেই সব দেশের কাছে এক গুরুতর ভয়ের উদাহরণ, যেখানে গোষ্ঠীপতিরা ক্ষমতা নিয়ে খেলে চলেছেন। কিভ-এ তাঁরা বিপুল সম্পদ জমিয়েছেন, একই সঙ্গে তাঁরা তাঁদের গণমাধ্যম সাম্রাজ্যকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক পদপ্রার্থীদের কখনও তুলেছেন, কখনও ফেলেছেন। কার মনোনীত লোক মন্ত্রিত্ব পাবে, তাঁরাই ঠিক করে দিয়েছেন, কারা কেমন দামে গ্যাস সরবরাহ করবে— তা-ও তাঁরাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোন রাজনৈতিক দল মাথা চাড়া দেবে এবং ক্ষমতা কায়েম করবে আর কোন দল পুতিনের থাবার নীচে বশংবদ হয়ে থাকবে, সে সবও তাঁরাই ঠিক করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে, যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) তার ১৫ বছর আগেকার অবস্থান থেকে একচুলও নড়েনি। এই সব গোষ্ঠীপতিরা যখন টানাপড়েনের খেলায় মত্ত থেকেছেন, তাঁদের দেশ ইউরোপের একদা-সোভিয়েত থেকে বেরিয়ে আসা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দরিদ্রতম হয়ে থেকে গিয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রতিবেশি দেশগুলিতে শরণার্থী। ইউক্রেনের উপর এখন সীমাহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকার, যেখানে যে কোনও মুহূর্তে ঝলসে উঠতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের বিধ্বংসী আলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy