বিক্ষুব্ধ: ইম্ফলে পথ অবরোধে মেইতেই মহিলারা। অগস্ট, ২০২৩। ছবি: পিটিআই।
মণিপুরের জাতি-সংঘর্ষ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে সংবাদপত্রে, টিভিতে, সমাজমাধ্যমে। পথে নেমে মিছিল হয়েছে। একটি নারী নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে মণিপুরের উপত্যকা-নিবাসী মেইতেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছে। পশ্চিমি সংবাদপত্রে এই সংঘর্ষকে খ্রিস্টানবিরোধী বলেও অভিহিত করা হয়েছে। তবে ভারতীয় প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলিতে এটি কুকি ও মেইতেইদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের দ্বন্দ্ব হিসাবেই বর্ণিত হয়েছে। সংঘর্ষ শুরুর আপাত-কারণ অবশ্যই ছিল মণিপুর উচ্চ আদালতের রায়ে মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি জনজাতি স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণা। এর প্রতিবাদে তফসিলি জনজাতি কুকিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, তাঁদের বিক্ষোভে মেইতেই সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ, মন্দির ধ্বংস ইত্যাদির পাল্টা শুরু হয় মেইতেইদের প্রতি-আক্রমণ, হত্যা, চার্চ ধ্বংস ইত্যাদি। ফল অন্তত ৭০ জনের মৃত্যু, ৫০ হাজার মানুষের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়।
এ সবের কারণ হিসাবে আলোচিত হয়েছে মেইতেই ও কুকিদের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব। সংখ্যাগুরু মেইতেইদের মণিপুরের মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে অধিকার, কিন্তু তফসিলি জনজাতি কুকিদের সমগ্র মণিপুরেই সেই অধিকার— দ্বন্দ্ব এখান থেকেই শুরু। মেইতেইরা জনজাতি-স্বীকৃতি পেলে কুকিদের ওই বিশেষ সুবিধা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা। এ ছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে আফিম চাষ ও আফিমের বেআইনি কারবারের বিপুল অর্থনৈতিক ও সন্ত্রাসী প্রভাবও আলোচিত হয়েছে। অনেক সংখ্যাতত্ত্ব এসেছে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সাফল্যের গতিও জানিয়েছে। ধর্মীয় মতামত এসেছে মিজ়োরাম প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ ও কেরলের সিরিয়ো-মালাবার ক্যাথলিক চার্চ থেকে, যারা বলেছে এটি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বলেছে এটি দু’টি জনজাতির গোষ্ঠী সংঘর্ষ, এতে ধর্মের কোনও ভূমিকা নেই।
মুশকিল হল, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব আলোচনায় আমরা বিপন্ন বোধ করি, যেন আধুনিক পৃথিবীতে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে শুধু পিছিয়ে-পড়া, অশিক্ষিত, দরিদ্র পাড়াতেই। অথচ একটু চোখকান খোলা রাখলেই দেখা যায়, আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞান-সংস্কৃতির ধাত্রীভূমি ব্রিটেনে খ্রিস্টধর্মের অন্তঃকলহে একশো বছর ধরে আয়ারল্যান্ড বিভক্ত দু’টি ভিন্ন রাষ্ট্রে। মাত্র কয়েক দশক আগেই ইউরোপীয় শিক্ষিত উন্নত সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যে ক’টি দেশ হল, তার অন্যতম কারণ ছিল ধর্মীয় দ্বন্দ্ব। রোমান ক্যাথলিক, ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ, ইসলাম এক সঙ্গে থাকতে চায়নি। এখনও তেমন দ্বন্দ্ব বিশ্বের অনেক জায়গায় অব্যাহত। সুতরাং ধর্মীয় পটভূমিও বিরোধের কারণ হতেই পারে, মেনে নেওয়া ভাল।
স্রেফ ভারতের জনগণনার তথ্য দেখলেই মণিপুর নিয়ে কিছু বিষয় বোঝা যায়। মণিপুরে ১৯৫১ সালে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ছিল ১১.৮ শতাংশ। ২০১১ সালে তা হয়েছে ৪১.৩ শতাংশ। ২০১১-তে মণিপুরের মেইতেই অধ্যুষিত উপত্যকা অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় ৬৮%, মুসলমান ১৪%, খ্রিস্টান ৪% ও বাকি অন্যরা। আবার মণিপুরের কুকি অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে খ্রিস্টানরাই ৯২%। অসম-ত্রিপুরা বাদ দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতি-বসবাসকারী বাকি প্রদেশগুলিতে ১৯৫১ সালে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ছিল ৩১%, সেটি বেড়ে ২০১১ সালে হয়েছে ৬৮.৪%। এই ব্যাপক ধর্মান্তরণের কাজটি হয়ে চলেছে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে।
এই ধর্মান্তরণের ব্যাপারে জওহরলাল নেহরুরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষাবিদ ভেরিয়ার এলউইনের অনুরোধে ভারত সরকার ১৯৫২ সালে নাগাল্যান্ডে হিন্দু সাধুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরণ নিষিদ্ধ হয়নি। ফলে আজকের নাগা, কুকি, মিজ়োদের মতো প্রকৃতি-উপাসক সম্প্রদায় নিজেদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, নিজস্ব উৎসব, নিজস্ব দেবদেবীদের ভুলে গেছেন অনেকটাই।
উত্তর-পূর্বের জনজাতিদের মধ্যে মেইতেইরা ছিলেন অগ্রসর জনগোষ্ঠী। তাঁদের আছে উন্নত ভাষা, লিপি, প্রাচীন শিল্প-সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনৃত্য মণিপুরি নৃত্যের কাছে ঋণী। বাকি জনজাতিদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন উপভাষা, কোনও ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। ১৮৯১ থেকে ১৯৩১-এর জনগণনা পর্যন্ত মেইতেইরা জনজাতি হিসাবেই স্বীকৃত ছিলেন। ১৯৫০ সালে মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি জনজাতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হল। আজকে মেইতেইরা সেই অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাইছেন।
খ্রিস্টীয় মিশনারিদের ধর্মান্তরণ সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধীর চিন্তাভাবনা ছিল খানিকটা অন্য রকম। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের এক গুরুত্বপূর্ণ খ্রিস্টীয় ধর্মপ্রচারক জন মট-এর সঙ্গে আলাপকালে মট গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আমরা কি মানুষের সেবায় রত হব না?” তখন গান্ধী বলেছিলেন, “অবশ্যই হবেন, কিন্তু তার মূল্য হিসাবে ধর্মান্তরণ করে নয়।” গান্ধী স্পষ্ট ভাবে অনেক বার বলেছেন যে ধর্মান্তরণ লোভ দেখিয়ে হয়, যা মানুষের নিজের বিশ্বাসকে অপমান করতে শেখায়। স্বাধীনতার সময়েই মিজ়োরামে খ্রিস্টান ধর্মান্তরণ সম্পূর্ণ হয়েছে, ১৯৫১-র জনগণনায় সেখানে ৯১% মানুষ খ্রিস্টান। উত্তর-পূর্বে এর প্রভাব পড়তে বেশি সময় নেয়নি। মিজ়ো নেতা লালডেঙ্গা মিশনারি-সমর্থিত মিজ়ো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বানিয়ে ভারত থেকে মিজ়োরামকে বিচ্ছিন্ন করতে ১৯৬৬ সালে আইজ়ল প্রায় দখল করে বসেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আইজ়লে ভারতীয় বায়ুসেনা ব্যবহার করে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনেন।
কুকিদের ইতিহাস ভারত ও মায়ানমার নিয়ে। মায়ানমার বৌদ্ধপ্রধান দেশ, তার সীমান্ত জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন জনজাতি, সেখানেও রয়েছে ধর্মান্তরণ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যা। মায়ানমারের প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে সীমান্তবাসী জনজাতিদের বিচ্ছিন্ন করতে একই শক্তি সক্রিয়। মায়ানমারের ধর্মান্তরিত কুকিরা ভারতে প্রবেশ করেছেন, মণিপুরের কুকি সম্প্রদায়ের ধর্মান্তরণ প্রায় সম্পূর্ণ। এ রকম অবস্থায় যে কোনও একটা বিতর্ককে সহিংস রূপ দেওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে কঠিন কাজ নয়। মেইতেইদের জনজাতি-স্বীকৃতি কুকিদের কাছে সমস্যা অবশ্যই, কিন্তু নব্য-ধর্মান্তরিত গোষ্ঠীর কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির বাহক মেইতেই সম্প্রদায়ের অস্তিত্বও কম আপত্তিজনক নয়।
নাগা, মিজ়ো, কুকিদের বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত সমাজও তাঁদের নিজস্ব ধর্ম চর্চা, বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্রের ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছিল শত শত বছর। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তা ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে আসছে। অন্য দিকে, উত্তর-পূর্বের এই অঞ্চলে মেইতেই সম্প্রদায় এখনও তাঁদের পুরনো ঐতিহ্য বহন করছেন। এখান থেকেই বুঝতে হবে আজকের জটিল সঙ্কটটিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy