—প্রতীকী চিত্র।
রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পর এক মাসের বেশি অতিক্রান্ত। এই এক মাসে মন্দির প্রতিষ্ঠার উপরে সরকারি সিলমোহর পড়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ, কিছু রাজ্য সরকার— সবাই প্রস্তাব পাশ করেছে মন্দির প্রতিষ্ঠাকে সাধুবাদ জানিয়ে। এমনকি উচ্চতম আদালতের প্রাক্তন বিচারপতিরাও এই ভক্তি প্রদর্শনের সারি থেকে সরে থাকেননি। উচ্চতম আদালতের প্রধান বিচারপতি পক্ষান্তরে জানিয়েছেন, স্বাধীনতার তাৎপর্যের এ এক নতুন বোধোদয়। মন্দিরের ধ্বজা তাঁকে প্রজাতন্ত্রের আদর্শ স্মরণ করায়। একই সঙ্গে অযোধ্যা বিমানবন্দরে ২২ জানুয়ারি ঘিরে শয়ে শয়ে বিমান নেমেছে। ট্রেনে করে অসংখ্য মানুষ এসেছেন। মন্দির দর্শন জনসমাগমের চাপে সাময়িক বন্ধ রাখতে হয়েছে। শঙ্করাচার্যদের নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে। প্রচুর অঞ্চলে ছোট করে রামপুজো হয়েছে বা নতুন করে রামমন্দির স্থাপিত হয়েছে। প্রচারমাধ্যম বলেছে, পাঁচশো বছরের পরাধীনতার ইতি হল রামমন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের অনেকেই সৌহার্দের হাত বাড়িয়ে আশা প্রকাশ করেছেন, দশক দশক ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িক বৈরের অবসান হোক মন্দির প্রতিষ্ঠার পর। বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি চুপ থেকেছে, বা বলেছে রামভক্তিতে আপত্তি নেই, মন্দির প্রতিষ্ঠাতেও নেই— কিন্তু ধর্মীয় আচারে সরকারি অনুপ্রবেশ কেন? বা কেন এক ধর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশ বা হস্তক্ষেপ ঘটছে?
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভক্তির আঘাতে বেশির ভাগেরই পক্ষাঘাতসম অবস্থা। ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। কোথাও কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের অপেক্ষা না করে তাঁর মতো করে ভক্তি প্রদর্শন করেছেন; কোথাও সে দলের কোনও নেতা রামমন্দিরে পুজোনিবেদনের উদ্দেশে অযোধ্যায় গেছেন; কোথাও নেতৃবৃন্দ মৌন থেকেছেন, অথবা দেশের এক প্রান্তে পদযাত্রায় গিয়ে ভেবেছেন, এই প্লাবন চলে যাবে মাথার উপর দিয়ে। তার পরে মাথা তুলে আবার বাঁচা যাবে। সবচেয়ে ইঙ্গিতবাহী দেশের বৃহত্তম বামপন্থী রাজনৈতিক দলের অবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে তারা মনে করেছে, এই রাজ্যের জনবাদী প্রশাসন সর্বধর্ম সমন্বয় বা সর্বধর্ম সহনের জন্য ২২ জানুয়ারি যে সমাবেশের আয়োজন করেছিল, তা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সমার্থক। এই যুক্তির সারবত্তা একমাত্র ঐশীক্ষমতায় বোঝা যাবে, সাধারণ বুদ্ধিতে এই সারবত্তা বোঝা যাবে না।
কিন্তু কূটতর্ক বাদ দিলে, দেশ জুড়ে ভক্তির এই প্রাবল্য এবং অন্য দিকে বুদ্ধির এই পক্ষাঘাতসূচক পরিস্থিতি এক নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত করে। আমাদের দেশে এক পুরধর্মের আবির্ভাব হল এই বাস্তবতার ইঙ্গিত। এই ধর্ম সবার, সমগ্র জাতির, সব সম্প্রদায়ের, সব গোত্র-বর্ণ-ধর্মের, সব ভাষার, সব অঞ্চলের। এই ধর্ম সংখ্যাগুরু অংশের নয়, অথবা এক বিশেষ স্তরের নয়। এই ধর্মকে জাতীয় স্তরে উন্নীত করেছে দেশের শহর, ছোট ছোট নগর ও উপনগর। এর নাম পুরধর্ম। যা হল জাতীয় ধর্ম। পুরধর্মের এই জাজ্বল্যমান উত্থানের আড়ালে হয় দেশ ভক্তিতে আপ্লুত, নয় পক্ষাঘাতে অবশ।
কিন্তু ভক্তির অর্থই হল, তাতে প্রচুর ফাঁকফোকর থাকে। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। তাই প্রশ্ন উঠতে লাগল, রাম আরাধ্য হলেন, তাঁর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হল, কিন্তু সহধর্মিণী সীতার কী হল? সীতা সম্মান পেলেন না কেন? কোথায় গেলেন রামচন্দ্রের জননী কৌশল্যা? রামপুজো তা হলে কি পুরুষতন্ত্রের পুজো? পুরধর্মের ফাটল দিয়ে লোকধর্মের কথা অনেকেরই মনে পড়ল। জনবাদীরা প্রশ্ন করলেন, উৎসব সবার, কিন্তু ধর্ম তো যার যার। তা হলে কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, এই সব দেবীর স্থান কোথায় হবে? একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে নিজস্ব লোকধর্মের কথা উঠে এল। আর ‘সনাতন ধর্ম’ এই নামকরণ নিয়ে আপত্তি ছিলই। প্রশ্ন ছিল, তার পুরুষতান্ত্রিকতা এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচার নিয়ে।
আমাদের দেশে এ এক নতুন সময় হাজির, যাকে শুধু ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শের মাঝে বিরোধিতা দিয়ে বোঝা যাবে না। পুরধর্মে ও লোকধর্মের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বাড়বে। জনবাদী শক্তিসমূহের সারিতে যাঁরা সাহসী তাঁরা আরও দূর এগোবেন। কিন্তু, অন্তত এ কথাটা জনবাদী শক্তি বলতে থাকবে যে, পুরধর্ম বা নাগরিক ধর্মের এই শিরোপার জন্য তেত্রিশ কোটি আরাধ্য দেবদেবীর মাঝ থেকে এক জনকে বেছে নেওয়া হল কেন? বাকি যে একাধিক লোকধর্ম রইল, তাদের গৌণ স্থান দেওয়ার কারণ কী? বিশেষত, এ কোন জাতীয় ধর্ম, কোন নাগরিক ধর্ম বা পুরধর্ম, যা নারীর সম-অস্তিত্বকে স্বীকার করে না?
পুরধর্মে ও লোকধর্মের সংঘাতের তাৎপর্য রাজনীতিতে বাড়ছে এবং আরও দেখা যাবে। যেমন নগর বা শহরগুলো থেকে এই নতুন ধর্মোচ্ছ্বাস উঠে এসেছে, তেমনই অঞ্চলে অঞ্চলে দীর্ঘ দিনের ধর্মবোধ বা লোকবোধ বা লোকবিশ্বাস মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে বলীয়ান পুরধর্ম যদি জাতীয় ধর্ম বলে স্বীকৃত হয়, তবে জনবাদীরা ক্রমাগত আঁকড়ে ধরবেন এবং শক্তিশালী করবেন লোকবুদ্ধি, লোকবোধ এবং লোকধর্মকে। লোকধর্মও অল্প হলেও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পাবে। এই সংগ্রামে বৈদান্তিক স্বামীর উক্তিও উদ্ধৃত হচ্ছে: গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা বেশি কাজে দেবে। সংগ্রামের এ হল এক নতুন দিক।
লক্ষণীয়, লোকধর্মে এবং লোককল্পনায় নারীর স্থান নারীকেন্দ্রিক রাজনীতিকে বা বলা উচিত নারীমুখী রাজনৈতিক কৌশলকে আরও শক্তিশালী করবে। বিভিন্ন সরকারি জনকল্যাণমূলক নীতি, দলীয় সংগঠনের ধাঁচ, প্রচারের অভিমুখ ইত্যাদি এই মেলবন্ধনকে আরও পাকা করবে। জনবাদীদের রাজনৈতিক বোধ আরও পরিণত হবে, যদিও তার কৌশলকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে না। সমাজ রূপান্তরের কথা যাঁরা ভাবেন, তাঁদের কাজ এখানেই। এই কৌশলকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এক সামগ্রিক রণনীতিতে পরিণত করা। এর অর্থ এই নয়, এই নারীমুখী রাজনৈতিক কৌশল অথবা লোকবোধকে উপেক্ষা করা।
নয়া উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে জনবাদীরা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে আছেন এই সব কৌশল অবলম্বন করে। লোকবোধ তাঁদের সহায় এবং সম্বল। কিন্তু লোকপরিস্থিতির যে দুর্দশা, তাতে বিশেষ কমবে না, যদি না রাজনীতিতে লোকবোধ এক গভীর রাজনৈতিক বোধে রূপান্তরিত হয়।
অথচ, এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যের কারাগারগুলিতে বন্দিনিরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন। কতটা বলপ্রয়োগের শিকার হচ্ছেন, তা শুধু অনুমানই করা যায়। শিশু রক্ষণালয়ে অল্পবয়সি মেয়েদের উপর লাঞ্ছনা চলে। নাবালিকাদের বিবাহ কমানো যাচ্ছে না। মহিলা-শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া যাচ্ছে না। এক দিকে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটছে, অন্য দিকে নারীবৈষম্য সমানে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কমিশন এ সব নিয়ে কী ভাবে? সরকারকে কোন নীতি অনুসরণের উপদেশ দেয়, নিজেদের উদ্যোগে কী পদক্ষেপ করে, নারীসমাজ তার কতটা জানতে পারে?
নারীবৈষম্যের অবসানের আকাঙ্ক্ষা লোকধর্মকে আরও শক্তিশালী করবে। তেমনই জনবাদীদের নারীমুখী জনকল্যাণমূলক প্রকল্প আমাদের চলমান রাজনীতিতে নারীদের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে আসবে। বৈষম্যের বাস্তবতা এবং নারী-মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা, এই দ্বৈততা নিয়েই বাংলার জনবাদী মানসমণ্ডল।
সংসদীয় রাজনীতিকে অবলম্বন করে রাজনীতিতে নারীশক্তি কতটা সংহত হবে বলা মুশকিল, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, পুরুষকেন্দ্রিক অথবা পুরুষতান্ত্রিক এক পুরধর্মের উত্থান এবং জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি লোকধর্মের ও লোকবোধের মরিয়া উপস্থিতি সংগ্রামের এক অন্য দিকের ইঙ্গিতবাহী। এবং এই সংগ্রামে নারীর ভূমিকা কেন্দ্রীয় চরিত্ররূপে আবির্ভূত। সে সন্দেশখালিতে হোক অথবা রাজনৈতিক প্রচারের রণাঙ্গনে।
জনবাদীরা সচেতন বা অবচেতন ভাবে সংগ্রামের এই নতুন দিক খুলে দিয়েছেন। যদিও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা নানা সময় প্রকাশ পেতে থাকবে। কিন্তু বড় প্রশ্ন হল, সমাজপরিবর্তনের রাজনীতি এই তাৎপর্যকে কী ভাবে আত্মস্থ করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy