—ফাইল চিত্র।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের ষষ্ঠ বাজেট-বক্তৃতাটি শোনার পর মনে হতেই পারে যে, এ হল শব্দকল্পদ্রুম। গত এক দশকে বাজেট-ভাষণে ভাষার জটিলতা বেড়েছে কয়েক গুণ। কেন এই ভাষার জিমন্যাস্টিক? উত্তরটা হচ্ছে, শব্দজাল তৈরি করে দেশের সমস্যা ও সঙ্কট থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়া।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী অর্থবর্ষে পরিকাঠামো খাতে সরকার ব্যয় করবে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৩.৪ শতাংশ— ১১,১১,১১১ কোটি টাকা। এই অর্থের পরিমাণ যদি জিডিপির ৩.৪ শতাংশ হয়, তা হলে জিডিপির অঙ্কটা দাঁড়াচ্ছে ৩২৭ লক্ষ কোটি টাকার মতো। আমেরিকান ডলারের চলতি মূল্যে যা ৩.৯৩ ট্রিলিয়ন থেকে ঈষৎ বেশি। কিন্তু সরকারি হিসাবেই তো আমাদের জিডিপির বহর হচ্ছে ৩.৭৩ ট্রিলিয়ন ডলার! বাড়তি কুড়ি হাজার কোটি ডলার এল কোথা থেকে, সেই প্রশ্নেই কিন্তু ধাঁধা ফুরোয় না। বাজেট-বক্তৃতায় এটাও দাবি করা হয়েছে যে, বিগত বছরের তুলনায় এই বাজেটে পরিকাঠামোয় বরাদ্দ বেড়েছে ১১ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রতি একশো টাকায় ৩.৪৫ টাকা পরিকাঠামোর জন্য খরচ হচ্ছে, এই কথাটি সগৌরবে জানানোর পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী সম্পূর্ণ নীরব থাকলেন একটি অন্য তথ্যের ক্ষেত্রে— শুধু সুদ মেটাতেই সরকার আগামী বছর কোষাগার থেকে ব্যয় করবে প্রতি একশো টাকার জাতীয় উৎপাদন থেকে ২০ টাকা।
২০২৩-২৪’এর বাজেটে মোট ব্যয়বরাদ্দ ছিল ৪৫ লক্ষ কোটি টাকা। এ বার তা হয়েছে প্রায় ৪৮ লক্ষ কোটি। বৃদ্ধির হার ৫.৮৩ শতাংশ। এই হিসাবে ফাঁকি কোথায়? বাজেট বলছে, এই মুহূর্তে ভারতের জিডিপির বহর হল প্রায় ৩২৭ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের ব্যয়বরাদ্দ সে ক্ষেত্রে চলতি জিডিপির ১৪.৫৮ শতাংশ। আর্থিক বৃদ্ধির সরকার-জ্ঞাপিত হার, অর্থাৎ ৭ শতাংশ ধরে হিসাব কষলে দেখা যাবে, এক বছর আগে দেশের জিডিপি ছিল ৩০৫ লক্ষ কোটি টাকার আশেপাশে। সেই হিসাবে, গত বছর মোট জাতীয় উৎপাদনের ১৪.৭৪ শতাংশ ধরা হয়েছিল বাজেট বরাদ্দে। অর্থাৎ, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে বাজেট বরাদ্দ বাড়েনি, বরং কমেছে।
সংখ্যার ভোজবাজির একটি উদ্দেশ্য যদি হয় অর্থব্যবস্থার প্রকৃত ছবিকে গোপন করা, তবে অন্য উদ্দেশ্য নিখাদ রাজনৈতিক বা দলীয় প্রতিযোগিতা। আর্থিক উন্নয়ন থেকে দেশ চালনা, জনকল্যাণ থেকে সমরশাস্ত্র, সর্বত্রই ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’র ক্ষেত্র প্রতি দিন তৈরি হচ্ছে— “ওরা হয়তো করেছে, কিন্তু আমাদের মতো পারেনি।” দশ বছর পূর্ণ হল মোদী সরকারের। দু’টি মেয়াদের ইউপিএ সরকারের জমানায় জিডিপিতে বার্ষিক বৃদ্ধির গড় হার ছিল ৭.৮ শতাংশ; মোদী-পর্বের দশ বছরে তা ৬.৯ শতাংশ। অতএব কসরত শুরু হল— কী ভাবে আকবরের দীর্ঘ রেখাটিকে বীরবল হ্রস্ব করে দেখাতে পারেন।
এ বছর আর্থিক সমীক্ষার বদলে প্রকাশিত হল দি ইন্ডিয়ান ইকনমি: আ রিভিউ শিরোনামে একটি কৃশ পুস্তিকা। সেখানে “‘মোদের’ চোখে ‘ওদের’ ভারত” জাতীয় নানা বাক্যবন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে চোখে পড়ার মতো বিষয়টি রয়েছে মুখবন্ধের প্রথম পাতাতেই। সেখানে লেখা, “অনেক অর্থনীতিবিদ যথেষ্ট সঙ্গত কারণে মনে করেন যে, সব বৃদ্ধি নয় সমান।” পৃথিবীর সব দেশেই যখন প্রবল আর্থিক বিকাশ হচ্ছে, তখন ভারতের জিডিপির চড়া বৃদ্ধি ঘটা ততটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়, যতটা বিশ্ব জুড়ে ঝিমিয়ে থাকা অর্থনীতির মধ্যে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটার ঘটনা। ইশারাটি সহজবোধ্য— ‘ওদের’ ৭.৮ নয়, ‘আমাদের’ ৬.৯-ই আসলে বৃহত্তর সংখ্যা। এখানেই শেষ নয়, এক ধাপ এগিয়ে দাবি করা হচ্ছে যে, বৃদ্ধির হার কম হতে পারে, কিন্তু এই বৃদ্ধির প্রান্তিক উপযোগিতা অনেক বেশি— ২০১৪-২০২৩’এর দশকে অর্থনীতিতে যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে, তাতে জনগণের উপকার অনেকটা বেশি হয়েছে ২০০৪-২০১৩’র তুলনায়। দাবিটির সমর্থনে গবেষণাসঞ্জাত প্রমাণের উল্লেখ নেই। কিন্তু রাজনীতি আর কবেই বা গবেষণার ধার ধারে!
কৃতিত্ব দখলের এই খেলায় স্বভাবতই আর্থিক অসাম্য ও বেকারত্বের উল্লেখ নগণ্য। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক ও ষষ্ঠ পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য দেখিয়ে সরকার যতই দারিদ্র ও বেকারত্ব কমার দাবি করুক, তার সারবত্তা নেই। দারিদ্র, বেকারত্ব ও অসাম্য ওতপ্রোত আন্তঃসম্পর্কে জড়িয়ে থাকে। গরিব মানুষ কাজ না পেলে দারিদ্রের কবল থেকে মুক্তি পাবেন না, আর তাতে ধনীদের সঙ্গে তাঁদের আয় ও সম্পদের দূরত্ব ক্রমেই অনতিক্রম্য হবে। এই তিনটি সমস্যার কোনও একটিকে ছেড়ে দিলে গ্রন্থিমোচনের কোনও সম্ভাবনাই থাকে না। অথচ এই সত্যটি প্রতি বছর বাজেটে কার্যত অনুল্লিখিত থাকে।
দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই গ্রামে থাকেন। দারিদ্রও তাই প্রবল ভাবে গ্রামীণ। সমস্যার শিকড়ও সেই কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রের গভীরেই রয়েছে। বিষয়টি বুঝতে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে দেশের জাতীয় আয় ও শ্রমশক্তির কাঠামোগত বিন্যাসে। কৃষি, পণ্য উৎপাদন ও পরিষেবা, এই তিনটি হচ্ছে প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১৮.৪২ শতাংশ আসে কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে; পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে ২৮.২৫ শতাংশ; এবং পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে ৫৩.৩৩ শতাংশ। অথচ, কৃষি ও এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উৎপাদনে জড়িত রয়েছে মোট নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৪৩.৯৬ শতাংশ; শিল্পে ও পরিষেবাতে যথাক্রমে ২৫.৩৪ ও ৩০.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, যে ক্ষেত্রে আপেক্ষিক ভাবে উৎপাদন সবচেয়ে কম, শ্রমশক্তির বৃহত্তম অংশটি সেখানেই নিয়োজিত।
ধরা যাক, দেশে মোট জাতীয় উৎপাদন হচ্ছে ১০০ টাকা। আর মোট ১০০ জন মানুষ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। উপরের হিসাব অনুসারে, গ্রামীণ ক্ষেত্রে কাজ করছেন যে ৪৪ জন মানুষ, তাঁদের মোট আয় হচ্ছে ১৯ টাকারও কম। অথচ, পরিষেবা ক্ষেত্রে নিযুক্ত আছেন যে ৩১ জন, তাঁদের সম্মিলিত আয় হচ্ছে ৫৩ টাকার বেশি। অধুনা-উন্নত দেশগুলির ইতিহাস বলবে যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি স্থায়ী চিহ্ন হচ্ছে কৃষিক্ষেত্র থেকে ক্রমেই শ্রমশক্তির প্রব্রজন ঘটবে প্রাথমিক ভাবে পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে, ও পরবর্তী পর্যায়ে পরিষেবা ক্ষেত্রে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনেও ক্ষেত্রগুলির আপেক্ষিক অবদানে একই দিশায় পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু আমাদের দেশের বেলায় এই কাঠামোগত পরিবর্তনের গতি খুবই ধীর।
ভারত এখন পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, পাঁচ বছরের মধ্যেই তৃতীয় স্থান দখল করবে, এটি এখন সরকারের অতি গর্বের বিষয়। যদিও আমাদের থেকে এগিয়ে থাকা চারটি দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাম্প্রতিকতম হিসাব বলছে, কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে আমেরিকায় ১.৬৬, চিনে ২৪.১, জাপানে ৩.১৭ ও জার্মানিতে ১.২৫ শতাংশ শ্রমশক্তি নিয়োজিত। ২০১২ সালে চিনের মোট শ্রমশক্তির ৩৩.৫ শতাংশ কৃষি ও অন্যান্য উৎপাদনে জড়িয়ে ছিল। মাত্র নয় বছরেই প্রায় নয় শতাংশ-বিন্দু হ্রাস হয়েছে। পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাত্র ১.৫৯ শতাংশ শ্রমশক্তি কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে নিয়োজিত। অর্থাৎ, জাতীয় উৎপাদনে অবদান এবং শ্রমশক্তির বণ্টনের মধ্যে একটি সাযুজ্য ও ভারসাম্য থাকা চাই, যা ভারতে নেই। কারণ, কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত শ্রমিকরা শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংখ্যায় যেতে পারেন, তেমন সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে, কৃষিতে গড়পড়তা আয় কমছে। ক্রমেই অলাভজনক হচ্ছে চাষবাস। দুই দশক আগে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিল যে, অন্তত ৪০ শতাংশ কৃষিজীবী অন্য কোনও জুতসই কাজ পেলে তৎক্ষণাৎ কৃষিক্ষেত্র ছাড়তে চাইবেন। নেহাত যাওয়ার জায়গা নেই, তাই তাঁরা জোয়ালে জুতে আছেন। এত বছরেও অবস্থাটি পাল্টায়নি, দেনার দায়ে চাষিদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে শুধু।
বাজেট-বক্তৃতায় স্বভাবতই এ সব কথা থাকে না। সেটা আত্মপ্রচারের উপলক্ষমাত্র, আত্মসমীক্ষার তো নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy