মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়নের বিকল্প নিয়মকানুন ঘোষণার পর দিনই ফোনটা এল। কান্না-চাপা গলা, “স্যর আমি সপ্তমী বলছি, আমার তো ইলেভেন-এর পরীক্ষা ভাল হয়নি। ওই নম্বর দিয়ে আমাদের ফাইনাল রেজ়াল্ট হবে? কী হবে তা হলে স্যর? আমি তো কোথাও চান্স পাব না…।” সপ্তমীর মা ‘বাসাবাড়ি’তে কাজ করেন, ওকেও ভাত রান্না করে ক্লাসে আসতে হত। মনে পড়ে গেল, একাদশ শ্রেণিতে শেক্সপিয়রের নাটক নিয়ে দুর্দান্ত প্রদর্শনী করেছিল সপ্তমীরা, তিন দিনে কাঠের টুকরো আর পিচবোর্ড দিয়ে বানিয়ে ফেলেছিল গ্লোব থিয়েটারের আশ্চর্য রেপ্লিকা। ওরা জানত, পরের বছর খুব করে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য খেটে নেবে, কারণ দ্বাদশের ফলাফলটাই উচ্চ মাধ্যমিকের চূড়ান্ত ফল, কলেজে যাওয়ার প্রবেশপত্র।
অতিমারির কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, দু’টিই খারিজ হয়েছে এ বছর, বাতিল হয়েছে দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় বোর্ডের পরীক্ষাগুলিও। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের এই সর্বজনীন পরীক্ষাগুলিকে বিশেষ সম্ভ্রমের ও গুরুত্বের চোখে দেখে অভ্যস্ত আমরা, তাই পড়ুয়া আর অভিভাবকদের নিরাশা, সংশয় আর দিশাহীনতার অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে রাজ্য জুড়ে। এ বারের ফল পরীক্ষা আর মূল্যায়ন সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণার শিকড় ধরে টান দিয়েছে। এ-ও কোভিডের আঘাত। গত দু’বছর ধরে ভেঙে যাচ্ছে আমাদের কত না ধারণা— পরমায়ুর, চিকিৎসা ও শুশ্রূষার, সামাজিক সম্পর্ক, এমনকি ‘উৎসব’ বা ‘অন্ত্যেষ্টি’র ধারণাও। শিক্ষাঙ্গনে ভেঙে যাচ্ছে শ্রেণিকক্ষের মৌলিকতা, পঠন-পাঠনের সংজ্ঞা। যদিও ‘মার্কশিট’-এর গুরুত্ব একই রয়ে গেল। বরং এ বছর রাজ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সব রকম প্রবেশিকা পরীক্ষা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এ বারের ‘না হয়ে-ওঠা’ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মার্কশিটের কাগজে লগ্ন হল আরও বাড়তি মূল্য। যদিও আমরা বুঝছি, আজকের মার্কশিট-পাঠ অতীতের সঙ্গে মিলবে না। মূল্যায়ন বদলে গিয়েছে। ‘বোর্ড পরীক্ষা’ নামক সর্বজনীন অনুষ্ঠানটির আধিপত্য ও মান্যতা চ্যালেঞ্জের মুখে।
সময় এসেছে পরীক্ষাকে পুরো শিক্ষণকাল জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার। বছরভর ছোট ছোট মূল্যায়ন হলে শিক্ষক-পড়ুয়ার সংযোগ ও পাঠ বিনিময় আরও নিবিড় হয়ে উঠবে। পড়ুয়াটিও জানবে, একটি ছোট মূল্যায়ন পর্বে সে একটু পিছিয়ে থাকলেও পরেরটিতে ভাল করার সুযোগ পাবে। কোনও একটি চূড়ান্ত প্রকাণ্ড মানদণ্ডের সামনে তাকে দুরুদুরু বুকে দাঁড়াতে হবে না। পঠনপাঠন ও নানা ক্রিয়াকলাপে গড়া তার প্রতি দিনের জীবন স্থান পাবে মূল্যায়নের কাগজটিতে। এই ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরির আড়ালে সংগৃহীত হতে থাকুক সমাজের নানা পরিসরের শিক্ষকদের অভিমত-সম্বলিত পাঠ ও প্রশ্নের বহু বয়ান। সেগুলোর সারাৎসার রচনা করুক সংশ্লিষ্ট বোর্ড বা কাউন্সিল। ভাগ করে নিক বিদ্যালয়গুলির সঙ্গে। তাতে ‘সিলেবাস’ নামক নিশ্ছিদ্র নির্মাণটির গায়ে এসে লাগবে নানা প্রান্তের বাতাস।
পরিবর্তনের হাওয়া বহু আগেই ঘূর্ণি তুলেছে এ রাজ্যের স্কুলগুলোতে। ক্রমশ ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে শ্রেণিকক্ষের সংজ্ঞা, পঠনপাঠনের রীতি, স্কুল-উপযোগী শৃঙ্খলা-সহবত সম্পর্কে ধারণা, সে সবই নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে। মাথা তুলছে নতুন নতুন নির্মাণ— ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ সহপাঠীদের মধ্যে নানা বৈষম্যের আড়াল তৈরি করছে। সময় যেন তর্জনী তুলে বলে দিচ্ছে, সর্বশিক্ষা চাইলে এক কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল তৈরি করলেই আর হবে না। ইন্টারনেট পরিষেবার অধিকার সর্বজনীন হোক— ঘরে ঘরে বিদ্যুতের মতো, ইন্টারনেট সংযোগও আবশ্যক পরিষেবার অঙ্গ হয়ে উঠুক। মিড-ডে মিলের মতো, প্রতিটি শিশু পড়ুয়ার হাতে আসুক সিম কার্ড বা ডেটা প্যাক। তাদের হাতে দিতে হবে একটি স্মার্ট ফোন। নেওয়া যায় অন্য পথও। কেরলে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ের জন্য সরকারি উদ্যোগেই চলছে একটি টিভি চ্যানেল। কোভালামের গ্রামের সরকারি স্কুলশিক্ষক সাইমন লুইস জানালেন, গ্রামাঞ্চলে যে সব শিশুর ফোন নেই, স্থানীয় প্রশাসন বা পঞ্চায়েত তাদের একটি স্মার্টফোন ‘ধার’ দিচ্ছে। স্কুল ছেড়ে যাওয়ার সময়ে সে ফোনটি ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি চ্যানেলে টেলিভিশনে ক্লাস চলছে তামিলনাড়ুতেও।
মনে রাখা ভাল, আমরাই কেবল ছেলেমেয়েদের মূল্যায়ন করি না। তারাও অনবরত আমাদের নম্বর দিয়ে চলে। যে শিশুটি বিদ্যালয়ের নিরাপদ অঙ্গন ছেড়ে মায়ের সঙ্গে বাসাবাড়ির কাজ করছে, বা পথের ধারে আনাজ বিক্রি করছে, তার শিশুমন প্রতিনিয়ত আমাদের বিচার করে চলেছে। এই লেখা লিখতে লিখতেই মেসেজ এল সপ্তমী দাসের। “স্যর, আমরা শেষ বারের মতো এক দিন ইস্কুল যেতে চাই। ইস্কুলের জামাটা পরতে চাই। হেডস্যরকে একটু বলবেন?” ওর উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশিট আলো করে আসেনি কোনও স্বপ্নের সংখ্যা। কিন্তু সেই খেদকে ছাপিয়ে উঠেছে স্কুলের প্রতি ভালবাসা। এই সম্মানের যোগ্য কি হয়ে উঠছে আমাদের স্কুলগুলো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy