অব্যবস্থা: কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিক্ষোভ চলছে, ২৮ সেপ্টেম্বর।
মিডিয়ার সঙ্গে এত ওঠাবসা কেন? নিজের ভাল বোঝেন না? ফোন এসেছিল স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কাছ থেকে। মাস তিনেকও হয়নি, হুমকি প্রথার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, শুধু তাঁকে নয়, তাঁর পরিবারকে, তাঁর সন্তানকে কী ভাবে দিনের পর দিন ফোনে, রাস্তায় ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। অপরাধ একটাই, তিনি নিয়ম মেনে শিক্ষকতা করতে চেয়েছেন। পরীক্ষা নিতে চেয়েছেন।
হুমকির সেই খবর আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গের সেই মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষিকার দাবি, সেই সময়ে তিনি কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকলেও তখন কিছুই হয়নি। রাজ্য জুড়ে তখন আন্দোলনের ঝড়। মুখ খোলার মাসুল দিতে হবে না ভেবে নিশ্চিন্তই হয়েছিলেন। কিন্তু দিনকয়েক আগে তাঁকে ফোন করেন স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা। শিক্ষিকার দাবি, ওই কর্তা তাঁকে বলেন, নিজের ভাল চাইলে তিনি যেন মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলেন। কারণ, “দিনকাল ভাল নয়। কখন কী হয়ে যায়!” রাজ্যের নামী মেডিক্যাল কলেজের ওই প্রবীণ শিক্ষিকার কথায়, “এত আন্দোলনের ফল কী মিলল তা হলে! স্পষ্ট বুঝতে পারছি গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা জুড়ে আবার ডানা ঝাপটাচ্ছে চিল-শকুনেরা। যেটুকু ভয় ওরা পেয়েছিল, একটু একটু করে সবটাই কেটে গেছে।”
আবার যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরনো কঙ্কাল বেরিয়ে আসছে একটু একটু করে, তার বার্তা রটছে দিকে দিকে। রামপুরহাট, বর্ধমান, সাগর দত্ত, কল্যাণী জে এন এম, এমনকি আর জি করেও ফিরছে পুরনো ত্রাসের চেহারা। কারা উল্টো পথে হেঁটেছে, কারা অন্য সুরে কথা বলেছে, তালিকা তৈরি। এ বার হিসাব বুঝে নেওয়ার পালা। যেমন, রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে অভীক-বিরূপাক্ষ লবির যে অনুগামীরা আন্দোলন চলাকালীন আন্দোলনকারী ডাক্তারদের কাছে গিয়ে রীতিমতো কান্নাকাটি করতেন, বলতেন, ‘এই খপ্পর থেকে বেরোতে চাই’, তাঁরাই এখন ‘দেখে নেওয়া’র মুডে ফেরত গেছেন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়া এবং চিকিৎসকদের একাংশ অভিযোগ করছেন, তাঁরা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে একাধিক বার জানিয়েছেন, পরিস্থিতি আবার খারাপ হচ্ছে, তাঁরা পড়াশোনা, কাজ কোনওটাই করতে পারছেন না, কিন্তু প্রতি বারই কর্তৃপক্ষ জোর দিয়েছেন, লিখিত অভিযোগের উপর। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে সাসপেন্ড হওয়া যে ১১ জন পড়ুয়া মুচলেকা দিয়ে ঢুকেছিলেন, তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধেও ফের অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। সব ক্ষেত্রেই কর্তারা জোর দিচ্ছেন প্রমাণের উপরে, লিখিত অভিযোগের উপরে। কোথাওই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্তের কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। অর্থাৎ, ঠেকে শিক্ষা নেয়নি এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। কিংবা জেনেবুঝেই শিক্ষাটা নিতে চায়নি।
শুধু কি হুমকি প্রথা? কোনও কিছু না বদলানোর ছবি তো সর্বত্র। ম্যালেরিয়া পরীক্ষার কিট নিয়ে সরবরাহকারী সংস্থার দুর্নীতি ধরা পড়েছে সম্প্রতি। জানা গেছে, বরাত পাওয়ার সময়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা যে নমুনা পাঠিয়েছিল তার থেকে তাদের সরবরাহ করা জিনিসের মান সম্পূর্ণ আলাদা। খাস কলকাতা শহরের নামী মেডিক্যাল কলেজে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময়ে সিরিঞ্জ ভেঙে যাচ্ছে। রোগীদের রক্তারক্তি কাণ্ড। সেলাই করার সময়ে সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে। অস্ত্রোপচারের পরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না, সংক্রমণ ছড়াচ্ছে রোগীর। লিভার-কিডনির ওষুধ খাওয়ার পরেও রোগ কমার বদলে বাড়ছে। ডাক্তারদের একাংশ কপাল চাপড়াচ্ছেন, “সবই কি তা হলে আগের মতোই রইল?”
দৃশ্যত তেমন কোনও বদলই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চোখে পড়ছে না। শুধু বদল এসেছে এ বারের স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষা ব্যবস্থায়। সেখানে বিপুল কড়াকড়ি। এতটাই কড়াকড়ি যে পড়ুয়ারা ‘রুষ্ট হয়ে’ কোথাও কোথাও ভাঙচুরও চালিয়েছেন। প্রশ্ন হল, এই কড়াকড়ি কত দিন অবধি চলবে? পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা বহু বছর ধরে যুক্ত আছেন, তাঁরাও ঘোরতর সন্দিহান। কেউ কেউ বলছেন, আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ, যাঁরা এ বার স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের শিক্ষা দিতেই এ বারের প্রক্রিয়া এত কঠোর করা হয়েছে। মোদ্দা বিষয় হল, সরকার দুর্নীতি সরিয়ে স্বচ্ছ পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবতে পারে, সেটাই মানতে পারছেন না কেউ।
এখন আবার আগের মতোই চোখ মেললেই দেখা যাচ্ছে, রাত বাড়লেই বিভিন্ন হাসপাতাল চত্বরে নেশার আড্ডা। বহু ওয়ার্ডে কার্যত বিনা চিকিৎসায় রোগী পড়ে থাকছেন। বদলায়নি রেফার রোগ। প্রতি দিন বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে কারণে-অকারণে রোগী রেফার করা হচ্ছে অন্যত্র। যেখানে রেফার করা হচ্ছে সেখানে আদৌ শয্যা খালি আছে কি না, সেটা দেখার দায় কারও নেই। কোনও রোগীকে স্থিতিশীল না করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া যে কার্যত রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ারই শামিল, তা কেউ মনেই করেন না। সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ এ সব থেকে বাঁচতেই ভরসা রেখেছিলেন আন্দোলনে। তাঁরা আশা করেছিলেন যে, ঘুণ ধরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনেক কিছু বদলাবে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাঁরা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু পাবেন। সেই ভরসাই ফের চিড় খাচ্ছে।
কাগজে-কলমে আন্দোলন এখনও জারি আছে। হয়তো আরও কিছু দিন থাকবেও। কিন্তু স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে সেই আন্দোলনে চিকিৎসককুলের বাইরের মানুষের অংশগ্রহণ এক ধাক্কায় তলানিতে। মিছিলে, সভায় ভিড় কম। রাত জাগার কর্মসূচিতেও জনসমর্থন নিভে এসেছে। রাতের পর রাত যাঁরা সেক্টর ফাইভে দাঁড়িয়ে থাকতেন ধর্না মঞ্চের পাশে, পুজোর দিনগুলোতে সমস্ত আনন্দ ভুলে অনশনরত পড়ুয়াদের জন্য যাঁরা চোখের জল ফেলতেন ধর্মতলায়, তাঁরা আজ কোথায়?
হুইল চেয়ারে চাপিয়ে অশীতিপর মাকে নিয়ে একাধিক দিন ধর্মতলার ধর্না মঞ্চে হাজির হতে দেখেছিলাম এক যুবককে। পেশাগত কারণেই সেই সময়ে সংগ্ৰহ করেছিলাম তাঁদের যোগাযোগের নম্বর। এখন কী ভাবছেন তাঁরা, জানতে ফোন করতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধা। “আর কোনও আশা বেঁচে নেই। কিছুই বদলাল না। শুধু ওই মেয়েটা অত যন্ত্রণা সহ্য করে চলে গেল, বিচার পেল না...”— কথা শেষ করতে পারেন না তিনি। গলা বুজে আসে কান্নার দমকে। কেন আর কোনও আশা বেঁচে নেই? আর জি কর আন্দোলনের ঠিক পর পরই কয়েকটি উপনির্বাচনে শাসক দলের বিপুল জয় তাঁদের হতাশ করল, না কি সিবিআই চার্জশিট জমা দিতে না পারায় সন্দীপ ঘোষ-অভিজিৎ মণ্ডলের জামিন হওয়া, সঞ্জয় রায় ছাড়া অন্য কোনও অভিযুক্তকে চিহ্নিত করতে না পারা, মৃত চিকিৎসক-পড়ুয়ার বাবা-মায়ের আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ানো, সব মিলিয়ে তাঁদের তিল তিল করে তৈরি হওয়া বিশ্বাসে ফাটল ধরল?
আন্দোলনরত পড়ুয়াদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেই মনে হয়েছে, তাঁদের ভিতরকার জোরটাও কোথাও যেন কমতে শুরু করেছে। নিজেদের পঠনপাঠন, ডাক্তারি ছেড়ে তাঁরা রাস্তায় পড়ে থাকবেন দিনের পর দিন, সেটা বাস্তবসম্মত নয় অবশ্যই। কিন্তু আর জি করের লড়াইকে আমজনতার লড়াই হিসেবে তুলে ধরার যে স্বপ্ন তাঁরা দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নের প্রতিও তাঁরা সুবিচার করছেন কি? সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের আচরণ নিয়ে বছরের পর বছর একই অভিযোগ ওঠে। আউটডোরে-ইমার্জেন্সিতে দুর্ব্যবহার, দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করা, চিকিৎসা না করে ফেলে রাখা, রোগী ও পরিজনের প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার করা, অভিযোগের শেষ নেই। আর জি কর আন্দোলন কি সেই ছবিতেও কোনও বদল আনতে পেরেছে? রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের ছবি কিন্তু সে কথা বলছে না। দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়ার পরেও সাধারণ মানুষকে নস্যাৎ করার সাহস এখনও তাঁরা অনেকেই দেখিয়ে চলেছেন। অহরহ।
মনে পড়ে গেল, আর জি করে কর্মবিরতি চলাকালীন ফেরত যাওয়া এক রোগীর পরিবারের কথা। চিকিৎসা না পেয়ে তাঁদের ফিরতে হয়েছিল, কিন্তু অভিযোগের একটা শব্দও তাঁদের মুখে শোনা যায়নি। এক তরুণ চিকিৎসকের হাত ধরে রোগীর বৃদ্ধ বাবা বলেছিলেন, “আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও। কিন্তু আবার যখন সব স্বাভাবিক হবে, তখন আমাদের কথা ভুলে যেও না। ধুঁকতে ধুঁকতে তোমাদের কাছে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিও না যেন।” ওই মুহূর্তে সেই তরুণ চিকিৎসক ওই বৃদ্ধের হাত দুটো জড়িয়ে ধরেছিলেন।
আন্দোলনের পাঁচ মাস পেরোতে না পেরোতেই সেই হাত আবার আলগা হয়ে গেল কেন, সেইপ্রশ্ন কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের নিজের কাছে নিজেদেরই করতে হবে। ওই আন্দোলন যে নেহাৎ হুজুগ ছিল না, সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব অনেকটাই তাঁদের উপরে বর্তায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy