অধিকাংশ মানুষের সাধারণ মানসিকতার পরিসরে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ব্যর্থতা, দুই-ই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রথম অর্ধে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জয়জয়কার; মধ্যবয়সে এসে কী কী পাওয়া হল না ভেবে হাহাকার। অবশ্য, এই দুই পর্বের মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ব্যর্থতার ছোটখাটো যুদ্ধ চলতেই থাকে। জীবনে উত্তরণের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা জরুরি; আবার অধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সমস্যা হল অসফল উচ্চাকাঙ্ক্ষার অত্যধিক যন্ত্রণা। ফলে, যে মানুষ শুধু যুক্তিবোধ দ্বারা পরিচালিত, সে এই দু’টির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে চলে। সমস্যা হল, তেমন বিশুদ্ধ যুক্তিবাদী মানুষের সন্ধান অর্থশাস্ত্রের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পাওয়া যায় না। আমাদের মতো মানুষের আজীবন টানাপড়েন এই দুইয়ের মধ্যে।
অর্থনীতির চত্বরে বৈষম্য-তাড়িত মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং হতাশা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বহু দিন। বেশ কিছু উচ্চমানের গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল যে, যাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে বৈষম্যের শিকার— পিছিয়ে পড়া মানুষ— তাঁরা উপরের ধাপে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় শিক্ষায় বেশি বিনিয়োগ করতে চাইবেন। অর্থাৎ, ধনতান্ত্রিক সমাজে বৈষম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিকে, বেশি রোজগারের দিকে ঠেলে দিতে চাইবে। কিন্তু, তৃতীয় বিশ্বের পরিসরে চর্চিত কিছু সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে যে, যদি মানুষের হাতে উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের তেমন রসদ না থাকে, তা হলে তাঁরা শিক্ষায় অতিরিক্ত বিনিয়োগ করলে, রসদের অভাবে পরিবার অপুষ্টিতে ভুগতে পারে। তার ফলে অপুষ্টি এবং আয়ের উত্তরণ এক সঙ্গে হতে থাকবে। আবার, পড়শিদের আর্থিক সচ্ছলতার মাপকাঠি যদি হয় তাঁরা ক’টা আইফোন কিনছেন, বা বিয়ের আসরে কত খরচ করছেন, তা হলে নিম্নবিত্ত পরিবারের উৎপাদনশীল বিনিয়োগ তেমন বাড়বে না। এর সঙ্গে জুড়ে থাকবে আর্থিক বৈষম্যের গতিবৃদ্ধিজনিত দুশ্চিন্তা ও হতাশা।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার স্তরে দারিদ্র নিয়ে যত কথা হয়, তার তুলনায় বৈষম্য নিয়ে আলোচনার পরিসর অনেক কম। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কী ভাবে আর্থিক পরিমাপে পিছিয়ে পড়া মানুষদের মস্তিষ্কে ঝড় তোলে, কী ভাবে তাঁরা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, কোন ধরনের সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক প্রভাব কী রকম— এই কথাগুলো রাষ্ট্রীয় স্তরে বিবেচিতই হয় না। বৈষম্যের সঙ্গে আপাত-সম্পর্কহীন, এমন অনেক সরকারি পদক্ষেপও যে বৈষম্যের কারণে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, সে কথার স্বীকৃতিই নেই।
যেমন, এ দেশে নিম্নবিত্তদের পক্ষে উদ্যোগপতি হওয়া শক্ত। হাতে সম্পদ না থাকলে ব্যাঙ্কে ঋণ মেলে না। সরকার যতই সবাইকে উদ্যোগপতি হওয়ার পরামর্শ দিক, এ দেশের সহজ গল্পটি হল: গরিব ও মধ্যবিত্ত ব্যাঙ্কে টাকা রাখেন, এবং সে টাকায় বড়লোকরা ব্যবসা করেন— ঋণ নেওয়ার সময় নিরাপত্তা হিসাবে জমা রাখার মতো সম্পদ বেশির ভাগ মানুষেরই নেই। তা ছাড়া গণেশ ওল্টালে কোথায় ঠাঁই নেবেন সাধারণ মানুষ? ফলে অনেক সময়ই ঋণের তেমন চাহিদা থাকে না। যদি সরকার সুদ কমায়, তাতেও নিম্নবিত্তদের তেমন লাভ হয় না। কারণ তাঁরা ঋণই পান না, অন্তত ‘সাদা’ সূত্র থেকে। অবশ্যই অসংগঠিত ঋণের একটি চালু বাজার আছে, ‘কালো’ ঋণের। অবশ্যই তা সে যতই কালো হোক, তার জন্যই অনেকে বেঁচে থাকেন। কিন্তু, সে ‘বেঁচে থাকা’ শুধুমাত্র কোনওক্রমে বেঁচে থাকাই— অসংগঠিত ক্ষেত্রের চড়া সুদের হারই কার্যত নিশ্চিত করে যে, সেই ঋণ যাঁদের নিতে হয়, তাঁদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়া অসম্ভব। ফলে, দারিদ্রের বিষচক্রটি যে লাগাতার ঘুরতেই থাকে, তার পিছনে এই সংগঠিত ক্ষেত্রের তুলনায় সস্তা ঋণের অভাব, এবং তার পরিবর্তে চড়া সুদে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ঋণ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার কথা ভুললে চলবে না।
প্রকট বৈষম্যের একটি দিক হল কম বা শূন্য সম্পদশালী জনসংখ্যার বাহুল্য। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মুদ্রা নীতি টাকার জোগান বাড়াতে চাইলে তেমন কাজ না-ও হতে পারে, যদি আমেরিকাও তেমন নীতি অনুসরণ করে। টাকাকড়ির পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা সরাসরি বৈষম্যজনিত দুর্বল ব্যবসায়িক উদ্যোগের ঋণের চাহিদার ঘাটতির জন্য। বৈষম্য নিয়ে ভ্রুকুঞ্চন শুধু কল্যাণমূলক কাজের জন্য প্রয়োজন নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি সংক্রান্ত বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ নীতির কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্যও প্রয়োজন। নীতিগুলি কেমন কাজ করছে সেটা জানার চেষ্টা করলেই বৈষম্যের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব। দুর্ভাগ্য, সে গবেষণার তিলমাত্র হয় না।
সারা জীবন ধরে আমরা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর হতাশার লড়াইয়ের সাক্ষী। নিম্নবিত্তদের ক্ষেত্রে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং হতাশা ভীষণ ভাবে সামাজিক পরিসরের বৈষম্যের উপর নির্ভরশীল। তাঁদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, তাঁদের সামাজিক কল্যাণ এবং সামাজিক উপেক্ষা থেকে মুক্তি নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy