Advertisement
২০ জানুয়ারি ২০২৫
সত্যজিতের কল্পনায় বর্তমানের পরিসরে ঢুকে পড়তে থাকে অতীত
History

যে ইতিহাস মোছা যায় না

‘লখ্‌নৌর ডুয়েল’ গল্পে তারিণীখুড়ো জানান, তিনি আড়াল থেকে প্রত্যক্ষ করছেন দুই মৃত প্রেমিক-প্রতিদ্বন্দ্বীর বিখ্যাত এবং ভয়াবহ পরিণতির ডুয়েল।

মৌ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২২ ০৪:৪২
Share: Save:

রেভন্যান্ট’ শব্দটির উৎস ফরাসি ‘রেভনির’—যার অর্থ ‘প্রত্যাবর্তন’, এবং ‘মৃত্যু বা দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর কোনও কিছুর ফিরে আসা’, দুই-ই হতে পারে। অবশ্য শব্দটির আরও এক গভীরতর দ্যোতনা সম্ভব: বর্তমানের প্রেক্ষিতে অতীতের অনধিকার-প্রবেশ, যা সমসময়কে করে তুলতে পারে অচেনা। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র, বিশেষত শতরঞ্জ কে খিলাড়ি (ছবিতে একটি দৃশ্য), এই হারানো সম্ভাবনার বোধটিকেই বার বার পর্দায় প্রকাশ করে— অতীতের কোনও কাহিনি, যা অন্তের স্বাভাবিক কথনকাঠামোকে পরিপূর্ণতা দেয় না, বরং তাকে করে তোলে আরও অস্বস্তিকর।

সত্যজিতের অতীত-আগ্রহের শিকড় ভারতেই প্রোথিত। তিনি দু’টি স্থান নিয়ে বিশেষ আগ্রহী: লখনউ ও কলকাতা। ভারত-ইতিহাসের এই বিন্দুগুলি থেকেই জন্ম নেয় তাঁর ভৌতিক গল্পগুলির কাহিনি এবং ভঙ্গি নিয়ে বিবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা— বিশেষ করে সেই সব গল্পে, যেখানে অতীত থেকে কোনও অলৌকিক শক্তি হানা দেয় সমসময়ের মঞ্চে। সত্যজিৎ তাঁর নিজের জীবনে ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান এবং উত্তর-উপনিবেশ কালে ভারতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রের আগমন, দুই-ই দেখেছেন। লখনউ, যে শহরকে তিনি ছোটবেলা থেকে দেখেছেন বহু বার; এবং কলকাতা, যে শহর তাঁর বৌদ্ধিক এবং মানসিক আশ্রয়— হয়ে উঠেছে সেই সব অতীতচারণের আদর্শ প্রেক্ষাপট।

ঐতিহাসিক নিদর্শনের লখনউ, বিশেষত ইমামবাড়া, দ্য রেসিডেন্সি, ভুলভুলাইয়া সত্যজিতের স্মৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর সৃষ্টিতে দেখা যায় অওয়ধি এবং মোগল উচ্চবংশীয় ব্যক্তি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেব ও মেমসাহেব, এবং বুদ্ধিদীপ্ত বাঙালি ভদ্রলোক, যাঁরা সকলেই জীবিত এবং মৃত, অতীত এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযোগস্থাপনে গভীর আগ্রহী। তাঁর প্রতিটি ভৌতিক গল্পে, বিশেষ করে তারিণীখুড়ো সিরিজ়-এ, দেখতে পাই ঐতিহাসিক সত্যকে সামনে এনে অতীত ও সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

সত্যজিতের তারিণীখুড়ো সিরিজ়ের ছোটগল্প ‘লখ্‌নৌর ডুয়েল’ এবং ফেলুদা-কাহিনি বাদশাহী আংটি-র কথা ধরা যাক। দু’টি কাহিনিতেই প্রাচীন এবং আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি স্থান আছড়ে পড়ে তার সামূহিক ঐতিহাসিক অধিবাস্তবতা নিয়ে। অতীত অস্বীকার করে প্রচ্ছন্ন থাকতে। সে বর্তমানের ঐতিহ্যে প্রবেশ করে এবং তছনছ করে দেয় সময়-সংক্রান্ত ধ্যানধারণাগুলি। সত্যজিতের কল্পনায় এবং তার প্রকাশে প্রতিটি অধিবাস্তব ঘটনা আসলে অন্য এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার দ্যোতক, যেখানে অতীত সুপ্ত হয়ে আছে সমসময়ের অদৃশ্য স্তরে-স্তরে— হিংসা, প্রেম এবং বিচ্ছেদের আড়ালে।

‘লখ্‌নৌর ডুয়েল’ গল্পে তারিণীখুড়ো জানান, তিনি আড়াল থেকে প্রত্যক্ষ করছেন দুই মৃত প্রেমিক-প্রতিদ্বন্দ্বীর বিখ্যাত এবং ভয়াবহ পরিণতির ডুয়েল। কাহিনির প্রেক্ষাপট উনিশ শতকের লখনউ— ব্রিটিশ ছত্রছায়ায় থাকা লখনউ, তবু ইন্দো-ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে, নবাবি মানমর্যাদায়, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সামাজিক চালচলনে উদ্দীপ্ত প্রাণবন্ত এক শহর। ডুয়েল লড়ার সেই অতীত ঠিক ১৫০ বছর পর তার দীর্ঘ ছায়া ফেলে যায় ১৯৫০-এর স্বাধীন ভারতে। অতীতের স্পর্শগ্রাহ্যতা দেখানো হয়েছে ‘জগদ্বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতকারক জোসেফ ম্যানটনের ছাপমারা এক জোড়া ডুয়েলিং পিস্তল’-এর মাধ্যমে, যা তিনি কিনেছিলেন লখনউয়ের হজরতগঞ্জের একটি নিলামের দোকান থেকে। সেই সন্ধ্যাতেই তারিণীখুড়োর কাছে এক ভদ্রলোক আসেন, এবং জানান যে, প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর, অর্থাৎ প্রথম যে দিন এই পিস্তল দু’টি ব্যবহার করা হয়েছিল, ঘটনাটি ভোর ছ’টার সময় পুনরভিনীত হয় দিলখুশা প্রাসাদের পশ্চিমে গোমতী নদীর কাছে এক মাঠে।

নির্দিষ্ট দিনে তারিণীখুড়ো প্রত্যক্ষ করেন সুন্দরী অ্যানাবেলা হাডসনের দুই প্রেমিকের— বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন চার্লস ব্রুস এবং চিত্রকর জন ইলিংওয়ার্থ— ডুয়েল; দু’জনেই মারা যান পিস্তলের গুলিতে। ঘটনার পর পরই তারিণীখুড়ো বুঝতে পারেন একটি তৃতীয় গুলির উপস্থিতি, যেটি চালিয়েছেন আড়ালে থাকা অ্যানাবেলা এবং সেই গুলিতেই মৃত্যু হয় চার্লস ব্রুসের। ব্রুস বা ইলিংওয়ার্থ, কাউকেই ভালবাসতেন না অ্যানাবেলা, তাঁর প্রেমিক ইলিংওয়ার্থ-এর বন্ধু এবং সেই ডুয়েলের সেকেন্ড, হিউ ড্রামন্ড। সেই ব্যক্তি, যিনি তারিণীখুড়োর কাছে এসেছিলেন পিস্তল পরীক্ষা করতে, তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন অ্যানাবেলা এবং তাঁর সম্পর্কটি বিস্মৃত অতীত থেকে আলোয় আনার জন্য। হিউ ড্রামন্ড— রেভন্যান্ট, ভূত।

অ্যানাবেলার এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই লিপ্ত হয়ে আছে আর এক ইতিহাস, আরও অনেক বেশি হইচই ফেলে দেওয়া এক ডুয়েল— ঔপনিবেশিক কলকাতায় ওয়ারেন হেস্টিংস এবং ফিলিপ ফ্রান্সিস-এর মধ্যে। কলকাতার ব্রিটিশ নাগরিকসমাজের এক সুন্দরী ম্যাডাম গ্র্যান্ড-এর সঙ্গে ফ্রান্সিসের অবৈধ সম্পর্কই এর সূত্রপাত। ‘কেচ্ছা’টি কলকাতায় তুমুল হইচই ফেলে দেয়, কারণ ১৭৭৯ সালের এক দিন ফ্রান্সিসকে দেখা গিয়েছিল বিবাহিতা গ্র্যান্ডের জানলা বেয়ে উঠতে। এই কাণ্ডের পর ফ্রান্সিসকে হাজির করা হয় ক্যালকাটা সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস স্যর এলাইজ়া ইম্পে-র সামনে, ‘ক্রিমিনাল কনভার্সেশন’-এর অভিযোগে। জরিমানা হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। বিবাহিতা ম্যাডাম গ্র্যান্ড কলকাতা ছেড়ে প্যারিসে চলে যান, সেখানে নেপোলিয়ন-এর বিদেশমন্ত্রী তায়েরঁ-র প্রথমে রক্ষিতা এবং পরে স্ত্রী পরিচয় পান। গভর্নর জেনারেল’স কাউন্সিল-এর সদস্য হিসেবে ফ্রান্সিসের কাণ্ডকারখানায় যথেষ্টই বিরক্ত হচ্ছিলেন হেস্টিংস। তিনি ফ্রান্সিসের ব্যবহারকে ‘ট্রুথ অ্যান্ড অনার’ বহির্ভূত হিসেবে চিহ্নিত করেন, যার ফল ১৭৮১-র ১৭ অগস্টের ডুয়েল। ফ্রান্সিস আহত হন এবং পরে কলকাতা ছেড়ে চলে যান।

কলকাতার ইতিহাসের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সেখানে শ্রীমতী গ্র্যান্ডের ভূমিকাহীনতা ‘লখ্‌নৌর ডুয়েল’-এ অ্যানাবেলার কীর্তিকলাপকে আরও তীক্ষ্ণ ভাবে আমাদের কাছে উপস্থিত করে। অ্যানাবেলা তারিণীখুড়োর গল্পে দ্বিতীয় রেভন্যান্ট-এর মতো ফিরে আসেন, এবং তাঁর ভূমিকাটি এক নারীর হাতে ভারতীয় ইতিহাসের একটি ঘটনা অন্য আলোয় প্রতিবিম্বিত হওয়ার নিদর্শন। ডুয়েলিং পিস্তল দু’টির উপস্থিতি অতীতের ফিরে আসা এবং সমসময়কে বিপর্যস্ত করার স্পর্শগ্রাহ্য যোগসূত্র। হিংসা এবং অতীতের মুছে-যাওয়া অক্ষরের জন্য প্রয়োজন তার পুনর্নির্মাণ— ইতিহাসবিদের ভূমিকায় সে-কাজ সাহিত্যিকের, যিনি বলবেন বিপথগামী চরিত্রদের কথা, ভাষা দেবেন তাঁদের। অ্যানাবেলার নিজের জীবন নিজেরই সাজিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি পুরুষের হাতে লেখা ইতিহাসকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করে তারিণীখুড়ো এবং পাঠকের ইতিহাসচেতনার সামনে। সুচারু, উদাসীন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নারী, তাঁদের বলরুম আর আভ্যন্তরিক জীবনযাপনের এক প্রতিদ্বন্দ্বী যেন অ্যানাবেলা, যিনি ঔপনিবেশিক ভারতের পারিবারিক এবং বৈবাহিক হিংসা রিরংসার ঐতিহাসিক ন্যারেটিভটিকে পর্দার আড়াল থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। তাঁর ভূত (এবং এরই সঙ্গে যুক্ত মাদাম তায়েরঁ-র প্রচ্ছায়া) ফিরে এসে জানিয়ে দিয়ে যায়, যে-ইতিহাস তিনি নির্মাণ করেছেন, তাকে মুছে ফেলা যাবে না।

সত্যজিৎ রায়ের বাদশাহী আংটি উপন্যাসেও ফিরে আসে দিলখুশা প্রাসাদ— বনবিহারী সরকার ফেলুদা আর তোপসেকে ১৮৫৭-র সংঘাতের কথা শোনান। এই সময়েই এক অজ্ঞাত ব্যক্তি ফেলুদাকে লক্ষ করে পাথর ছুড়তে থাকে। ঐতিহাসিক হিংস্রতার এক প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয় বর্তমান সময়ের সংঘাতের মঞ্চ, যেখানে ফেলুদা আহত হওয়া থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায়। এখানে অবশ্যই স্পর্শগ্রাহ্য অনুঘটকটি ঔরঙ্গজেবের আংটি। ন্যারেটিভ জুড়ে আসতে থাকে একাধিক অতীত— আংটির শরীরে বিদ্যমান মোগল সাম্রাজ্যের অতীত, লখনউয়ের স্থানিক অওয়ধ-অতীত, প্রাসাদ আর ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধায় ১৮৫৭-র ইতিহাস, এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অতীতের সূত্র ধরে কয়েক জন নাগরিকের সংযোগ। অতীত ঐতিহ্যের দখলদারি জন্ম দেয়, উন্মুক্ত করে দেয় সমসময়ের হিংসাত্মক ঘটনাবলি। ঠান্ডা মাথায় অতীত এবং বর্তমান থেকে সূত্র জুড়ে-জুড়ে, সব জট ছাড়িয়ে ন্যায়বিচারের কাজটি করেন এক তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালি গোয়েন্দা, যিনি নিজে সত্যজিতেরই প্রতিবিম্বপ্রায়।

ইতিহাসবিদরা মানেন যে, প্রচলিত সংরক্ষণব্যবস্থার যা পরিসর, তা হারিয়ে যাওয়া এবং মুছে যাওয়া ঐতিহাসিক সত্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে এক বড় বাধা। ‘যা হতে পারত’-র কোনও ইতিহাসভিত্তিক পুনর্নির্মাণ প্রায়শই সম্ভব হয় না। অসম্পূর্ণ সংরক্ষণ আসলে জীবন-জগতের একটা অংশকেও হারিয়ে ফেলা, যা এই বিস্মৃতি-সন্ধানের প্রতি ইতিবাচক মনোযোগও ব্যাহত করে। ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাস বুঝি এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসার এক দৃষ্টিভঙ্গি— অতীতের নৈতিক পুনর্গঠন, কালানুক্রম মেনে ঘটনা, ব্যক্তি এবং বস্তুর বিন্যাসের প্রতি মনোযোগ দিয়ে ন্যারেটিভের যুক্তিগ্রাহ্য কাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে। অধিবাস্তব কাহিনি বা গোয়েন্দাগল্পের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায়ের অতীতনির্মাণ তারই উদাহরণ।

অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত দৈহিক আর সামাজিক মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে ভূত, নিশ্চিন্ত বর্তমানের উপর আছড়ে পড়ে তাদের ক্ষোভ, ভেঙেচুরে দেয় সমসময়ের নকশাগুলি। রেভন্যান্ট— অতীতের প্রতিনিধি— চায় সমসময়ও তাকে চিহ্নিত করুক, যার মাধ্যমে ইতিহাস প্রতিভাত হতে পারে তার সমগ্রতায়। অতীত এবং বর্তমানের সমানুভূতিক পরিসরেই তো ইতিহাসের ভাষা পেতে পারে একই স্থানিক ও সাময়িক পরিচয়। সত্যজিতের ভৌতিক গল্পগুলি আসলে অতীতের হিংসাকে মুছে দিয়ে এক নৈতিক পৃথিবী নির্মাণের প্রয়াস।

ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, ম্যাডিসন

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

History Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy