—ফাইল চিত্র।
বছরশেষে ফিরে দেখি, মহাসমারোহে চিতা প্রত্যাবর্তনের বছরখানেক পরে প্রকল্পটিতে কেবল হতাশারই ছায়া। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি কালপর্বে নামিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা ২০টি পূর্ণবয়স্ক চিতার ছয়টি এবং ভারতে জন্মানো চারটি শাবকের তিনটিই মারা গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রথম বছরে ৫০% চিতার মারা যাওয়ারই কথা। গ্রামীণ বাস্তুতন্ত্রের পুনঃ-অরণ্যায়ন ঘটিয়ে মাংসাশী প্রাণীর আন্তর্মহাদেশীয় স্থানান্তরণ যেমন প্রশংসনীয়, তেমনই চ্যালেঞ্জিং। গবেষণা জানিয়েছে, দেশে বহু পূর্বে মাংসাশী প্রাণীর আন্তর্দেশীয় স্থানান্তরণ সফল হয়েছে। এমনিতে গুহাচিত্র, সংস্কৃত নামকরণে প্রমাণিত যে, আদিম ভারতেও চিতা ছিল। তবে, জিন বিশ্লেষণে ভারতের কিছু প্রাণীর সঙ্গে ইথিয়োপিয়ার জীবকুলের জিনসাদৃশ্য মিলেছে। হয়তো ইথিয়োপিয়া থেকে ইরান (তখন পারস্য) হয়ে কিছু পশু ভারতে এসেছিল। জঙ্গল থেকে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে, বাণিজ্যিক সূত্রে, কিংবা রাজারাজড়ার ভেট হিসাবে। যেমন চিতা, হায়েনা, সিংহ। কালক্রমে এরা দেশের জীবকুলে মিশে গিয়েছিল। অর্থাৎ, উপমহাদেশে মাংসাশীর পুনর্বাসন অসম্ভব নয়। তবে, সে যুগের পর দেশের ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত পরিবর্তনগুলির সাপেক্ষে প্রকল্পের পদ্ধতিটি শুধরে এগোতে হবে। দেশে গত ৭০ বছর চিতা নেই, তাই নেই চিতা বিশারদও। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনে প্রকল্প নিয়ে লড়ছেন আমাদের প্রাণিবিজ্ঞানীরা।
তাঁরা কিন্তু আশাই দেখছেন। চিতারা শিকার পাবে না, অন্য পশুরা তাদের মেরে দেবে— এই আশঙ্কা মেলেনি। কিন্তু, প্রাণহানি ঘটেছে অজ্ঞতা ও অব্যবস্থায়। দক্ষা মারা গিয়েছে পুরুষ চিতাদের সঙ্গে মারপিটে। ঘেরাটোপের মধ্যে চিতাদের প্রেম-ভালবাসায় বনিবনা না হওয়ারই কথা। তাই, পশুগুলি আসামাত্রই বংশবৃদ্ধিতে উদ্যমী না হয়ে, নারী পুরুষদের তফাতে রাখলেই হত। শাবকেরা জন্মানোর সময় প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত ছিল না। সরকারি যুক্তি, চিতার ছানাদের মৃত্যু হার ৯০%। এটি জঙ্গলের হিসাব। বন্দি অবস্থায় চিতার প্রজনন বিরল, কিন্তু হলে নজরদারির নিরাপত্তায় বাঁচার সম্ভাবনা ৭১%-এরও বেশি। চিতাগুলি আফ্রিকার শীতে অভ্যস্ত। ভারতে প্যাচপেচে গরম। বেচারারা ঘেমেনেয়ে চুলকে-ঘষে ঘা করে ফেলছে, সেপ্টিসিমিয়ায় মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। সময়ে সজাগ হলে, ওষুধেই সেরে যেত!
কুনোয় জায়গার অভাব— অভিযোগটিতে সিলমোহর দিয়েছে পশুদের এলাকা দখলের লড়াই, ওবানের গ্রামে আর অগ্নির রাজস্থানে ঢুকে যাওয়ার ঘটনা। গান্ধীসাগর, নৌরাদেহি অভয়ারণ্যকেও প্রস্তুত করা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই চেষ্টাগুলি কি যথেষ্ট? শুধুই দু’-একটি বনাঞ্চলে স্থানাভাব মিটবে না। আরও কয়েকটি সম্ভাব্য বাসস্থানকে একত্র করে একটি বড় বিচরণক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। অন্য দিকে, ‘মউ’ অনুযায়ী পরের চিতাদল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই আসবে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্রমশ এদের লোম উপমহাদেশীয় জলবায়ুর উপযোগী হবে। কিন্তু, সেই ‘বিবর্তন’-এ কত প্রজন্ম লাগবে, জানা নেই। পশুরা কিডনির অসুখে, হার্টফেল করে মারা গেলে সরকার পুনর্বাসনের ধকলকে দুষেছে। বলেছে, আফ্রিকা থেকেই অসুখ নিয়ে এলে কী করা যাবে!
বস্তুত, ‘প্রজেক্ট টাইগার’-এর সাফল্য দিয়েই ‘প্রজেক্ট চিতা’র গুরুত্ব বোঝা যায়। বাঘ সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে গোটা বাস্তুতন্ত্রই লাভবান। বনবাস্তুতন্ত্রের নিয়মে খাদ্যশৃঙ্খল সর্বোত্তম অবস্থায় থাকলে তবেই ‘শীর্ষ শিকারি’ ভাল থাকবে। অর্থাৎ চিতারা থাকলে কৃষ্ণসাররা সাবাড় হবে না, তাদেরও সংরক্ষণ হবে। আদ্যিকাল থেকে চিতাদের তাড়া খেয়েই তো তাদের গতি বেড়েছে। চিতা থাকলে ঘেসোজমি, পর্ণমোচী জঙ্গলও বাড়বে। বনসম্পদকে ঘিরে মানুষও বাঁচবে। প্রকল্পকে কেন্দ্র করে পর্যটনের প্রসার হলে এলাকায় সুযোগ-সুবিধা মিলবে।
এই মুহূর্তে বন দফতর, এলাকার মানুষ, সংরক্ষিত অরণ্য— কিছুই চিতার জন্য প্রস্তুত নয়! সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই সরকারগুলি চিতা ফেরানোর চেষ্টা করলেও সেই প্রয়াস আটকেই গিয়েছে বার বার। ইরানের এশীয় চিতা ভারতীয় চিতার জাতভাই, এখানে মানিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। শেষ কংগ্রেস সরকার ইরান থেকে চিতা আনতে তৎপর হলে ইরান সরকার পরিবর্তে চেয়েছিল গুজরাতের এশীয় সিংহ। বহু বার সাবধান করা হয়েছে, গিরের সিংহগুলির একটি দ্বিতীয় বাসস্থান প্রয়োজন। নইলে তারা মড়কে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই কুনো পালপুরের ঘাসপাথরের জঙ্গলটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গুজরাত সরকার মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে সিংহগৌরব ভাগাভাগিতে রাজি হয়নি। পাশের রাজ্যেই যারা সিংহ ছাড়ে না, তারা অন্য দেশে সিংহ পাঠাবে কী করে! এই নিয়ে আইনি যুদ্ধে হেরে, গুজরাত রাজনীতির তির ছুড়েছে: কেন্দ্রে-রাজ্যে তাদের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার। ব্রিকস-এর সদস্য হওয়ায় আফ্রিকার দেশগুলি থেকে চিতা পাওয়া সহজ। সিংহও দিতে হল না, দেশের মানুষকে কুমিরছানা মানে চিতা দেখানোও হল।
‘রাজনৈতিক কারণ’-এই চিতা প্রত্যাবর্তন, রাজনৈতিক কারণেই প্রকল্প চালনায় বিস্তর ফাঁক। মাঝখান থেকে প্রাণীদের অকারণ হেনস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy