প্রজন্ম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ভাস্কর্য। উইকিমিডিয়া কমনস।
তুমি আমিন সাহেবের ছেলে না?” অনেকখানি রক্তস্নান দেখা এবং নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় যখন বেয়নেটধারী জেহাদিকে প্রশ্নটা করে বসেন, জেহাদি একটু থমকে যায়। আচমকা থমকে যেতে হয়, ওটিটি-র পর্দায় চোখ রাখা দর্শকদেরও। কারণ প্রশ্নটা শুধু জেহাদির জন্য নয়। শুধু কাকতালীয় ভাবে এক পণবন্দির সঙ্গে এক জঙ্গির পূর্বপরিচয় বেরিয়ে পড়ারও নয়।
একদা সুবর্ণরেখা ছবিতে নিষিদ্ধপল্লিতে বোনের ঘরে দাদার আগমনের তথাকথিত অতিনাটককে টেবিল চাপড়ে সমর্থন করে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, ওই দাদা যার ঘরেই যেত, সে তো তার বোনই হত! ঠিক তেমন করেই শনিবার বিকেল ছবিতে মোজাম্মেল সাহেবের এই প্রশ্নটা আসলে যে কোনও জঙ্গির প্রতি যে কোনও পণবন্দিরই হতে পারত। আটকে পড়া পণবন্দিরা সকলেই মোজাম্মেল, আর জেহাদিরা সকলেই কোনও না কোনও আমিন সাহেবের ছেলে। মোজাম্মেলের পরের প্রশ্নটা তাই আর শুধু প্রশ্ন থাকে না। তীব্র অন্তর্দাহের স্বগতোক্তির মতো ধ্বনিত হয় তাঁর হাহাকার, “আমাদের কোন ভুলে তোমরা এমন হলা?”
ঢাকার অভিজাত মহল্লার হোলি আর্টিজ়ান বেকারিতে ২০১৬ সালের জঙ্গি হামলার ঘটনাকে বীজ (বীজই, ঘটনার অনুকৃতি ছবিতে নেই) হিসাবে রেখে নির্মিত শনিবার বিকেল ছবিটা এখনও তার নিজের দেশে মুক্তি পায়নি। কবে পাবে, আদৌ পাবে কি না, জানা নেই। গত চার বছর ধরে এই ছবিকে ঘিরে যে টানাপড়েন, সংবাদমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের সূত্রে তার খবরাখবর এ পারে জানা যেত নিয়মিতই। বাংলাদেশের চিত্রপরিচালক মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর কাজের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, এই ছবিকে ঘিরে আগ্রহ তাঁদের থাকারই কথা। বিশেষ করে টেলিভিশন ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, বিশ্বাস-সংস্কার-রক্ষণশীলতার প্রশ্নকে নিয়ে ফারুকী কী অদ্ভুত সূক্ষ্মতার সঙ্গে গোদা সাদা-কালো এড়িয়ে একটা অন্য ধরনের ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারেন, সেটা তাঁদের জানা আছে। হোলি আর্টিজ়ান বেকারিতে জঙ্গিবাদের নৃশংস আক্রমণকে তিনি কী ভাবে ছবিতে নিয়ে আসেন, সেটা দেখার একটা বাড়তি কৌতূহল তাই স্বাভাবিক ভাবেই ছিল। ভারতের ওটিটি-তে মুক্তি পাওয়ার ফলে সেই কৌতূহল মেটানো সম্ভব হল।
ওটিটি-তে এই ছবিকে থ্রিলারের গোত্রভুক্ত করা হয়েছে বটে, কিন্তু কার্যত এ ছবি থ্রিলারের ব্যাকরণে এক মূর্তিমান অন্তর্ঘাত। থ্রিলারের ক্ষেত্রে ‘শ্বাসরুদ্ধকর’ শব্দটা ব্যবহার করার একটা চল আছে। কারণ, রীতি মোতাবেক সেখানে দমবন্ধ উত্তেজনার ব্যাপার থাকে। একটা ‘কী হয় কী হয়’ ভাব সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। ক্রমাগত বাঁক বদলের মধ্য দিয়ে গল্পকে দৌড় করানো তার আবশ্যিক শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। তার উপরে গল্পের বিষয়বস্তু যদি হয় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, তা হলে তো কথাই নেই। কে মরল, কে বাঁচল, কারা কী ভাবে উদ্ধার পেল, জঙ্গিরা খতম হল কি না, এই সবই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। অনলাইনে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ফারুকীর শনিবার বিকেল দেখাল, জঙ্গি হানার গল্প এ সব বাদ দিয়ে, ছাপিয়ে গিয়ে কত দূর যেতে পারে।
আমরা আজকাল কী রকম সময়ের মধ্যে বাস করছি সেটা কারও অজানা নয়। ঘৃণা, বিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুতার মৌলবাদে আমি-আপনি কমবেশি সকলেই আক্রান্ত। এতটাই যে, জনপ্রিয়তাবাদী চলচ্চিত্রে সন্ত্রাস এখন অন্যতম রসদ, জনতার প্রিয় খাদ্য। চড়া জাতীয়তাবাদের চাষ আর সাম্প্রদায়িকতার সুড়সুড়ি সেখানে প্রায় অনিবার্য উপাদান, বড় জোর সঙ্গে একটু ভাল সংখ্যালঘু বনাম খারাপ সংখ্যালঘুর বুড়ি ছুঁয়ে আসা। দ্য কাশ্মীর ফাইলস বা দ্য কেরালা স্টোরি-র মতো মার্কামারা ছবির কথা যদি বাদও দিই, জঙ্গিদমন অভিযানের শৌর্য কাহিনির ফর্মুলাও এর বাইরে নয়। সরফরোশ, ম্যায় হুঁ না, আ ওয়েনেসডে, নীরজা, বেবি, নাম শাবানা, নিউ ইয়র্ক, ফ্যান্টম, বাটলা হাউস, ইন্ডিয়া’জ় মোস্ট ওয়ান্টেড থেকে টাইগার সিরিজ়, পঠান... তালিকা মোটেই নাতিদীর্ঘ নয়। এমনকি, খোদ হোলি আর্টিজ়ানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি বলিউডের ফারাজ়-ও চেনা ছকের বাইরে হাঁটেনি। পারিপার্শ্বিকতার কোন প্রণোদনা থেকে যুবসমাজের একাংশ জঙ্গিবাদের খাতায় নাম লেখায়, এক সময় অবশ্য সে সব গল্প বলার চেষ্টা খানিক হয়েছিল। গুলজ়ারের মাচিস, খালিদ মহম্মদের ফিজ়া, কমল হাসনের হে রাম বা বিশাল ভরদ্বাজের হায়দার-এর নাম করা যেতে পারে। কিন্তু ধারাটি যে ক্রমেই শুকিয়ে আসছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্য ধারাটি কিন্তু অনুকূল জলহাওয়ায় আড়ে-বহরে বেড়েই চলেছে। কিশোরকুমার জুনিয়র কিংবা রক্তবীজ-এর মতো ছবির সুবাদে বাংলাতেও তার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তানের খামোশ পানি বা খুদা কে লিয়ে-র সমগোত্রীয় ছবি তৈরির চেষ্টা তাই আর চোখে পড়ে না তেমন। মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদ নিয়ে সর্বক্ষণ তেতে থাকা এই স্বদেশ ছবির পর ছবি করেও তাই তেমন কোনও অন্তর্দৃষ্টির সন্ধান দিতে পারে না।
ফারুকীর ছবি সন্ত্রাসকে একটা থ্রিলিং অভিজ্ঞতা হিসাবে পরিবেশন করতেই চায়নি। দ্রুত কাট-এর সাসপেন্স নয়, কাট-বিবর্জিত যতিচিহ্নহীন গুমোট সে কারণে তার আধার। হিংস্রতার আবহ সেখানে তৈরি হয় খুনোখুনির বীভৎস রসের চেয়ে অনেক বেশি করে মৌলবাদের মনোভঙ্গিকে বেআব্রু করে তোলার মধ্য দিয়ে। বস্তুত ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়, এই হিংস্র সময়কে কী ভাবে পড়া যেতে পারে, সেটাই যেন ফারুকী খুঁজছেন। সেই আত্মানুসন্ধানকেই ছবির মধ্যে নথিবদ্ধ করতে চেয়েছেন। শিল্প-সংস্কৃতি আসলে এই কাজটুকুই করতে পারে কেবল। নিজেকে ছিঁড়েখুঁড়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে পারে বোধের শিখা, তার পর সেই ধুনিটুকু জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করে যেতে পারে নিরন্তর। ফারুকীর গোটা ছবিটা তাই দাঁড়িয়ে থাকে ওই একটা প্রশ্নকে ঘিরে, আমাদের কোন ভুলে তোমরা এমন হলে। ফর্মুলাভিত্তিক আর পাঁচটা ছবি যখন বারংবার সাধারণ মানুষ আর জঙ্গিদের ‘আমরা’ আর ‘ওরা’য় ভেঙে ফেলে, সেই আমরা আর ওরা-কে ফারুকী ‘আমরা’ আর ‘তোমরা’য় নিয়ে আসেন। যে তুমির উৎপত্তি আমারই মধ্যে। মোজাম্মেল সাহেব যে মুহূর্তে চিস্তিকে প্রশ্ন করেন, তুমি আমিন সাহেবের ছেলে না? সেই মুহূর্ত থেকে আমাদের চোখে চিস্তি আর শুধু চিস্তি থাকে না। সে হয়ে ওঠে কারও সন্তান, কারও বাল্যবন্ধু, কারও পড়শি। যার একটা ঠিকানা ছিল, একটা পরিবার ছিল, একটা শৈশব ছিল।
বলিউডের আ ওয়েনেসডে ছবির একটা সংলাপ বছর কয়েক আগে খুব জনপ্রিয় হয়। ঘরে আরশোলা ঢুকলে আপনি কী করেন? ঝাঁটা দিয়ে মারেন না? প্রায় এনকাউন্টার-সংস্কৃতির জয়গান গাওয়া এই সংলাপ হাততালি কুড়োনোর উপযোগী নিঃসন্দেহে। কিন্তু কেন, কী ভাবে আমাদেরই ভিতর থেকে কেউ কেউ বিষধর কীটে পরিণত হল, সেই প্রশ্নটা সেখানে ছিল না। কারণ মৌলবাদের মুখ, নাশকতার মুখ— সংখ্যালঘুই হোক বা সংখ্যাগুরু— তারা যে আমাদেরই ভিতরের কেউ কেউ, এই কথাটা আমরাও, সংখ্যালঘুই হই বা সংখ্যাগুরু, সচরাচর মনে রাখতে চাই না। মনে রাখার অসুবিধা আছে। মনে রাখলে তার অনেক দায় আছে। সেই দায় আমাদের দায়, সমাজের দায়। যে সমাজের মধ্য থেকে জঙ্গিদের উত্থান, মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত, অসহিষ্ণুতার রমরমা, সেই সমাজের সমষ্টিগত ব্যর্থতার দায়। একটা ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করেও যেখানে পদ্মা-গঙ্গা দিয়ে গরলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, তখন ‘এ আমার এ তোমার পাপ’, এটা উপলব্ধি করার দায়। ফারুকীর ছবি সেই দায়কে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ছবি। আর সেই কারণেই এই ছবি শুধু বাংলাদেশের নয়। এ ছবি আমার, আপনার, সবার। কারণ, আমাদের কোন ভুলে সময়টা এমন হিংস্র আর কদর্য হয়ে দাঁড়াল, এর উত্তর খোঁজার দায়টাও আমাদের সবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy