‘জনমুখী’: জি২০ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ভারতমণ্ডপম, দিল্লি, ১০ সেপ্টেম্বর। পিটিআই।
ভারতীয় নির্বাচনে সাধারণত বিদেশনীতি নিয়ে কাটাছেঁড়া হয় না। শাসক দল তার নানা সাফল্য তুলে ধরে, বিরোধীরা আনেন ব্যর্থতার অভিযোগ, কিন্তু বিদেশনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি এই টানাপড়েনের বাইরে থাকে। তার প্রধান কারণ এবং ধারণা, বিদেশনীতি সাধারণ ভোটদাতার মাথাব্যথার বিষয় নয়, ওটা কিছু অভিজাত মানুষের চিন্তার বিষয়। আরও একটি কারণ রয়েছে। সাধারণত সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে বিদেশনীতি সম্পর্কে এক ধরনের ঐকমত্য থাকে। বহু দশক ধরে এই ধারা গড়ে উঠেছে যে, অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে তীব্র মতপার্থক্য থাকলেও, বিদেশনীতির ক্ষেত্রে একটা সহমতের ভূমি তৈরি হয়ে থাকে।
কিন্তু এখন তা যেন বদলে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রশাসনে বিদেশনীতিকে অভিজাত শ্রেণির বাইরে বার করে এনে জনসাধারণের বিষয় করে তোলা হয়েছে। যাঁরা সে বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না, তাঁদেরও তা নিয়ে কথাবার্তায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে কাবুল থেকে ফেরার পথে মোদীর আচম্বিতে লাহোরে থেমে, তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টাই হোক, বা ২০১৯ সালে বালাকোটে পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিমান থেকে বোমাবর্ষণই হোক, মোদী চেয়েছেন যাতে প্রতিটি পর্ব জনসাধারণের চোখের সামনে ঘটে। আরও সম্প্রতি জি২০ সম্মেলন উপলক্ষে তিনি সারা ভারতে যে ভাবে বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন, তা-ও এই পরিবর্তনের নিদর্শন।
এ বার নির্বাচনের আগে কর্মীদের সম্মেলনে মোদী যে ভাষণ দেন, সেখানেই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, বিদেশনীতিও আসবে নির্বাচনী প্রচারে। মুসলিম-বিরোধিতার যে অভিযোগে মোদীকে বার বার বিদ্ধ করা হয়, তার উত্তরে মোদী যুক্তি দেন, এই অভিযোগ যদি সত্য হত, তা হলে প্রায় সব ক’টা মুসলিম দেশ থেকে কি তাঁকে উচ্চতম অসামরিক সম্মান দেওয়া হত? ভারত কি তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, মজবুত সম্পর্ক তৈরি করতে সফল হত, যা কার্যত অভূতপূর্ব?
বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সম্ভবত মোদীর সরকার, এবং মোদীর নেতৃত্ব, অন্য সব ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি সাফল্য দাবি করতে পারে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে বেশ কিছু এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যা একে সম্ভব করেছে। অবশ্য তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় মোদীর একটা বড় সুবিধে ছিল সংসদে তাঁর তর্কাতীত সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আগের প্রধানমন্ত্রীদের অনেকেই জোটসঙ্গীদের সামলাতে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। মোদী নিজের পছন্দ অনুসারে নীতি নির্বাচনের, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, দলের ভিতরে বা বাইরে তাঁকে প্রশ্ন করার কেউ ছিল না। ইন্দিরা গান্ধীর পরে মোদী সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, প্রতিদ্বন্দ্বী-হীন প্রধানমন্ত্রী। এর সুযোগে মোদী বেশ কিছু অপ্রত্যাশিত, ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। যেমন, বিদেশ সচিবের পদ থেকে সুজাতা সিংহকে এক কথায় বাদ দিয়ে মোদী এনেছিলেন এস জয়শঙ্করকে। অবসরের আট মাস বাকি থাকতেই কর্মজীবনে ছেদ পড়ে সুজাতার। এর পর মোদী তাঁর দ্বিতীয় শাসনকালে জয়শঙ্করকে বিদেশমন্ত্রী করে নিয়ে আসেন। মোদীর অপরিসীম কর্মক্ষমতা এবং আত্মপ্রত্যয়ের জন্য বিশ্বের এমন কিছু দেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক স্থাপন করা যায়, যেগুলির সঙ্গে আগে ভারতের তেমন লেনদেন ছিল না। রাজনৈতিক নেতা থেকে বড় বড় কোম্পানির কর্ণধার, মোদী নানা ক্ষেত্রের মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদানে উৎসাহী এবং স্বচ্ছন্দ।
এগুলো যেমন ভারতকে অন্য অনেক দেশের কাছে এনেছে, অন্য দিকে আবার অন্যান্য দেশ ভারতের দিকে ঝুঁকেছে চিনের উত্থানের জন্য। চিন যত বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, ততই উদ্বেগ ছড়িয়েছে। আশপাশের দেশ তো বটেই, আরও দূরের দেশগুলিও বেজিং-এর সঙ্গে টক্কর দিতে পারে এমন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছে। তাতে সুবিধে হয়েছে ভারতের।
ভারতের সীমান্তে চিনের আগ্রাসী চাপ নিয়ে মোদীকে সমালোচনা করেছেন অনেকে। মোদী কিন্তু দু’দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের দিকে গিয়ে সংঘাত বাড়ানোর বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছেন। সীমান্তে প্রচুর সেনা বহাল করেছেন। নির্বাচন শেষ হলে সম্ভবত চিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা শুরু করবে ভারত।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে যে সব শঙ্কা দেখা গিয়েছিল, সেগুলিকে অনেকটাই মিথ্যা প্রমাণিত করে মোদী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেছেন, আবার আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও মজবুত করেছেন। ইউরোপের প্রধান দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন যথেষ্ট ভাল। আফ্রিকার দেশগুলির সঙ্গেও নিয়মিত সফর ও কথাবার্তার মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। কোভিড অতিমারির পরে বহু দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশের কাছে ভারতের নেতৃত্বের ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু মোদীর নিজের দৃশ্যমানতা, এবং তার সঙ্গে ভারতের গুরুত্ব বাড়ার পাশাপাশি, ভারতের দুর্বলতাগুলিও স্পষ্ট হয়েছে বিশ্বের কাছে। বিশেষ করে দু’টি ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে। প্রথমটি হল নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ঔদ্ধত্য, যার ফলে তারা ভারতের সীমার বাইরে গিয়ে ভারত-বিরোধী ব্যক্তি ও তাদের সমর্থকদের হত্যা করার চেষ্টা করছে। এর ফলে ইতিমধ্যেই ভারতকে যথেষ্ট বিব্রত হতে হয়েছে— কানাডা-ভারত সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল বেশ কিছু দিন। স্বাধীন খলিস্তানের প্রবক্তা গুরুপতবন্ত সিংহ পন্নুন, ভারত যাঁকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিযুক্ত করেছে, তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েও আমেরিকার সঙ্গে টানাপড়েন চলেছে, কারণ পন্নুন এখন আমেরিকার নাগরিক। এখনই ভারতের এই প্রবৃত্তিকে রুখতে না পারলে দেশের স্বার্থের বড়সড় ক্ষতি হতে পারে।
দ্বিতীয়টি অবশ্যই শাসক দলের হিন্দুত্ববাদের প্রচার, যা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের দেশে, এবং সেগুলির রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। নতুন সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে, যেখানে বেশ কয়েকটি পড়শি দেশকে ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেই রকম, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে আগতদের সম্পর্কে অপশব্দের ব্যবহার, সিএএ পাশ করা, বিজেপির শীর্ষ নেতাদের মুসলিম-বিরোধী নানা মন্তব্য, এ সবই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিপদে ফেলেছে। ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হবে, গণতন্ত্র থাকবে না বা নামমাত্র থাকবে, এই চিন্তা দেখা দিয়েছে। যে সব পড়শি দেশ দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করতে চায়, তাদের কাছে হিন্দুত্বের রাজনীতি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারতের মধ্যে হিন্দুত্বের প্রভাব, এবং প্রতিবেশী দেশগুলিকে কোনও এক কল্পিত হিন্দু রাজত্বের অংশ বলে তুলে ধরার চেষ্টাতেও রাশ টানতে হবে। তার জন্য যে সংবেদনশীলতা প্রয়োজন, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মন্ত্রিসভা তাতে সমর্থ কি না, সে প্রশ্ন নিয়েই এনডিএ সরকারের দ্বিতীয় দফা শেষ হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy