—ফাইল চিত্র।
অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় প্রবল বিপ্লব ঘটিয়েছিল তাঁর তিনটি গবেষণাপত্র— প্রথমটি ১৯৫৬ সালে, শিরোনাম ‘আ কনট্রিবিউশন টু দ্য থিয়োরি অব ইকনমিক গ্রোথ’; ১৯৫৭ সালে তার পরের প্রবন্ধটিতে থাকল তত্ত্বের সপক্ষে পরিসংখ্যানগত প্রমাণ, ‘টেকনিক্যাল চেঞ্জ অ্যান্ড দি এগ্রিগেট প্রোডাকশন ফাংশন’; তৃতীয় প্রবন্ধটি প্রকাশিত ১৯৫৯ সালে, শিরোনাম ‘ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল প্রোগ্রেস’। গত ডিসেম্বরে ৯৯ বছর বয়সে প্রয়াত অর্থশাস্ত্রী রবার্ট সোলো (ছবি)-র এই গবেষণাপত্রগুলি সম্বন্ধে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস ১৯৮৭ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সময় বলেছিল, “পরবর্তী কালে যা ‘গ্রোথ অ্যাকাউন্টিং’ নামক অর্থশাস্ত্রের শাখা হয়ে উঠবে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল এই গবেষণাপত্রগুলির মাধ্যমে।” তৃতীয় প্রবন্ধটি যখন প্রকাশিত হয়, সোলোর বয়স তখন ৩৫ বছর।
সোলোর গবেষণাপত্র প্রকাশের আগে প্রায় দু’দশক ধরে অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ছিল রয় হ্যারড ও ইভসে ডোমার-এর তত্ত্ব: উৎপাদন ব্যবস্থায় যত ক্ষণ শ্রম আর মূলধনের অনুপাতটি অপরিবর্তিত থাকবে, তত ক্ষণ সাম্যাবস্থাও বজায় থাকবে— কিন্তু, এই অনুপাত পাল্টালেই মুশকিল, হয় বিপুল বেকারত্ব সৃষ্টি হবে, নয়তো দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি ঘটবে। হ্যারড-ডোমার মডেলের এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে সোলো দু’পথে হাঁটলেন। প্রথম পথটি হল শ্রম ও মূলধনের অনুপাতটি ভাঙার জন্য আরও বেশি মূলধন নিয়োগ— অর্থাৎ, আরও বেশি যন্ত্র। এর ফলে হ্যারড-ডোমার মডেলের যে ভঙ্গুর সাম্যাবস্থা (অর্থাৎ যেখান থেকে এক বার চ্যুত হলেই হয় বেকারত্ব নয় মূল্যস্ফীতির ভয়), অর্থব্যবস্থা তা থেকে বেরিয়ে পৌঁছে যায় একটি উচ্চতর সাম্যাবস্থায়। যন্ত্রের ব্যবহার বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। অতএব, এই ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে মূলধন। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদে এই সমাধানের একটি বড় সীমাবদ্ধতা আছে— আগে যত শ্রমিক কাজ করতেন, তত শ্রমিকই যদি এখন দ্বিগুণ সংখ্যক যন্ত্রে কাজ করতে থাকেন, তা হলে কিন্তু উৎপাদন দ্বিগুণ হয় না। অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় এর নাম ‘ল’ অব ডিমিনিশিং রিটার্নস’।
এ কথা ঠিক যে, মূলধনি বিনিয়োগ বাড়লে স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতিতে জোয়ার আসে। ১৯৩০-এর মহামন্দার পরিপ্রেক্ষিতে জন মেনার্ড কেন্স এই মূলধনি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরামর্শই দিয়েছিলেন, বহু দেশ সেই নীতি অনুসরণও করেছিল। কিন্তু, ক্রমাগত মূলধনি লগ্নির পরিমাণ বাড়িয়ে চললেও এই স্বল্পমেয়াদি আর্থিক বৃদ্ধির হারকে ধরে রাখা অসম্ভব। অন্য ভাষায় বলা যায়, সব দেশই যদি কেন্সের স্বল্পমেয়াদি সমাধানসূত্র অনুসরণ করতে থাকে, তা হলে দীর্ঘমেয়াদে সব দেশের বৃদ্ধিই স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু, বাস্তবে তো তা হয় না। এক-এক দেশে বৃদ্ধির হার হয় এক-এক রকম। কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় রবার্ট সোলোর এক বিপুল অবদান। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধির চড়া হার বজায় রাখার পথ হল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, শিল্পক্ষেত্রে নতুনতর উদ্ভাবন নিয়ে আসা। তাঁর ১৯৫৭ সালের গবেষণাপত্রটিতে সোলো আমেরিকার ১৯০৯ থেকে ১৯৪৯ অবধি মোট চার দশকের আর্থিক পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেখালেন, প্রতি শ্রমিকের ঘণ্টাপিছু মোট উৎপাদনের পরিমাণ এই চার দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু, সেই বৃদ্ধির মাত্র ১২.৫% ঘটেছে মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে; বাকি ৮৭.৫% ঘটেছে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে। অর্থাৎ, কোনও অর্থব্যবস্থায় আর্থিক বৃদ্ধির চালিকাশক্তি মূলধনের পরিমাণ নয়, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও উন্নতি।
প্রযুক্তির ধারাবাহিক ও সুস্থায়ী উন্নতি না ঘটলে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক বৃদ্ধি আশা করা যায় না, সোলোর এই বক্তব্যটি নিয়ে দ্রুত প্রশ্ন উঠল। অনেকেই বললেন, এই সিদ্ধান্তটি প্রশ্নযোগ্য। তাঁর সমসাময়িক অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বেশ কয়েক জন একেবারে মৌলিক সংশয় প্রকাশ করলেন যে, সোলো নিজের তত্ত্বের সপক্ষে পরিসংখ্যানগত প্রমাণ পেশ করার জন্য যে ভাবে মোট মূলধনের হিসাব কষেছেন, তা কি আদৌ করা যায়? ‘ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল প্রোগ্রেস’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে সোলো অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে মূলধন গঠনের ভূমিকা বোঝার জন্য এক নতুন পন্থা গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মূলধনি সামগ্রীর মধ্যে তো প্রযুক্তিগত উন্নতি অন্তর্গত হয়েই আছে— ফলে, আর্থিক বৃদ্ধিতে মূলধন গঠনের অবদানের মাপ নেওয়ার সময় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের হিসাবটি বাদ দেওয়া যায় না।
সোলোর পদ্ধতি নিয়ে যেমন তাঁর সমসাময়িক অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছিলেন, তেমনই ১৯৫০-এর দশকে তাঁর গবেষণালব্ধ ফল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, তিনি যখন বললেন আর্থিক বৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও উন্নয়ন, সেটাই কিন্তু অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় প্রযুক্তির মাহাত্ম্যের প্রথম উল্লেখ নয়। ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রে এই বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই আলোচনা চলেছে। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে জোসেফ শুম্পেটার তাঁর ‘ইভোলিউশনারি থিয়োরি অব ইনোভেশন’ বা ‘উদ্ভাবনের বিবর্তনবাদী তত্ত্ব’-র মাধ্যমে এই আলোচনাটিকে শক্তপোক্ত তাত্ত্বিক কাঠামো দিয়েছিলেন। তা হলে সোলোর গুরুত্ব কোথায়? এখানে যে, তিনিই প্রথম ‘টেকনোলজি ফ্যাক্টর’-কে মূলধারার অর্থশাস্ত্রের একেবারে কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করেন; তাঁর তত্ত্ব থেকে প্রভাবিত হন পরবর্তী অনেক প্রজন্মের অর্থনীতিবিদরা, নীতিনির্ধারকরাও। তাঁর তত্ত্ব এখন অর্থনীতির আঙিনায় প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত— যে দেশ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কথা না ভেবে শুধু মূলধনি খাতে লগ্নির কথা ভাবে, সে দেশ আসলে নিজেদের বৃদ্ধির সম্ভাবনার মূলোচ্ছেদ করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy