স্বপ্নময়: কংগ্রেস অধিবেশনের মণ্ডপে জাতীয় পতাকা তুলছেন জওহরলাল নেহরু, ১৯৩৭। —ফাইল চিত্র।
কেমব্রিজ থেকে ১৯২১ সালের ২ মার্চ তারিখের চিঠিতে সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে: “স্বরাজের ভিত্তির উপর আমাদের এখন ভারতের Constitution তৈয়ারী করিতে হইবে।” আইসিএস থেকে ইস্তফার দেড় মাস আগেই লেখা এই বাংলা চিঠিতে ‘কনস্টিটিউশন’ শব্দটি ইংরেজি অক্ষরে। তরুণ সুভাষচন্দ্র খেদ প্রকাশ করেছিলেন যে, কনস্টিটিউশন সম্বন্ধে কংগ্রেসের কোনও বিশিষ্ট পলিসি নেই।
ইংরেজদের প্রণীত কনস্টিটিউশন বা শাসনতন্ত্রের স্বরাজীরা ছিলেন ঘোর বিরোধী। ১৯১৯-এর ভারত সরকার আইন অনুসারে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ছিল ইংরেজদের হস্তগত আর রাজ্য স্তরে ডায়ার্কি প্রথা অবলম্বনে গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলি রক্ষিত ছিল ইংরেজদেরই হাতে। দেশবন্ধু এই তথাকথিত মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কারের দ্বিচারিতা প্রকাশ করে তা ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। একই সঙ্গে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রীয়তা-বাদ মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বরাজীরা ১৯২৩ সালে তাঁদের কনস্টিটিউশন বা সংবিধানের রূপরেখা জনসমক্ষে নিয়ে আসেন।
এই স্বরাজ সংবিধানে স্থানীয় স্বশাসনের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা পরামর্শদান ও সমন্বয়ের কাজে সীমিত থাকবে, রাজ্য থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিকেন্দ্রিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ হবে ন্যূনতম। সেই একই বছর দেশবন্ধু বাংলায় সুষম ক্ষমতা বণ্টনের লক্ষ্যে একটি হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট বা চুক্তি ঘোষণা করেন। বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকে এই রকম বেশ কিছু উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংবিধানের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রায় প্রত্যেকটিরই মূল মন্ত্র এই যে, ভারতের ঐক্য কেবলমাত্র ফেডারালিজ়ম বা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তার সঙ্গে প্রয়োজন বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সুষ্ঠু বোঝাপড়া।
১৯৩০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ২৬ জানুয়ারি আমাদের দেশের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালিত হয়েছে। লাহোরে ইরাবতী নদীর তীরে পূর্ণ স্বরাজের প্রতিজ্ঞাবাক্য পাঠ করে সেই রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। অন্য দিকে, ১৯৩৫-এর ভারত সরকার আইন ঘোষণার মাধ্যমে ইংরেজদের নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করা হল। কেন্দ্রে নিজেদের কাছে আসল ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে প্রদেশগুলিতে ভারতীয়দের হাতে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হল। সে ক্ষেত্রেও ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের ৯৩ ধারা অনুযায়ী প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার অধিকার রইল ব্রিটিশ বড়লাটের হাতে। এ ছাড়াও এই শাসনতন্ত্রে নিহিত ছিল ভবিষ্যতে পাঁচশোরও বেশি রাজা-রাজড়াদের সঙ্গে একটি মেকি ফেডারেশনের প্রস্তাব। এই অগণতান্ত্রিক, পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলি জিন্না প্রমুখ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯৩৯-এর ডিসেম্বর মাসে ‘সাম্রাজ্যবাদী সরকারের ছত্রছায়ায় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’-র যে প্রস্তাব কংগ্রেস দিয়েছিল, লয়েড জর্জের আইরিশ কনভেনশনের সঙ্গে তার তুলনা টেনে সুভাষচন্দ্র দেশবাসীকে সতর্কবাণী শোনালেন। তিনি মনে করিয়ে দিলেন কী ভাবে সিন ফেন সেই আইরিশ কনভেনশন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলশেভিকরা ১৯১৭ সালে রাশিয়ার কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে, সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পরই জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে সত্যিকারের কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠন করা সম্ভব।
এ দেশের ট্র্যাজেডি যে, ইংরেজরা ভারত ছাড়ার সময়ে আমাদের শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে গৃহীত হয়নি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মেনে নিয়ে তাঁরা তখন ইংরেজদের কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে ব্যস্ত। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দেশপ্রেমিকদের ফেডারালবাদ সে দিন পরাস্ত।
১৯৪৬ সালে বাংলা থেকে শরৎচন্দ্র বসু কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে, ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস দেশভাগ মেনে নেওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। নেতাজির অল্প কয়েক জন অনুগামী এই সংবিধানসভার সদস্য ছিলেন। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন প্রকৃত গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে সওয়াল করতে। তাঁদের আনা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমস্ত সংশোধনী গ্রহণ করা হয়নি। কে টি শাহ-কে সুভাষচন্দ্র ত্রিশ দশকের শেষে ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। এই কে টি শাহ ১৫ নভেম্বর ১৯৪৮-এ একটি সংশোধনী আনেন, যাতে সংবিধানের এক নম্বর আর্টিকল-এ ঘোষণা করা হয়: ‘ইন্ডিয়া শ্যাল বি আ সেকুলার, ফেডারাল, সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন অব স্টেটস’। মুক্তি সংগ্রামের আদর্শ সম্বলিত এই সংশোধনী নাকচ হয়ে যায়। শাহ আরও চেয়েছিলেন রাজ্যের অনুমতি ছাড়া কেন্দ্র কোনও রাজ্যের নাম বা সীমানা পাল্টাতে পারবে না। তিনি প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের প্রার্থী হয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
নেতাজির আর এক সহকর্মী হরিবিষ্ণু কামাথ প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বার্থে সংবিধানের জরুরি অবস্থা ঘোষণা বিষয়ক ধারা ও বিশেষত হেবিয়াস করপাস-এর অধিকার রাষ্ট্রের খর্ব করার ক্ষমতার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর প্রতিবাদ ধোপে টেকেনি। আম্বেডকর স্বীকার করেছিলেন যে, এই ধারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুর্ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তাঁর আশা তা হবে না এবং এটি থেকে যাবে ‘ডেড লেটার’ হিসাবে। ১৯৫০-এর জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র বসু সংবিধানের ইমার্জেন্সি সম্পর্কিত বক্তব্যের সঙ্গে ১৯৩৫-এর ভারত সরকার আইনের সাদৃশ্য লক্ষ করেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এ হল একটি ‘টাইম বোমা’ যা কোনও না কোনও দিন ব্যবহার হবে।
১৯৫০-এর সংবিধানের প্রাক্-কথনের শব্দগুলি খুবই সুন্দর, যা এখনও অনেককে অনুপ্রেরণা জোগায়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, সংবিধানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ধারা ১৯৩৫-এর ভারত সরকার আইন থেকে টোকা। যে কোনও আধিপত্যবাদী সরকার এগুলির অপব্যবহার করতে পারে। জরুরি অবস্থার সময় সরকারের হেবিয়াস করপাস মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ সাংবিধানিক তকমা দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ জনের মধ্যে চার জন বিচারক। খুব সম্প্রতি কাশ্মীর বিষয়ক মামলায় রায় দিতে গিয়ে চিফ জাস্টিস-সহ পাঁচ জন বিচারকের বেঞ্চ জানিয়েছে যে, কোনও রাজ্যের নাম, ঠিকানা, সীমানা বদলে দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রাষ্ট্রপতির রয়েছে, অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ক্যাবিনেটের পরামর্শ অনুসারে।
বর্তমানে পরিস্থিতি ক্রমশই কঠিন হচ্ছে, কেননা এক দিকে তথাকথিত লিবারাল লেখকবর্গ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রারম্ভিক মুহূর্ত সম্বন্ধে নানা রূপকথা শুনিয়ে আসছেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম কয়েক দশকে ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের রমরমা তাঁদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। আর অন্য দিকে, সংবিধানের প্রাক্-কথনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের সঙ্কল্প রূপায়ণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ২০২৪-এর নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে তাঁর এই দৃঢ় সঙ্কল্প সিদ্ধিলাভ করবে। অনেকে মনে করছেন, ভারতে এখন দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শুভলগ্ন। কেউ কেউ, যেমন বিবেক দেবরায়, দাবি করছেন যে, নতুন ভারতের প্রয়োজন একটি নতুন সংবিধান। আসল কথাটা হল, নতুন সংবিধান না হলেও, পুরনো সংবিধান দিয়ে এই আবেগমথিত সংখ্যাগুরুবাদের জয়যাত্রা ঠেকানো যাবে কি? সম্ভবত নয়। এমন একটি ঔপনিবেশিক সংবিধান এই অবস্থায় সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে কতটা রক্ষাকবচ হতে পারে তাতে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
তা হলে কি ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদ-ভিত্তিক দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অবধারিত? এই পন্থার প্রবক্তরা দেশের আইন-সংবিধান ‘ডিকলোনাইজ়’ বা উপনিবেশবাদ মুক্ত করার কথা বললেও আসলে তাঁরা চান ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সংস্কৃতি-ঘেঁষা হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করে নতুন যুগে অমৃতকালে আধিপত্যবাদ বজায় রাখতে। অতএব এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে চাই একটি নৈতিক মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ।
প্রকৃত গণতন্ত্রের লক্ষ্যে এই চ্যালেঞ্জ রূপায়িত হতে পারে আমাদের দেশের সুদীর্ঘ এবং জোরালো উপনিবেশবাদ-বিরোধী সাংবিধানিকতার ইতিহাসের উপর ভর করে। দেশবন্ধু, নেতাজি ও ভারতের মুক্তি সংগ্রামে তাঁদের বহু সঙ্গী এই পথ আলোকিত করেছিলেন। সাম্যবাদ ও ফেডারালবাদের স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত ঐক্যবদ্ধ ভারতের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র তৈরি এখনও সম্ভব। সে দিনই আমরা অর্জন করব সত্যিকারের স্বরাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy