প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কয়েক মাস আগেও গল্পটা অন্য রকম ছিল। সবেমাত্র অলিম্পিক্স-এ পদক জয় করেছেন মীরাবাই চানু, লভলিনা বরগোঁহাইরা। তাঁদের বিশেষ ভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশের সকল পদাধিকারী। রাজনীতি-সমাজ-প্রতিবাদের চড়াইতে ওঠামাত্রই এই ছবির মুখ হয়ে গেল অন্য রকম। দিল্লির যন্তর মন্তর থেকে পদকজয়ী খেলোয়াড়দের লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে দেখল দেশ।
আমরা সবাই প্রায় নীরবে দেখলাম সব কিছু। প্রায় নীরবে। প্রতিবাদের স্বর রইল অস্ফুট। তবে শুধুমাত্র এই মেনে নেওয়াই কি পদক জয়ী খেলোয়াড়দের ছবির সবটুকু বলতে পারল? এর মধ্যে কি লুকিয়ে নেই আরও কোনও অসম্মানের কথা?
“আমি কিন্তু পঁচিশ কিলোমিটার ম্যারাথনে হাঁটব ম্যাডাম। হাঁটব, জিতবও।” মেয়েটি জেলার মেয়ে, কলকাতার নামকরা মেয়েদের কলেজে অঙ্ক অনার্সের ছাত্রী। কলকাতা পুলিশ আয়োজিত ম্যারাথনে ছাত্রীদের যোগদান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সহায়তা করছেন কলকাতা পুলিশের অফিসাররা। ভোরবেলায় মেয়েরা যাতে নিরাপদে যেতে পারে যাতায়াতের ব্যবস্থা করছেন উচ্চপদস্থ অফিসাররা নিজে। কলেজে এসে ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপিকাদের সঙ্গে কথা বলছেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার আশ্বাস দিচ্ছেন।
ছাত্রীদের মধ্যে উৎসাহ তুঙ্গে। ৫, ১০ ও ২৫ কিলোমিটার, ম্যারাথনের দূরত্বের ভাগ। অধিকাংশ ছাত্রী ৫ অথবা ১০ কিলোমিটারেই নাম লিখিয়েছে। ২৫ কিলোমিটারে নাম লিখিয়েছে শুধু এই মেয়েটি। “তুমি এত দূর হাঁটতে পারবে? ২৫ কিলোমিটার মানে কিন্তু ম্যারাথনের শুরুর জায়গা অর্থাৎ রেড রোড থেকে শুরু করে মা ফ্লাইওভার এজিসি বোস ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ঘুরে আবার পুরোটা ফিরে আসা— এতটা পারবে, এই গরমে?”
“আমি রোজ ১২ কিলোমিটার হাঁটি ম্যাডাম, কোনও অসুবিধেই হবে না।”
ম্যারাথন শেষ করতে পারে সব ক’টি মেয়েই, অঙ্কের মেয়েটিও। তার ম্যারাথনের সময় ছিল সব থেকে আগে, ভোর চারটেয়। পুলিশকাকু গাড়ি করে এসে, বিশেষ নিরাপত্তার সঙ্গে নিয়ে গেলেন, ম্যারাথনের পুরো রাস্তা ধরেই রইল ডাক্তার ও গ্লুকোজ়ের ব্যবস্থা।
যে আত্মবিশ্বাস আনন্দের সঙ্গে শেষ হল তাদের ম্যারাথন, অনেকখানি স্মৃতি থেকে গেল সম্ভবত তাদের সঙ্গে। কলেজের সিঁড়িতে, বা করিডরে তাদের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র, এক গাল হাসি তাদের মুখে। তারা যখন রোজের নিয়মে আসে, পড়াশোনা করে, পরীক্ষা দেয়, সদ্য শেষ হওয়া প্রোজেক্ট নিয়ে ছোটাছুটি করে, তখন তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই, খেলার মাঠে দৌড়ানোর সময় তাদের পিঠে কী রকম পরীর পাখা এসে যোগ হয়।
প্রশাসনিক সমর্থন, উৎসাহের কথা এই প্রসঙ্গে ধনাত্মক অনুঘটকের কাজ করে, কথা অনস্বীকার্য। শুধু ম্যারাথন নয়, রাজ্যস্তরে আয়োজিত হল আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের যে দিকে বিয়েবাড়ির রমরমা, তার থেকে আরও এগোলে দেখা যায় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি। রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা প্রথমে জেলাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে, বিজয়ীরা এসেছে রাজ্যস্তরের আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায়। উত্তর দিনাজপুর থেকে আসা ছাত্রীরা, ঝাড়গ্রাম থেকে আসা ছাত্রীরা, সঙ্গে তাদের প্রশিক্ষকরা, আবার দক্ষিণ কলকাতার ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে আমরা। শুধু রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতা নয়, বিভিন্ন আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতাও চলছে পুরোদমে। কোথাও টেবিল টেনিস, ক্যারম কোথাও টাগ অব ওয়ার, বাস্কেটবল। রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় খো খো কবাডি, মেয়েদের ফুটবলের মতো খেলাও ছিল। খো খো খেলায় যোগদান করতে চায় হস্টেলের মেয়েরা। “সে কি, কোনও টিমই তো নেই!” “আমরা কালকের মধ্যেই টিম তৈরি করে আপনাকে জমা দেব ম্যাডাম।”
টিম তৈরি হল, প্র্যাক্টিসও শুরু হল পুরোদমে। সব সময় যে সমান ভাবে সফল হওয়া গেল তা নয়। পুরো সময়ের প্রশিক্ষক, আরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ, বেশি করে প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া— বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেক সময়। প্রশাসনিক সহায়তা এখন পাওয়া যায় আগের থেকে বেশি, তাই সরকারি কলেজেও ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় জিমের। কেউ স্পোর্টস কোটাতে ভর্তি হওয়া ছাত্রী নয়। তাই পড়াশোনার মাপকাঠিই তাদের মাপকাঠি, এই রকমই ভাবতে শিখেছে তারা, ভাবতে শিখিয়েছি আমরা, শিক্ষক-অভিভাবকরা।
কিন্তু যে মেয়েটি পড়াশোনার থেকে খেলায় আনন্দ পায় বেশি, তার যোগ্যতাও অনেক বেশি খেলার মাঠে, তাকে খেলার ক্ষেত্রে উন্নতি করার উৎসাহ দিই না কেন? এখন তো প্রতিটি সরকারি চাকরি, অনেক বেসরকারি চাকরিতেও স্পোর্টস সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। নিখাত জ়ারিন বা পিভি সিন্ধু মেডেল পেলে আমরা ভ্রু কুঁচকে খবরের হেডলাইন দেখি, মহিলা ক্রিকেটার বা ফুটবলার জিতলে নিঃশব্দ হাততালি দিই। মেয়েদের চাকরি করা, আর্থিক সুবিধার জন্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি, মেয়েদের অন্য রকম কিছু করাতে আমাদের এখনও সেই শুচিবায়ুগ্রস্ততা।
আরও একটা ২৯ অগস্ট গেল, উদ্যাপিত হল জাতীয় খেল দিবস। সবাইকে, সব্বাইকে একই রকম হতে হবে, হয়ে চলতে হবে— এই সামাজিক মানস থেকে মুক্তি হবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy