—প্রতীকী ছবি।
দিদিমণি ক্লাসে যান। ক্লাস করান। ফিরে আসেন। আগে ক্লাস থেকে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। এখন আর করেন না। এখন শুধু চক ডাস্টার রেখে বিষণ্ণ ভাবে বসে পড়েন। বিষণ্ণতার কারণ, অধিকাংশ দিনই শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ-ছয় জন। কোনও কোনও দিন আরও কম। কেন? কারণ শিক্ষার্থীদের সমাজ বুঝিয়ে দিয়েছে স্কুলে গিয়ে লাভ নেই। ‘বাড়ির স্যর’-এর কাছে পড়তে যেতে হবে। এমনকি বাড়িতে বসেও পড়া যায়। স্কুলে যাওয়া মানে ‘সময় নষ্ট’।
স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে সমালোচনার অধ্যায় বিরাট। শিক্ষকের অভাব, শিক্ষকের অনাচার ইত্যাদি নিয়ে বহু আলোচনা, লেখালিখি। এ দিকে বীক্ষণ যন্ত্রের মুখটা যদি শিক্ষক, সরকার বা শিখন-শিক্ষণ তত্ত্বের দিকে বেশির ভাগ সময় ঘুরে থাকে, এই সত্যটি তার ফাঁক দিয়ে পালিয়ে যায় যে স্কুলের প্রতি ছাত্র, অভিভাবক এবং বৃহত্তর সমাজেরও কিছু দায় থাকে। সেই দায়টুকু স্বীকৃতি না পেলে শুধুই সমালোচনা হয়, পরিবর্তনের দিশা পাওয়া যায় না। সব স্কুল শিক্ষক-শূন্য নয়, সব শিক্ষক ফাঁকিবাজ নন, সব শিক্ষক ‘বাড়ির স্যর’ হন না, সব শিক্ষক ‘অত্যাচারী’ও নন। কিন্তু সেই সব শিক্ষাদরদি শিক্ষক-শিক্ষিকাও কি নিশ্চিন্তে শিক্ষাদান করতে পারবেন, যদি শিক্ষার্থী ও তার পরিপার্শ্ব স্কুলের পাশে সমানুভূতি নিয়ে না দাঁড়ায়? নেতিবাচক নানা অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীর তরফ থেকে নিয়মানুবর্তিতা, মনোযোগ, শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা-ভালবাসা না থাকলে শিক্ষার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শক্ত।
সম্প্রতি কলকাতার এক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের চিঠি লিখে অনুরোধ করেছেন, স্কুল চলাকালীন সেই স্কুলের ইউনিফর্ম পরে ছাত্রছাত্রীরা যেন নিকটবর্তী মল-এ অভিভাবকের সঙ্গ ছাড়া না যায়। কারণ তারা স্কুলের পোশাকে সেখানে উপস্থিত হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করছিল বলে অভিযোগ আসছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, স্কুলের পোশাক, স্কুলের সম্মান ইত্যাদির বিষয়ে শিক্ষার্থীকে স্কুল নিজেই কেন সচেতন করতে পারেনি? কেন এই কাজের জন্য তাঁদের চিঠি লিখে অভিভাবকদের জানাতে হচ্ছে? এই ব্যর্থতাকে অস্বীকার না করেও বলতে হবে— স্কুলশিক্ষায় কিন্তু অভিভাবকেরও অংশ থাকে। শিক্ষক-ছাত্র-সমাজ এই ত্রিভুজের একটি ভুজ দুর্বল হলেই শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে আর সেই ভাঙনের অবশেষে শুধু শিক্ষক নন, শিক্ষার্থীও চাপা পড়ে যায়। এই পত্রলিখন প্রচেষ্টার আগে স্কুল কি ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করেনি? সে সচেতনতার বার্তায় কি সাড়া মিলেছিল?
শারীরিক বা মানসিক ভাবে শিক্ষার্থীকে আঘাত করা গুরুতর অন্যায়। শাসন-এর নামে নিপীড়নের ইতিহাস সত্যিই দীর্ঘ। কিন্তু বাড়াবাড়ির ভয়ে শাসন থেকে শিক্ষকদের বিরত থাকার সঙ্কটও কম নয়। শাসন করতে গেলে প্রথমেই তাঁদের অভিভাবকদের রোষে পড়তে হয়। আজকাল লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক উৎসাহদান চলে— ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজসাথী’ তো আছেই, পোশাক, খাতাবই, ট্যাব ইত্যাদিও আছে। এই সব কিছুর সঙ্গে শিক্ষা, বিনয়, নিয়মানুবর্তিতার মতো ইতিবাচক গুণগুলিও কি তার অর্জন করার কথা নয়?
অথচ ফাঁকা ক্লাসরুম সমানেই একাদশ-দ্বাদশ থেকে ক্রমশ সপ্তম-অষ্টমে নেমে আসবে। ছাত্রছাত্রীরা হয় আসবে না, অথবা ইউনিফর্ম পরেই স্কুলের বাইরে ঘুরবে। দিদিমণি ‘প্রোজেক্ট’ জমা নিতে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে বেড়াবেন, অভিভাবকের বাড়িতে ফোন করবেন। সরকার নির্দেশিত উপস্থিতির ধারকাছেও থাকবে না শিক্ষার্থীরা। অভিভাবক সন্তানের পক্ষেই দাঁড়াবেন। তিনি ভুলে যাবেন, স্কুলজীবনে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করতে গিয়ে তার ভবিষ্যৎ জীবনের কত বড় ক্ষতি তিনি নিজেই করলেন।
সংবিধান দিক না দিক, ‘শিক্ষার অধিকার’ সকলের আছে। যে ছাত্র নিয়মানুবর্তী নয়, এমনকি যে স্কুলকে সম্মানের চোখেই দেখে না, স্কুলের সমস্ত দরজা তার জন্যও খোলা রাখতে হবে। তার উপলব্ধিগত ব্যর্থতার দায় শিক্ষকের উপরেও সমান ভাবে বর্তায়। কিন্তু এই ব্যর্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচেষ্টায় অভিভাবকরা কি শিক্ষকদের সহযোগিতা করেন? শুধু ইউনিফর্ম নয়, স্কুলের নির্দিষ্ট আচরণবিধি, মিড-ডে মিল ব্যবস্থা, এই সব কিছুই শিক্ষার্থীকে বৃহত্তর সমাজের নাগরিক হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে। সরকার তাদের একই রকম পোশাক বা অন্যান্য জিনিসপত্র পাঠায় এই কারণে যে, তাদের মধ্যে যেন সব দিক দিয়ে সাম্য ভাব বজায় থাকে। ছাত্রছাত্রীরা যদি এই দর্শনটি না-ও বোঝে, অভিভাবকের তো তা বোঝা উচিত!
শাসন-এর রক্তচক্ষু দ্বারা ছাত্রছাত্রীকে যেমন স্কুল থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া চলে না, সোহাগ-এর বল্গাহীন স্বাধীনতা দিয়েও ছাত্রছাত্রীর স্বেচ্ছাচারিতা-কে অফুরন্ত প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। এই দুইয়ের আনুপাতিক হার যথাযথ রাখার জন্য শিক্ষক এবং অভিভাবক, দু’পক্ষকেই সমান উদ্যোগী হতে হবে। সেই পরিবেশ গঠন করতে হবে যেখানে শিক্ষকরা খোলা মনে শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়নে ব্রতী হন, আর সেই সাধু উদ্যোগের প্রতি অভিভাবক তথা সমাজ সমর্থন এবং সহযোগিতা জানান।
অভিভাবকদের জন্যও শিক্ষা দফতর প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারে না? সন্তানের আচরণকে স্কুলে এবং তার বাইরেও ইতিবাচক দিকে পরিচালনা করতে এমন প্রশিক্ষণ কিন্তু আবশ্যক হয়ে পড়ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy