ফেলে আসা বছরের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আগামী দিনগুলো শুধরে নেওয়ার প্রস্তুতি— নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এমন কথাই ভাবতে ইচ্ছা করে। কিন্তু জলবায়ুর ক্ষেত্রে ভাবনাটিকে ঠিক সেই পথে নিয়ে যাওয়া কঠিন। ক্রমশ বদলে যাওয়া পরিবেশ, জলবায়ু প্রতিনিয়ত প্রমাণ করেছে, ভুল শুধরে নেওয়ার সময় আর নেই। অবক্ষয়ের চিহ্নগুলি স্পষ্টতর হতে দেখাই এখন একমাত্র কাজ।
অবক্ষয় নানা দিকে। মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই ২০২৪ সাল উষ্ণতম বছরের শিরোপা পেতে চলেছে। বছরের প্রথম ১১ মাসেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে, যে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে প্রাক্-শিল্পবিপ্লব যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রির নীচে আটকে রাখার জন্য ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল ১৯৬টি দেশ। জলবায়ুর ক্ষেত্রে নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ার ধাক্কায় সেই সীমারেখা এখন প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মকে ইতিমধ্যেই ইউরোপ তো বটেই, গোটা বিশ্বের প্রখরতম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। জমি ছাড়েনি বর্ষাও। শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসে মধ্য ইউরোপের প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ভয়ঙ্কর বন্যায়। আফ্রিকার সুদান, নাইজিরিয়া, চাড, ক্যামেরুনের বন্যা প্রাণ কেড়েছে প্রায় ২০০০ জনের। মার্চ-এপ্রিলের অসময়ের বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়েছে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা। আশ্চর্যের বিষয় হল, মাঝ-এপ্রিলে প্রায় বৃষ্টিহীন দুবাই এক বেনজির বন্যার সাক্ষী হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়েছিল সে দেশের এক বছরেরও বেশি সময়কালের বৃষ্টির পরিমাণকে। ভারতেও মরুরাজ্য রাজস্থান বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। মরু অঞ্চলে অতিবৃষ্টি, আর সুজলা-সুফলা অঞ্চলে অনাবৃষ্টির কারণে চাষবাসে ব্যাঘাত— পরিবর্তনের পদধ্বনি স্পষ্টতর।
জলবায়ু পরিবর্তনের এক নির্ভুল সঙ্কেত সামুদ্রিক ঝড়ের সংখ্যা এবং তার তীব্রতা বৃদ্ধি। সেপ্টেম্বরের শেষে ক্যাটেগরি-৪ হারিকেন হেলেন তছনছ করেছে ফ্লরিডার সৈকত। মনে করা হচ্ছে, আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানা হারিকেনগুলির মধ্যে ক্যাটরিনার পর এটিই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঝড়, এবং আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয়। সেপ্টেম্বরের গোড়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং দক্ষিণ চিনে প্রবল ধ্বংস ডেকে এনেছিল টাইফুন ইয়াগি। মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৯০০-র কাছাকাছি মানুষ। চিন্তা বাড়াচ্ছে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়গুলিও। মে মাসে রেমালের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উপকূল। অক্টোবরের দানা ওড়িশায় ভূমিস্পর্শ করলেও পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে। প্রতি বছর একাধিক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে যে ভাবে পূর্ব উপকূলে ক্ষতির মাত্রা বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার্থে স্থায়ী ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে সরকারকে।
সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২৪ সালের প্রথম ন’মাসের ৯৩ শতাংশ দিনই ভারতের নানা প্রান্তে আবহাওয়ার ক্ষেত্রে চরম অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। এই গ্রীষ্মেই দিল্লির তাপমাত্রা পেরিয়েছিল ৫০ ডিগ্রির গণ্ডি। দেশের অন্য প্রান্তেও তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে জুড়েছে ঘন ঘন সাইক্লোনের হানা, প্রবল বজ্রপাত, অস্বাভাবিক বৃষ্টি, বন্যা, ধস। সব মিলিয়ে এ সব ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৩,২৩৮ জনের। এ-ও মনে করা হচ্ছে, বিপর্যয়ের আসল রূপটি আরও অনেক বেশি তীব্র এবং ভয়ানক। কারণ, বহু ক্ষেত্রেই ক্ষয়ক্ষতির আসল পরিসংখ্যান মেলেনি।
ভারতের পার্বত্য রাজ্যগুলিও স্বস্তিতে থাকেনি। গত বছর হিমবাহ হ্রদ ফেটে বন্যার পর এই বছরও উত্তর সিকিম বিপর্যস্ত হয়েছে অতিবৃষ্টিতে। প্রবল বৃষ্টি ও ধসে বার বার রুদ্ধ হয়েছে সিকিমের জীবনরেখা দশ নম্বর জাতীয় সড়ক। অগস্টে প্রবল বন্যার কবলে পড়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা, এবং সংলগ্ন বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অংশ। শুধুমাত্র ত্রিপুরাতেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন লক্ষাধিক মানুষ। তবে সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে যায় জুলাই শেষের কেরলের ওয়েনাড় বিপর্যয়। অতিবৃষ্টি আর হড়পা বানে পাহাড় ভেঙে নেমে আসা কাদাজল, পাথর রাতারাতি মুছে দিয়েছিল চূড়ালমালা এবং মুণ্ডাক্কাই গ্রামকে। প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত সংলগ্ন গ্রামগুলিও। আড়াইশোর কাছাকাছি প্রাণহানি, ক্ষতি— হিসাবহীন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পাহাড় ধ্বংস করে উন্নয়ন, আর বেপরোয়া পর্যটন বিপর্যয় ডাকছে পাহাড়ে। অথচ, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার কোনও পরিবেশবান্ধব সুস্থায়ী উন্নয়নের দিশা দেখাতে ব্যর্থ।
যেমন ব্যর্থ নভেম্বরে আজ়ারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত কনফারেন্স অব পার্টিজ়-এর ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন। জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বকে রক্ষা করার উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণে আর্থিক ভাবে পাশে দাঁড়ানোর কথা উন্নত বিশ্বের। এত দিন অন্তত নানাবিধ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সাহায্যের ভানটুকু করে এসেছে তারা। কিন্তু ২০২৪ দেখল সেই পর্দারও খসে পড়া। জলবায়ু-ভাবনায় পশ্চাদ্গামিতা শুরু হয়েছে সম্প্রতি, সিওপি২৯ তাকেই স্পষ্টতর করে তুলল।
বছরের শেষ দিনটিতে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকালে বিশ্বের নানা কোণে জমে থাকা ধ্বংসস্তূপগুলি চিনে নিতে ভুল হয় না। নতুন বছরে সেই ধ্বংসস্তূপ সরবে, হাহাকার থামবে দুর্গতদের— তেমন আশা কি আর অবশিষ্ট আছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy