Advertisement
E-Paper

এই দাসত্বের অন্ত কোথায়

২ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস’। দিনটি পালিত হয় পৃথিবী থেকে দাসত্ব মুছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, যাতে প্রত্যেক মানুষ সসম্মানে, স্বাধিকার নিয়ে বাঁচতে পারেন, অন্যায়ের সুবিচার পান।

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:২৫
Share
Save

নির্ভয়া মামলায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত মুকেশ সিংহ বলেছিলেন, তরুণীর উচিত ছিল বাধা না দিয়ে নির্যাতন সহ্য করা। তা হলে মরতে হত না। অভিযুক্তদের আইনজীবী এ পি সিংহও বলেছিলেন, রাতে মেয়ে কোথায় গিয়েছে, খোঁজ না রাখা মা-বাবার অন্যায়। এই ‘অন্যায়’-এর শাস্তি দেওয়া পুরুষজাতিভুক্ত স্বনিযুক্ত জ্যাঠামশাইদের জন্মগত অধিকার। কাজেই যোনিপথে রড প্রবেশ করিয়ে পুরুষাধিকারের প্রয়োগ সাধনায় বাদ সাধা নির্যাতিতার অনুচিত। বশ মানা দাসীর মতো চুপচাপ ধর্ষিত হয়ে টুকটাক খুন হয়ে যাওয়াই উচিত।

২ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস’। দিনটি পালিত হয় পৃথিবী থেকে দাসত্ব মুছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, যাতে প্রত্যেক মানুষ সসম্মানে, স্বাধিকার নিয়ে বাঁচতে পারেন, অন্যায়ের সুবিচার পান। ‘দাস’ কথাটির সঙ্গে কোনও ‘মালিক-এর কাছে অনৈচ্ছিক বশ্যতা স্বীকারের সম্পর্ক নিবিড়। কাজেই প্রাচীন কালের মানুষ বেচাকেনার জমানা প্রায় অদৃশ্য হলেও ‘দাস’দের বাঁচিয়ে রাখার দায় নিয়েছে আধুনিক দাসত্ব। তার চেহারা আলাদা। যন্ত্রণা সেই একই। আজ মালিকের ভূমিকায় কিছু তন্ত্র, বেনিয়ম, বেলাগাম লোভ, নির্লজ্জ রাজনীতি, অসাধু মানুষ ও তাদের অন্যায় ব্যবস্থা। ‘আধুনিক দাসত্ব’ বজায় আছে মানুষ পাচার, যৌন শোষণ, শিশুশ্রম, বলপূর্বক বিবাহ, শিশুকে জবরদস্তি সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা ইত্যাদিতে। ২ ডিসেম্বর দিনটি নানা দেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিদের দাসত্ব দূরীকরণের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর কথা মনে করায়, দাসত্বের শিকার মানুষজনের পাশে দাঁড়াতে শেখায়।

দাসপ্রথার কিছু ঝলক এখনও বিভিন্ন জনজাতির বা সংখ্যালঘু মানুষের উপর নির্যাতনের বৃত্তান্তে চোখে পড়ে। এক জন মানুষের বাঁচার জন্মগত অধিকারকে অন্য মানুষ বা গোষ্ঠী হিংস্র ভাবে হরণ করে তাঁকে বশ হতে এখনও বাধ্য করে। এই বছর ভারতে দলিতদের উপরে অত্যাচারের ঘটনাগুলি তার সাক্ষী। উত্তরপ্রদেশে ১৫ বছরের দলিত কিশোরকে উচ্চবর্ণের তিন যুবক প্রস্রাব পানে বাধ্য করে। কর্নাটকে ৬৭ বছরের দলিত বৃদ্ধকে মেরে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারণ, বৃষ্টির মধ্যে উচ্চবর্ণের মানুষের দোকানে আশ্রয় চেয়েছিলেন।

দাসত্ব টিকে থাকে ভয়, হুমকি, লোভ, ক্ষমতালিপ্সা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়ে। ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন’ বলছে, প্রতি আট শিশুর এক জনকে জোর করে ‘দাস’ বানিয়ে রাখা হয়। মহিলাদের দাসত্ব তো অনেক ক্ষেত্রেই সমাজ-স্বীকৃত। যৌন হেনস্থার শিকার প্রতি পাঁচ জনের চার জনই নারী। বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মীদের অনেককেই জোর খাটিয়ে দাসত্ব করতে বাধ্য করা হয়।

দেশের মাটিতে দাঁড়ালে দেখব নানা মাপের, নানা রঙের জামা পরা দাসত্ব বিপুল সংখ্যক নাগরিকের জীবন নরক করে তুলছে। সংবিধানে মানুষ পাচার নিষিদ্ধ (২৩ নম্বর ধারা)। অথচ ‘ইউনিসেফ’ বলছে, বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর যে বারো লক্ষ শিশু পাচার হয়, ভারতই তার বৃহত্তম উৎস, ট্রানজ়িট ও গন্তব্য। সস্তা শ্রমিকের লোভে, সামাজিক বৈষম্য, অশিক্ষা, দারিদ্রের সুযোগে দেশে অসংখ্য শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে বা আসছে। গণিকাবৃত্তি, যৌন শোষণ, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যে পাচার হয়। শুধু ২০২২-এই ভারতের বুক থেকে হারিয়ে গিয়েছিল প্রায় ৮৩,০০০ শিশু। অনেকেই পাচার হয়েছিল বলে ধারণা।

মোট শিশুসংখ্যার প্রায় ৪% শিশুশ্রমিক নিয়ে আমরা দাসত্ব বিলোপের শপথ নিয়ে থাকি। দেশে শুধুমাত্র ২০২২-এ ধর্ষিত হয়েছিল প্রায় ৩৮,৫০০ শিশু। প্রতি মিনিটে তিন জন শিশুকন্যার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার জন্য তারা শরীরে, মনে প্রস্তুতই নয়! ২০২২-এ ভারতে প্রতি দিন পণের দাবি মেটাতে না পেরে খুন হন ২০ জন মহিলা। গার্হস্থশ্রম এমন পর্যায়ে যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত মহিলাদেরও প্রায় ২৬.৫% জীবনসঙ্গীর দ্বারা নির্যাতিত (শারীরিক ভাবেও) হন। আরও কত গুণ ট্র্যাজেডি হিসাবের বাইরে, কে জানে! শিশু, মহিলা ছাড়াও অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মচারী থেকে শুরু করে অসহায় প্রবীণ— অধিকাংশ মানুষকেই কারও অথবা সিস্টেমের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়! কারণ রাষ্ট্র তাঁদের জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

‘আধুনিক দাসত্ব’-এর কারণ হিসাবে দারিদ্র, লোভ, হিংসা, কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি অনেক কিছু দেখানো হয়। মানুষকে, এমনকি কাছের মানুষকেও দাবিয়ে রাখার জন্য আর এক মানুষের প্রবৃত্তিই বোধ হয় সবের মূলে। না হলে একই পরিবারে কী ভাবে এক জন ‘মালিক’, অপর জন ‘দাস’-এর ভূমিকা নেন? দাসত্বের কারাগার থেকে বেরোতে আগে নিজেকে শিক্ষিত করতে হবে। তবেই তাগিদ আসবে অপরকে শেখানোর যে সহমর্মিতার চেয়ে বড় সম্পদ নেই। পরিবর্তনের ডাক দিতে, সরকারকে সজাগ করতে সংগঠন চাই। সভা-সমিতি, অনলাইন প্রচারের দ্বারা সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে যে, একই সমাজের বাসিন্দা সকলে। নিজেদের ভিন্নতা নিয়েই তাঁরা পরস্পরের সহযাপক হওয়ার অধিকারী। কেউ কারও মালিক বা দাস নন। কঠিন কাজ। তবু করা দরকারি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Modern Slavery Human Trafficking Child Trafficking Women Harassment Smuggling torture

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}