১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে সংবিধান রচনা পরিষদের বিদায়ী সভায় বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেডকরের বিখ্যাত ভাষণে তিনি শুধু ক্ষুরধার ভাষায় স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তাঁর জায়গাটি যে পাকা করেছেন তা নয়, ওই নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি রেখে গিয়েছেন রাজনৈতিক দিব্যদৃষ্টির প্রমাণ। বলেছেন, “ধর্মীয় জীবনে আত্মার মুক্তির জন্য ‘ভক্তি’ হতে পারে সাধনার প্রকৃষ্ট পথ। কিন্তু রাজনীতিতে ভক্তি, বা ‘হিরো ওয়রশিপ’, হচ্ছে অবধারিত বিনাশের রাস্তা, যার পরিণতি হল ‘ডিকটেটরশিপ’।” কে জানত তখন যে এক দিন ওই ভক্তিমার্গ বেয়েই ভারত শুরু করবে স্বৈরতন্ত্রের পানে তার আত্মঘাতী যাত্রা? আরও বলেছিলেন, ব্রিটিশ চলে গিয়েছে, দেশ এখন স্বাধীন, সুতরাং যখনতখন পথে নেমে আইন অমান্যের দিনও শেষ; এখন যেন বন্ধ হয় নৈরাজ্যের ব্যাকরণ, ‘গ্রামার অব অ্যানারকি’।
তবে অাম্বেডকর ওই স্মরণীয় ভাষণে ভারতের জাতীয় চরিত্র সম্পর্কে বেশ কয়েকটি মন্তব্য করেছেন, যা সদ্যস্বাধীন দেশটিতে গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব সম্পর্কেই সন্দেহ জাগায়। বলেছিলেন, রাজনৈতিক গণতন্ত্র শুধু ভোটের বাদ্যি বাজিয়েই নিয়ে আসা সম্ভব, কিন্তু তা টিকবে না যদি সমাজটি রয়ে যায় অগণতান্ত্রিক। তার জন্য প্রয়োজন ‘লিবার্টি’, ‘ইকোয়ালিটি’ ও ‘ফ্রেটারনিটি’— স্বাধীনতা, সাম্য ও সম্প্রীতি। এই তিন বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে না দেখে, অাম্বেডকর বলেছিলেন, তাদের একত্র করে দেখতে এক ত্রয়ী হিসেবে, যেন এক ‘ট্রিনিটি’। বিশেষ করে বলেছিলেন সম্প্রীতির কথা। সম্প্রীতি ব্যতিরেকে কী ভাবে উঠে দাঁড়াবে স্বাধীনতা বা সাম্য? “ইট উড রিকোয়ার আ কনস্টেবল টু এনফোর্স দেম (স্বাধীনতা ও সাম্য)।” সম্প্রীতি কী? তাও বুঝিয়েছেন আম্বেডকর। বলেছেন সম্প্রীতি হল এমন ভ্রাতৃত্ববোধ, যা একাত্মতা সঞ্চার করে সমগ্র জাতির মধ্যে। সেটি খুবই শক্ত কাজ।
এ যে যথার্থই ভবিষ্যৎদ্রষ্টার কথা, তা আবার পরিষ্কার হল আমেরিকান তথ্যবিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের ভারতে ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহ এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে। ‘সহিষ্ণুতা এবং পৃথকীকরণ’ নামে এই সমীক্ষা করা হয় ৩০,০০০ উত্তরদাতাকে নিয়ে, ২০১৯-২০২০ সালে। হিন্দু (৮১%), মুসলিম (১২.৯%), খ্রিস্টান (২.৪%), শিখ (১.৯%)—একটি ব্যাপার যা এই সমীক্ষা প্রথমেই অবাক করে তা হল, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্য সম্প্রদায়কে ‘আলাদা’ বলে অনুভব করা। ৬৬ শতাংশ হিন্দু ভাবে মুসলমান এক পৃথক জাতি, এবং হিন্দুদের সম্পর্কে ৬৪ শতাংশ মুসলমানেরও তাই ধারণা। বিস্ময়ের কিছু নেই, কারণ এটিই তো মুসলিম লীগ অথবা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল বক্তব্য। আশ্চর্য ব্যাপার একটিই— হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় ভারতে এক মিশ্র সমাজের বিবর্তন মসৃণ করবে, সত্তর বছর আগের এই ধারণাটি তা হলে এখন এক অলীক কল্পনামাত্র।
আর একটি বিষয়ে পিউ-এর সমীক্ষা—আন্তঃসম্প্রদায় বিবাহ। নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে বিবাহ সম্পর্কে দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু সম্পূর্ণ অনাগ্রহী, এবং মুসলিমদের এই ব্যাপারে বিরোধিতা আরও বেশি, ৮০ শতাংশ। এই ফল যদি ঠিক হয়, তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) বহুচর্চিত ‘লাভ জেহাদ’-এর অভিযোগ— মুসলিমরা নাকি জনসংখ্যায় তাদের অংশ বাড়াতে পুরুষদের প্ররোচিত করছে ‘ফুসলিয়ে’ হিন্দু কন্যা বিবাহ করতে— তা কিন্তু ধোপে টিকছে না। আবার বন্ধু নির্বাচনেও ভারতীয়রা মূলত সম্প্রদায়ভিত্তিক। প্রায় অর্ধেক হিন্দুর (৪৭%) বক্তব্য, কাছের বন্ধুরা সকলেই তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত ও অতিরিক্ত ৩৯% আরও খোলসা করে জানায় যে, তাদের বন্ধুদের হিন্দু হতেই হবে। এখানে একটি কথা বিশদ করা প্রয়োজন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বন্ধু, প্রতিবেশী, বান্ধবী, পত্নী— সব কিছু নির্বাচনেই হিন্দুদের স্বাধীনতা অন্য সব সম্প্রদায়ের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং, সংখ্যাগরিষ্ঠের গোঁড়ামির ধাক্কা অন্য সম্প্রদায়ের কাছে বেশি গুরুতর মনে হবে। আবার অপর সম্প্রদায়কে প্রতিবেশী হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হিন্দু গোঁড়ামি বহুকাল যাবৎ প্রবাদপ্রতিম। ৪৫ শতাংশ হিন্দু অবশ্য এখন বলছে আশেপাশে কে বাস করছে তা নিয়ে তারা চিন্তিত নয়, কিন্তু অন্য ৪৫ শতাংশ হিন্দুর মতে বাসস্থানের পরিপার্শ্বে থাকা উচিত স্বধর্মের মানুষই। উপরন্তু এই ৪৫ শতাংশের একটি ‘সাব-সেট’, ৩৬ শতাংশ, জানিয়েছে যে, তাদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি মুসলমান প্রতিবেশী গ্রহণ করতে। সমীক্ষাকারকদের মতে, ভারতে হিন্দুরা চায় মুসলমান থাকতে হয় থাকুক, কিন্তু পৃথক ভাবে ‘লিভ সেপারেটলি টুগেদার’।
গোঁড়ামির রেখাচিত্রের প্রসার কমে আসে আর্থিক অবস্থা ও শিক্ষার উচ্চকোটিতে, কিন্তু নিম্ন ও মধ্য স্তরে তা এতই স্ফীতকায় যে, গড়পড়তায় হিন্দুদের ‘গোঁড়া’ তকমা অবধারিত। পিউ-এর মতে, গোঁড়ামির একটি পরিচয়— ‘ভারতীয়’ হতে হলে প্রয়োজন হিন্দু ধর্মাবলম্বন ও হিন্দি ভাষাজ্ঞান, এই ধারণা। লালা লাজপত রাই-এর কথায় ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান’। ৬৪ শতাংশ হিন্দু উত্তরদাতা মনে করে খাঁটি ভারতীয় একমাত্র হিন্দুরাই। ৫৯ শতাংশ হিন্দুর মতে হিন্দিজ্ঞান হল ভারতীয়ত্বের দ্যোতক।
আবার এই দু’টি বৈশিষ্ট্যও সম্পর্কিত। সেই হিন্দুরা যারা মনে করে, হিন্দু না হলে ভারতীয় হওয়া অসম্ভব, তাদের পুরো ৮০ শতাংশের মতে ভারতীয় হতে গেলে হিন্দি জানা চাই-ই চাই। তবে এই সব গোঁড়ামি দেশের এক-এক অঞ্চলে এক-এক রকম। গোমাংস ভক্ষণ করলে হিন্দু পরিচয় ত্যাগ করতে হবে, এই মত দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের হিন্দুদের ৮০ শতাংশের। কিন্তু পশ্চিম ভারতে সেই অনুপাত ৬৮, এবং দক্ষিণে তা মাত্র ৫০। হিন্দু ধর্মীয় পূজাপার্বণে যে অংশগ্রহণ করে না সে হিন্দুই নয়— মত উত্তর ভারতের ৭০ শতাংশ হিন্দুর। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে উপরিউক্ত অনুপাতটি কেবল ৩৭ শতাংশ। আরএসএস-এর ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-ও উত্তরে গাঢ়, কিন্তু দক্ষিণে ফিকে। ভারতীয় জাতীয় পরিচিতি ও হিন্দু ধর্মীয় পরিচিতি একাকার হয়ে গিয়েছে মধ্য ভারতে (৮৩%) ও উত্তর ভারতে (৬৯%), কিন্তু দক্ষিণ ভারতের ৫৮ শতাংশ হিন্দুর চোখে হিন্দু পরিচয়ের সঙ্গে ভারতীয় পরিচিতির কোনও যোগ নেই। সমীক্ষার মতে, ধর্মবিশ্বাসের এই উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন রাজনৈতিক মতামতের বিভাজনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যে কারণে, সমীক্ষকদের মতে, দক্ষিণের হিন্দুদের মাত্র ১৯ শতাংশ ভোটার ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টিকে। এই বিভাজন যে সাময়িক নয়, তা আরও পরিষ্কার হল সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে, যখন দক্ষিণের দু’টি রাজ্য কেরল ও তামিলনাড়ুতে বিজেপি পেল যথাক্রমে ০ ও ৪টি আসন।
সমীক্ষা বলছে, পৃথকীকরণ ও বিচ্ছিন্নতার নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে শুধু হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যেই নয়, খ্রিস্টান শিখ বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও। এরা সকলেই ভারতে বাস করছে ‘সেপারেটলি টুগেদার’। স্বাধীন ভারতের রূপকারদের— জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই পটেল, অাম্বেডকর— এঁদের মনে দেশের অগণতান্ত্রিক মানসিকতা ঘিরে সন্দেহ থাকলেও আশা ছিল যে, রাষ্ট্র যদি সব সম্প্রদায়কে সমান সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে, তবে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হবে সম্প্রীতি, যে সম্প্রীতির কথা অাম্বেডকর উল্লেখ করেছেন বারংবার। ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ সম্পর্কে সবচেয়ে সন্দিহান ছিলেন অাম্বেডকর, যিনি পূর্বোক্ত ভাষণে বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হচ্ছে জমির উপর বিছানো আস্তরণ, কিন্তু তার নীচে ভারতের মাটিটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।” নেহরু অবশ্য আরও আশাবাদী ছিলেন। শুরুতে তিনি রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে ব্যবধান চাইলেও তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের মধ্যগগন থেকেই তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, রাষ্ট্র যদি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হয়, তবে কমবে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা। তার পর কত জল বয়ে গিয়েছে গঙ্গা দিয়ে; তার কোনও প্রভাবই পড়েনি দেশের সবচেয়ে জনবহুল উত্তর ও মধ্যভারতের হিন্দু রক্ষণশীলতার উপর। এই রক্ষণশীলতাই সংখ্যালঘুদের করে দিয়েছে সন্ত্রস্ত ও সমান রক্ষণশীল। এই ‘জেনোফোবিয়া’র শিকড় যে দেশের এক বিপুল অংশের মনোজগতে কত গভীরে প্রবিষ্ট, তা দেখা গেল এই সমাজসমীক্ষাটির কল্যাণে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy