—ফাইল চিত্র।
ঠিক একশো বছর আগের কথা। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত স্যুররিয়ালিস্ট ইস্তাহারে অঁদ্রে ব্রেতঁ শুনিয়েছিলেন এক কবির গল্প। সেই কবি, প্রতি দিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে শয়নকক্ষের দরজায় ঝুলিয়ে দিতেন এক বিজ্ঞপ্তি: ‘কবি কাজ করছেন’। তারও আগে, ১৯১৮ সালে, ফরাসি কবি গিয়োম আপলিনেয়ার তাঁর একটি নাটকের ভূমিকায় জানান, “মানুষ যখন হাঁটা ব্যাপারটার অনুকরণ করতে চাইল, তখন সে বানিয়ে ফেলল চাকা। চাকা দেখতে মোটেই পায়ের মতো নয়। মানুষ এ ভাবে ব্যাপারটা না জেনেই যা করেছে তাই হল স্যুররিয়ালিজ়ম।”
এ সব অনেক প্রসঙ্গ ভিড় করে এল জীবনানন্দ দাশ আর তাঁর সৃষ্টিমুখর অগ্নিবলয় সূত্রে। এ বছর এই কবির বয়স হল ১২৫। জন্ম হয়েছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে। ট্রামের ধাক্কায় রক্তাক্ত কবির মৃত্যু ২২ অক্টোবর ১৯৫৪। তাঁর মৃত্যুরও বয়স সত্তর বছর হল। অথচ, এই সেই কবি, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যাঁকে মনে হয় সমকালীন, আদ্যন্ত প্রাসঙ্গিক। হয়তো আরও একটু ঝুঁকি নিয়ে বলতে পারি, তাঁর সমসময় এবং অনুজ কবিপ্রতিভাদের মধ্যে তিনিই আজ একমাত্র ‘জীবিত’। ত্রিশ-চল্লিশের সেই মহাভাস্বরদের পাশে গত শতকেও জীবনানন্দ ছিলেন একটু কোণঠাসা, একটু তাচ্ছিল্যময় অবহেলায় ম্লান। ক্রমশ পাল্টে গেল সময়-বাস্তব-অভিজ্ঞতা-মানব প্রত্যয়। অথবা প্রত্যয়হীনতা। দেখা দিল নতুন কবিতার ভাষা আর ভাষ্য। দেখা দিল অস্তিত্ব-সমাজ-সত্য-দর্শন-মৃত্যু-পথবিশ্বাস-ভয় নিয়ে সংশয়, প্রশ্ন, সন্ধান। তখনই আরও প্রবল সঙ্কেততুফান বুকে নিয়ে পুনর্জীবিত হয়ে দেখা দিলেন জীবনানন্দ। বিশ শতকের শেষ পর্ব থেকে সেই উত্থান। আজ তাঁর অমোঘ উচ্চারণগুলি, বহুস্তরিক-বহুকৌণিক শব্দ-প্রতিমা-ভাষ্য কালোত্তীর্ণ সমসাময়িক হয়ে দেখা দেয়। তাদের রহস্যগুলি ভোঁতা হয়নি, বরং আরও ধারালো হয়েছে!
সাম্প্রতিক এক হিসাব অনুযায়ী, জীবনানন্দ লিখেছেন, ১৯টি উপন্যাস, ১২৭টি গল্প, ৭৯টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এখনও পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে ৪০০০ পৃষ্ঠারও বেশি ডায়েরি, দেড়শোর কাছাকাছি চিঠিপত্র বা তার খসড়া। অথচ লক্ষ করবেন, মাত্র ১৬২টি কবিতা গ্রন্থভুক্ত করেছিলেন। পাণ্ডুলিপির কবিতাসংখ্যা ৩০০০-এর বেশি!
ফিরে আসি গোড়ার কথায়। এক দিকে স্বপ্ন আর অন্য দিকে বাস্তব অতিক্রমী কল্পনাপ্রতিভার নিত্যনতুন উদ্ঘাটন— মিলেমিশে তৈরি হচ্ছিল তাঁর কবিতা। সেই স্বপ্নবাস্তব রচনার বাঁকে-বাঁকে মিশে যাচ্ছিল নিজস্ব বোধ, নিজস্ব অনুভব। ভেঙে যাচ্ছিল পরিচিত যুক্তিপরম্পরা, ভেঙে যাচ্ছিল চেনা ভাষার চেনা সরলরৈখিক সমাধান তথা নিশ্চিন্ততা। বাইরের জগৎ, সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সঙ্ঘ তথা পার্টিকেন্দ্রিক চালু সমাধান আর বাহ্যিক নানা উত্তেজনার তুফান এড়িয়ে তিনি টান দিচ্ছিলেন ব্যক্তিমনের গভীর স্তরে। ফলে, তাঁর কবিতায় বারংবার এসে পড়ছিল অন্তঃসার, অন্তঃশরীর, অন্তর্দীপ্ত, অন্তর্যামী, অন্তঃশীল— এ রকম নানা সারাৎসারের প্রশ্ন। ঢুকে পড়ছিল দৃশ্যের অভ্যন্তরের দৃশ্য, মগ্নচৈতন্যের উদ্ঘাটন, কত শত চিত্রভাষ্য। তৈরি হচ্ছিল বহু অর্থময় এক ‘আধুনিক’ ভাষা। যার সারমর্ম ঝট করে লিখে ফেলা শক্ত, যার স্থির-যৌক্তিক ‘গদ্যপরিণামী’ অন্তিমযাত্রা নেই। অর্থাৎ, যে লেখা বহুমাত্রিক, যে ভাষা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং বহু ব্যাখ্যার রোমাঞ্চ বহন করে। “তবুও মানুষ তার বিছানায় মাঝরাতে নৃমুণ্ডের হেঁয়ালিকে/ আঘাত করিবে কোন্খানে?/ হয়তো নিসর্গ এসে একদিন ব’লে দেবে কোনো এক সম্রাজ্ঞীকে/ জলের ভিতরে এই অগ্নির মানে।” (একটি কবিতা)।
এ সব নিঃসন্দেহে স্বপ্ন থেকে, দুঃস্বপ্ন থেকে উত্থিত অনুভূতিমালা। স্বপ্নসমূহের কোনও আদি-অন্ত পারস্পরিক সম্পর্ক হয় না। অথচ, ব্যক্তি আর সময়ের অচেতন-অবচেতন অন্তঃস্রোত বহমান সেখানে। সে অর্থ ‘উৎপাদন’ করে না, মনোমুকুরে ক্ষণিক ছায়া ফেলে, অনুভূতিকে জাগ্রত করে, বাস্তবের শূন্য খুঁড়ে তলগুলি বুঝতে চায়। না-পেরে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে।
‘আর্তনাদ’ শব্দের কাছে পৌঁছে মনে হয়, এতক্ষণে জীবনানন্দের মূল মুদ্রাটিকে হয়তো স্পর্শ করা গেল। তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহৃদ কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, “অন্যমনস্ক জীবনানন্দ এমনিতেই একটু ছিলেন। রাস্তায় বুদ্ধদেব বসু পেছন থেকে ডেকে তাঁর সাড়া পাননি— এমন ঘটনাও আছে। পাশাপাশি গণেশ অ্যাভিনিউতে হেঁটে দেখেছি একটি কথাও বলছেন না বা হঠাৎ কী মনে হওয়াতে জোরে হেসেই উঠলেন হয়তো।...” এই অন্তঃস্রোতে চিন্তার নানা স্ফুলিঙ্গ কবিতার নকশা পেতে থাকে। জীবনানন্দ কবিতাকে চাকচিক্যময় উপভোগের বা রক্তিম প্রত্যয়মূলক যান্ত্রিক আশাবাদের নামতা হিসাবে দেখতে চাননি। প্রতিটি অক্ষরে তিনি সিঞ্চিত করেছিলেন অস্তিত্বের স্পন্দন আর শিহরন। অদ্ভুত সব চরিত্র, তুলনাহীন সব অন্তর্দৃষ্টি, অত্যাশ্চর্য সব দার্শনিকতা, চূড়ান্ত শ্লেষ আর উদগ্র ভালবাসা, ক্ষতবিক্ষত হাসি আর অগ্নিপরিধির উপাসনায় অত্যুজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর লেখালিখি। এখানেই তাঁর সিদ্ধি এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী একক নিশান। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। এ অর্থেও নির্জনতম কবি।
জীবনানন্দ যে আধুনিকবাদী কবিতার আগমনী শোনালেন, সময়ের থেকে তার অগ্রগতি ছিল বহুযোজন বেশি। তাঁর পঙ্ক্তিগুলি হয়ে উঠছিল দীর্ঘ, যতিচিহ্নে মন্থর, খণ্ডে-খণ্ডে ভাঙা, পতন অভ্যুদয়ে বন্ধুর। কেননা নিশ্চিত কোনও দর্শনে বা অন্তিমে সহজ-সরল আস্থা রেখে তাঁর কবিতা একবগ্গা নয়। সংশয়-সন্দেহ, চাপান-উতোর, প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন, বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে পা তোলা পা ফেলা! ‘কোনো নিশ্চয়তা কে জানিতে পারে আর?’ অন্য দিকে, শ্রেষ্ঠ কবিতা-র ভূমিকায় খুব স্পষ্ট করে জানাচ্ছিলেন, “...কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার।” শঙ্খ ঘোষ তাঁর প্রবন্ধ ‘সময়ের সমগ্রতা’-য় দেখিয়েছেন, সরল প্রগতিতে নয়, বরং পাতাল-পৃথিবী-নীলিমাকে জটিল সমন্বয়ে বাঁধতে চেয়েছেন জীবনানন্দ। ফলে তাঁর লেখায়, ‘মানবকাল ব্যক্তিকাল বিশ্বকাল— সমস্তই থাকে একসঙ্গে মিশে...’। আমি বিনীত প্রস্তাবে যোগ করতে চাইব— মহাসময় বা কালহীনতার প্রসঙ্গও। সূর্য প্রদক্ষিণকারী গ্রহ থেকে কালের নির্দিষ্ট ধারণা সম্ভব, কিন্তু, মহাবিশ্বে মহাকাশে সেই ধারণা বা গণিত নেই। “এইসব সিঁড়িগুলো পার হয়ে শেষে/ আদি শূন্য সিঁড়িতে দাঁড়াবে ফের এসে।/ জীবনের সময়ের বিশ্বের এই এক মানে/ পথ ছাড়া নেই কিছু অনন্ত পথের অন্তর্ধানে।” (বাইরে হিমের হাওয়া)।
মহাসময় থেকে খণ্ড সময়ের দিকে তাকালেও মনে হয় জীবনানন্দের অত্যাশ্চর্য অবলোকন ইতিহাসের বাঁকে-বাঁকে বিস্ময়চিহ্নের মতো ফুটে আছে। বহুপঠিত ‘রাত্রি’ কবিতাটিতে যেন দিনের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে কলকাতার রাত্রি। সে শহরের দখল নেয় নিম্নবর্গ। কেউ কুষ্ঠরোগী, কেউ ইহুদি রমণী, কেউ লোল নিগ্রো। এই প্রান্তিকদের ভিড় করে দল বেঁধে নামার মধ্যে হঠাৎ ঘটে এক ‘রাজনৈতিক’ ঘটনা। “তিনটি রিক্শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাসল্যাম্পে/ মায়াবীর মতো জাদুবলে।” ঔপনিবেশিক কলকাতার হাতে টানা কালামানুষের রিকশা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ‘জাদুবলে’, ‘গ্যাসল্যাম্পে’। এ যেন তৃতীয় বিশ্বের সমাজ-অর্থনীতির এক ঐতিহাসিক পথপরিক্রমার বিবরণ! বিশ শতকের থেকে এ সব অভাবনীয় পর্যবেক্ষণ পাড়ি দেয় একুশ-বাইশ শতকের দিকে।
ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের নিরিখে মনে হয়, সমগ্র জীবনানন্দ সৃষ্টির অন্তরলোকে আছে অদ্ভুতরসের প্রাধান্য। অদ্ভুতরসের স্থায়ীভাব বিস্ময়, বর্ণ পীত। তাঁর কবিতায় পীত বা হলুদ রং ফিরে ফিরে আসে। এই স্বপ্নদর্শন, এই পরাবাস্তবীয় অপার্থিব, এই ভাষা, এই তৃতীয় নেত্রের বিস্তার— যে কোনও পরবর্তী কবির কাছে শুধু ঈর্ষণীয় নয়, অনুকরণযোগ্য। জীবনানন্দ জানতেন, “মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো/ না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল;/ জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।” লিখেছিলেন, “আকাশে সূর্যের আলো থাকুক না— তবু—/ দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে।/ আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই/ মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে।”
এ সবই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সীমাহীন আধুনিকতায় কীর্ণ। যে কোনও পরবর্তী কবির কেঁপে ওঠা। সাধনা। অভীপ্সিত শিখর। আত্মখনন। অন্তর্দীপ্ত হওয়ার সময়। নিজস্ব পথসন্ধানেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy