Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
হ্যারি বেলাফন্টে মানে পাহাড়ভাঙা প্রতিবাদের গান
Harry Belafonte

কালো মানিক জ্বলে

একটা ভরা মেহফিলের রেস্তরাঁয় এক দল কালো মানুষ বাজনা বাজিয়ে গান গাইছেন। রেড ওয়াইনের রংকে আসলে ঠাট্টা করছে তাঁদের জামরঙা ঠোঁট।

An image of the Harry Belafonte

যোদ্ধা: হ্যারি বেলাফন্টে (১৯২৭-২০২৩)। ছবি: গেটি ইমেজেস।

দেবজ্যোতি মিশ্র
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৩ ০৫:০০
Share: Save:

গানের ও-পারে আজ বহু মানুষের ভিড়। তাদের এক অদ্ভুত বাজনাহীন সঙ্গীত উতরোল করে দিচ্ছে সমুদ্রের নোনা বাতাস। গাঙচিলের সোনালি ডানার রোদের গন্ধে মিশে যাচ্ছে গসপেল নিগ্রো ভয়েস-এর উঁচু-নিচু কোরাসের প্রতিধ্বনি। আজ কিসের উৎসব? পাখিরা হাজার-হাজার কালো মানুষের কণ্ঠে উত্তর দিল, কিংস্টন টাউনের এক প্রবাসী হ্যারি— হ্যারি বেলাফন্টে— ফিরে আসছেন তাঁর প্রথম কিশোরীর কাছে, আজ প্রথম ঘুম ভাঙছে ভোরের।

প্রিয় হ্যারি, তোমার কি মনে পড়ে, গভীর ঘুমের কোল থেকে সেই প্রথম জেগে ওঠার কথা? সেই যে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে কত না পাহাড় আর সূর্যোদয়, কত অজস্র বন্দর আর নোঙর পেরিয়ে জাহাজ এসে ভিড়েছিল আমেরিকায়। সে দিন বন্দরে নেমেছিলেন এক দল নিকষ কালো মানুষ। হ্যারির পূর্বপুরুষ তাঁরা। এক সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশের মাটিতে, বন্দরের নানান মানুষের বিদেশি উচ্চারণ, কোলাহল, সমুদ্রের গর্জন আর সম্মিলিত পায়ে কাঠের তক্তার উপরে ওই ধুপ-ধাপ আওয়াজে তাঁরা তৈরি করলেন এক আশ্চর্য সঙ্গীত।

সেই সঙ্গীতের আলোতেই চোখ ঝলসে গেল সাদা চামড়ার মানুষদের। আমেরিকা। সে এক আশ্চর্য দেশ— যে দেশে শো-কেসে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা হয় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সত্যাগ্রহ, আমেরিকান সৈনিকদের রাইফেল আর বব ডিলানের গিটার। ওই শো-কেসটার মধ্যেই এক দিন অসাবধানে জ্বলে ওঠে চকমকি। এক-এক জন হ্যারি আমেরিকার ক্যাপিটালকে সুন্দর থালায় সাজিয়ে পরিবেশন করেন নারকেল গাছের ঝিরিঝিরি হাওয়ায়, সোনালি সৈকতস্বপ্নে অথবা স্বপ্নহীনতায়...

একটা ভরা মেহফিলের রেস্তরাঁয় এক দল কালো মানুষ বাজনা বাজিয়ে গান গাইছেন। রেড ওয়াইনের রংকে আসলে ঠাট্টা করছে তাঁদের জামরঙা ঠোঁট। সেই ঠোঁটের ট্রাম্পেটের আর্তস্বরে ককিয়ে উঠছে ব্যথার বিলাপ। মানুষের গান। মানুষের সব পদানত অধিকারই ওই ট্রাম্পেটের চোঙার মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে যেন। ট্রাম্পেট বাজাচ্ছেন মাইলস ডেভিস। স্যাক্সোফোনে চার্লস পার্কার, ড্রামে ম্যাক্সওয়েল রোচ। অভিনয়ের ইস্কুলে ভর্তি হবেন বলে টাকা রোজগারের ফিকিরে হ্যারি ঢুকে পড়লেন এই আসরে। আর, কী করে যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি জেগে উঠল হ্যারির। জেগে উঠল ক্রোধ, রাতের অন্ধকারে কৃষিখামারে অথবা বন্দরে সমাগত কালো মানুষের শিকড় ছেঁড়া যন্ত্রণা থেকে উঠে আসা অঙ্গার।

পল রোবসনের ‘ওল্ড ম্যান রিভার’-এর স্রোতে এই ভাবে যে ক্যারিবিয়ান সাগর তার সমস্ত পেশি ফুলিয়ে নেচে উঠবে, তা এর আগে কেউ কি জানত? পল রোবসন, যিনি হ্যারির মেরুদণ্ডকে বেঁধেছিলেন শক্ত কড়া-ধরা হাতের গিঁটে। চোখ খুলে দেওয়া অধিকারবোধে জেগে উঠলেন হ্যারিও। সত্যিই তো! এই মিসিসিপি নদী তো তাঁরও, তাঁর পূর্বপুরুষদেরও। এই নদী তো আবহমান কালের মানুষেরই মতো— মূক, শুধু ভেসে চলেছে নানান ঘাট-বন্দর আর পরিণতি বেয়ে। এই চলাই সেই অদ্ভুত কথাটা মনে করিয়ে দেয়। চার্লি প্রাইডের গান থেকে ছিটকে আসে অনুভব— ‘রোল অন মিসিসিপি, রোল অন’। আমেরিকা ফর অল! কতটা সত্যি সেই কথা? আসলে তো ‘আমেরিকা ফর আমেরিকানস’।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র! যাঁকে মানবাধিকারের লড়াইতে অর্ধেক জীবনই কাটাতে হয়েছে কারাগারে, সেই রাজাকেই কি এই ক্যাপিটাল-সর্বস্ব আমেরিকা নিজের করে ভেবেছে? হ্যারি এসেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কাছেই। তাঁর আলোই ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের লাল টুকটুকে সূর্য এঁকে দিয়েছিল হ্যারি বেলাফন্টের আত্মায়, শিকড়ে।

হ্যারির কাছে মাটির সঙ্গীতই হয়ে উঠল প্রতিবাদের হাতিয়ার।

হ্যারি গাইলেন তাঁর ক্যালিপসো! এই ক্যালিপসোর হাত ধরেই হ্যারি হয়ে উঠলেন একটি জনপ্রিয় নাম। একটা ব্র্যান্ড। তাঁর কোটি কোটি রেকর্ড যখন বিক্রি হতে থাকল, ঠিক সেই মুহূর্তেই কালো মানুষের চেপে রাখা কান্নার দীর্ঘ ইতিহাসের শোধ তোলার কাজ শুরু করলেন হ্যারি। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুঁজি হয়ে দাঁড়াল তাঁরই জনপ্রিয়তা। নাগরিক অধিকারের লড়াইয়ের এক প্রবাদপুরুষ এই খ্যাতিকে— তাঁর অসামান্য স্টেজ প্রেজেন্সকে— আজীবন ব্যবহার করে গেলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। জনতার কণ্ঠে গর্জে উঠলেন হ্যারি। গাইলেন, “অ্যাঞ্জেলিনা, অ্যাঞ্জেলিনা, প্লিজ় ব্রিঙ্গ ডাউন ইয়োর কনসার্টিনা, অ্যান্ড প্লে আ ওয়েলকাম ফর মি, কজ় আই’ল বি কামিং হোম ফ্রম সি।” এই ঘর কোথাকার? সে তো আমেরিকাই! অর্থাৎ, স্বাগত জানাও ‘আমার’ ঘরে, আমারই দেশে! এ যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই বলে দেওয়া হল, এই দেশই আমার দেশ। আমাদেরও দেশ। হ্যারির মধ্যে থাকা আর এক হ্যারি মুচকি হেসে লিখে দিলেন আমেরিকান পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূলমন্ত্র— অন্যায়কে যদি ভস্ম করে দিতে না পারো, তবে তাকেই তৈরি করে ফেলো একটি পণ্য।

হ্যারির সেই গানটা মনে পড়ে: “ডে-ও, ডে-ও, ডে ইজ় আ ডে, ইজ় আ ডে, ইজ় আ ডে-ও, ডেলাইট কাম অ্যান্ড উই ওয়ান্ট টু গো হোম”? এ দেশে আসা ইস্তক, বেঁচে থাকার জন্যই ভাষাটা শিখে নিতে হয়েছে হ্যারিদের। ভাঙা ভাঙা ইংরেজির বোলে এক দল মানুষ ট্যালি ম্যান-কে ডাকছে। বলছে, কত কলার কাঁদি বেঁধেছি তার হিসাব নাও গো, ভোর তো হয়ে এল, এ বার বাড়ি যাব। এই সাংঘাতিক গানটির কী আনন্দময় একটি ছন্দ! ঠিক যেন নেচে নেচে নিজের ব্যথার গান গাওয়া হচ্ছে। গানে এই খসখসে কিন্তু মুচমুচে গলা— হ্যারির প্রয়াণের পর জোন বায়াজ় আলাদা করে স্মরণ করলেন যে গলার কথা— যেন ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের তীরের নারকেল গাছের পাতা ঘষার আওয়াজ, সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ার পরে জল ফিরে যাওয়ার আওয়াজ, এ সব মিলে যে হারমনি তৈরি করেছে, সেটা একেবারে কালো মানুষের হারমনি। তার সঙ্গে এ-যাবৎ গাওয়া পশ্চিমি হারমনির কোনও মিল নেই। ব্যথার প্রদীপ নয় এ গান, বরং এ গান ব্যথার উদ্‌যাপন। “ওয়ার্ক অল নাইট অন আ ড্রিঙ্ক অব রাম, স্ট্যাক বানানা, টিল দ্য মর্নিং কাম...।” কী আশ্চর্য ভাবেই না নিজেদের অবস্থানটা স্পষ্ট করে দেওয়া হল— বেশি চাইছি না তো একটুকুও, তবে আমার যতটুকু দরকার, ততটুকু আমি ছেড়ে দেব না নিশ্চয়ই!

এই সব গান আমি কত পার্টিতে বেজে উঠতে শুনেছি। এই সব গান গেয়ে যখন টলোমলো পায়েরা নেচে উঠেছে, তখন তারা যেন ব্যঙ্গ করেছে নিজেদেরই। তাদের সেই মাতাল শরীরের হিল্লোলে, তাদেরই অজানতে, হ্যারির দামাল ঢেউ ক্যাপিটালের কাছে বার বার জবাবদিহি চেয়ে গিয়েছে। সে ছিল এক প্রতিবাদের অগ্নিহিন্দোলের সময়কাল। হ্যারি বেলাফন্টে তাঁর পাহাড়ভাঙা তীক্ষ্ম স্বরেই লিখে গেলেন তাঁর আমৃত্যু প্রতিবাদ। তাঁর গলা থেকে বুক অবধি নেমে আসা জামা তাঁর কালো রংকে ছুড়ে দিল সাদা মানুষদের দিকে।

আজ বিশাল এক শোক-মিছিলের মুখে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে এক জন ছোট্ট হ্যারি। তার সেই রেস্তরাঁর সব ক’টা আলো আজ একটু বেশিই নিবু-নিবু। এক জন হ্যারির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে আর এক জন হ্যারি, তার মধ্যে থেকে আর এক জন হ্যারি! অগণন হ্যারির যাত্রার মধ্যে মিশে গেল অতলান্তিকের ঘূর্ণিপাক, সমুদ্রঝঞ্ঝা আর ‘ল্যান্ড হো’। জেগে উঠছে কালো মানুষের স্বপ্নের দেশ। শিকড়ের ডানা গজাচ্ছে এ বার। রুটস মিউজ়িকের সুতো কখন যেন আছড়ে পড়ে আফ্রিকায়, এশিয়ায়। কিংস্টন টাউন বলে একটা জায়গা আমাদের কলকাতাবাসীদেরও বুকের মাঝখানে রয়েছে। হ্যারির জাহাজি হাঁকে আমরা যে কোনও মুহূর্তে পৌঁছে যেতে পারি আজ-কাল-পরশুর প্রান্তে। কারণ হ্যারিই বলেছেন, দরিদ্র মানুষ তার বিপন্নতাকে ভাগ করে নিতে ভয় পায় না, সে সমব্যথী হওয়ার সাহস রাখে, যা কোনও ধনীর পক্ষে ভাবাও অসম্ভব।

এ তো আপনিই শিখিয়েছেন, হ্যারি! আপনিই এ কথা হাসতে হাসতে মনে করিয়ে দেন। আমরাও হাসতে থাকি, দুলতে থাকি আমাদের মনের ভিতরকার ক্যারিবিয়ান-তরঙ্গে... ‘ডে-এ-এ-এ ও’... দিন ফুটে উঠছে ক্রমশ... দিন...

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy