Advertisement
০৮ জানুয়ারি ২০২৫
একই সঙ্গে বহু চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে ‘জাতীয় স্বার্থ’
Indian Foreign Policy

অথ সঙ্কটলগ্নে উপনীত

দর্শন হিসাবেই একে নিন, বা বিশুদ্ধ হাস্যরস, পঁচিশের শুরু নিয়ে কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো হইহই নেই ইতিহাস আর আভিজাত্য মোড়া সাউথ ব্লকের খিলানে।

গোপনালাপ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লি।

গোপনালাপ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লি। —ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৪১
Share: Save:

বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর তিনি, শিবরাম চক্রবর্তী, এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে “নতুন বছর, নতুন বছর বলে খুব বেশি হৈ চৈ-এর কিছু নেই! কারণ যখনই কোনও নতুন বছর এসেছে, তা এক বছরের বেশি টেকেনি!”

দর্শন হিসাবেই একে নিন, বা বিশুদ্ধ হাস্যরস, পঁচিশের শুরু নিয়ে কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো হইহই নেই ইতিহাস আর আভিজাত্য মোড়া সাউথ ব্লকের খিলানে। বরং বিদেশ মন্ত্রকের পায়রাভরা কার্নিস ও করিডরে জানুয়ারির কনকনে হাওয়ায় তুলোর মতোই অনিশ্চয়তার বীজ ভাসছে যেন। ২০২৫ এক বছরের বেশি টিকবে না তো বটেই, কিন্তু কেমন ভাবে কাটবে এই বছর? সব মিলিয়ে কেমন ভাবেই বা কাটছে কুড়ির দশক এই গ্রহের, যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে সংলগ্ন আমাদের বিদেশনীতি? জীবনানন্দের লাইন মনে করুন পাঠক, “অনেক নদীর জল উবে গেছে---/ ঘর বাড়ি সাঁকো ভেঙে গেল/সে-সব সময় ভেদ করে ফেলে আজ/কারা তবু কাছে চলে এল।”

কারা কাছে চলে এসেছে আর সভ্যতা শিউরে উঠছে বার বার ত্রাসে, আতঙ্কে, এই ‘বিশ’-এর বিষপান করে? অতিমারির ভয়ঙ্কর মুখব্যাদান দিয়ে যার আলাপ শুরু, টলমল অর্থনীতি, স্বাস্থ্যপরিকাঠামো, খাদ্যসঙ্কট, সারের ঘাটতি দিয়ে তার বিস্তার, ইউক্রেন-গাজ়ার শ্মশানবাজনে তার ভয়ঙ্কর ঝালা। গাজ়া, লোহিত সাগর, লেবানন, ইরান এবং সিরিয়া লন্ডভন্ড করছে সভ্যতার প্রসাদ, সাধারণ মানুষের আয়ু, স্মৃতি। আর এই সব ঘটনার ঢের আগে থেকেই বিশ্বের অর্থনীতি, কৌশলগত গুরুত্ব, সামরিক মহড়ার কেন্দ্র, অতলান্তিক মহাসাগরের সমান্তরালে তৈরি হয়েছিল ভারত প্রশান্ত মহাসাগরেও। চিন, ভারত এবং আরও কিছু রাষ্ট্রের ক্রমউত্থানের সৌজন্যে। তাই বিশ দশকে শুরু হওয়া অঘটনের ধাক্কাও এসে লেগেছে প্রশান্ত মহাসাগরে কিছু কম নয়।

পঁচিশের গোড়ায় এই জটিল সময়াবর্তে দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে বহু চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুঝে জাতীয় স্বার্থ কেড়ে আনতে হবে ‘বিশ্বমিত্র’ অথবা ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে স্বখ্যাত মোদী সরকারকে। আপাতত যার আপৎকালীন দু’টি দিক নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক। প্রথমত, আমেরিকায় দ্বিতীয় ট্রাম্প যুগ শুরু হওয়া আর সময়ের অপেক্ষা। ট্রাম্পের ‘পরম মিত্র’ হিসাবে পরিচিত হলেও, ভারতের রক্তচাপ এখন ওয়াশিংটন প্রশ্নে ঊর্ধ্বমুখী। বড়দিনের ছুটি কার্যত বাতিল করিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে তড়িঘড়ি মোদী পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায়। শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ-বিতর্কের আঁচ ভারত এবং আমেরিকার সামগ্রিক কৌশলগত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পড়বে না বলে মাসখানেক আগে জানিয়েছিল বটে ওয়াশিংটন, কিন্তু সে যে নিছকই শিশুতোষ কথা, তা সাউথ ব্লকের পায়রাটাও জানে। মোদী সরকারের কোনও ‘দুর্বল বিন্দু’ যদি ট্রাম্পের হাতে থাকে, তা হলে ‘ডিল মেকার’ হিসেবে পরিচিত এবং দেনাপাওনার কূটনীতিতে বিশ্বাসী ট্রাম্প তা ছেড়ে দেবেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আদানির বিরুদ্ধে এই অভিযোগকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার সংস্থাগুলির জন্য আরও বেশি করে ভারতের বাজার খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করবেন না, এমন ‘গৌতম বুদ্ধ’, ডোনাল্ড ট্রাম্প নন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময়েই তিনি আমেরিকার পণ্যের উপরে শুল্ক বসানোর অভিযোগ তুলেছিলেন নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে। ভারত আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ‘বড় রকমের অপব্যবহার’ করে বলে অভিযোগও তুলেছিলেন। দু’হাজার পঁচিশ জুড়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির অট্টরোল শোনা যাবে তাতে সন্দেহ নেই। তাতে কাটা পড়তে পারে ভারত থেকে অটোমোবাইল, বস্ত্র, ওষুধ, ওয়াইন রফতানি অথবা ভিসা নীতি।

দ্বিতীয় দিক হল, প্রতিবেশী বলয়, প্রধানত ঢাকা। চব্বিশের জুলাই পর্যন্ত আমাদের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী বাংলাদেশ, এই বছরে কোন পথে হাঁটবে তার কূলকিনারা এখনও নেই। এর আগে গত ন’বছর ধরে (ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তির পর থেকেই) দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতীয় কূটনীতিকদের মুখে দু’টি বাংলা শব্দ ভুল উচ্চারণে শুনতে হয়েছে আমাদের। সেই শব্দদ্বয় হল ‘সোনালি অধ্যায়’। সেই সোনায় খাদ মিশে গিয়েছে অগস্ট মাস থেকেই। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে সে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়া এবং নৈরাজ্য শুরুর পর, দক্ষিণ এশিয়ার গজরাজ ভারত, নরেন্দ্র মোদী বিশ্বগুরু, সাউথ ব্লক বিশ্বমিত্র (আমেরিকা থেকে রাশিয়া সব ব্লক যাকে সঙ্গে রাখতে চায়)— এই যাবতীয় ভাবমূর্তি আহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তেইশে ভারতের দাবি ছিল, বিশ্বের কম আয়ের দেশগুলির সম্মিলিত স্বর তারা ইউরোপের দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। চব্বিশেও ব্রাজ়িলে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে এবং নাইজিরিয়া ও গায়ানা সফরে গরিবের মহাদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন মোদী। কিন্তু ২০২৪ সালের শেষপ্রান্তে এসে কার জোরে (বিশেষত যখন হোয়াইট হাউস থেকে ডেমোক্র্যাটরা প্রস্থানের পথে) এ ভাবে চোখে চোখ রেখে জবাব দিচ্ছে বাংলাদেশের এই ‘দুর্বল’ ইউনূস সরকার, তা যত দূর জানি, ভারতের এখনও অজানা। সম্প্রতি নড়ে বসে সাউথ দিল্লি খোঁজ নিতে শুরু করেছে, সামনে পাকিস্তানকে রেখে (যাদের নুন আনতে রুটি ফুরোনোর দশা) বেজিং কতটা কলকাঠি নাড়ছে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে হিন্দুরা আগেও অসুরক্ষিত ছিলেন, এখন অত্যাচারের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়েছে অবশ্যই। লুটপাট, নির্যাতন, বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে অপমান, অহিষ্ণুতা, পরিকল্পনামাফিক হামলার যে খবর প্রতিনিয়ত আসছে, তার অর্ধেকও যদি সত্যি হয় (বাংলাদেশের যে কোনও সমাজ রাজনীতির ভাষ্য একটু নুন না মিশিয়ে নেওয়া চলে না, সত্যে অসত্য মিশে থাকে) তা হলেও বলতে হবে সে দেশে হিন্দুরা গভীর বিপদে।

সেই সোনালি যুগেও হিন্দু নিপীড়ন, দুর্গাপুজো ঘিরে অশান্তি হাঙ্গামা, সিলেবাস থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাদ পড়ার মতো অভিযোগ খুব অপ্রকট ছিল না কিন্তু। হেফাজতের নরম মুসলিমত্ব কাজে লাগিয়ে সংখ্যাগুরু মন জয়ের চেষ্টাও শেখ হাসিনা সরকারের পুরোদমে ছিল। তখন বিষয়টি নিয়ে মোদী সরকারকে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি সঙ্গত কারণেই। ঘরের সামনের পড়শি, দীর্ঘ সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া, চিনের উদ্যত হাত আর পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদীদের গবেষণাগার তৈরির তুমুল সম্ভাবনাযুক্ত একটি রাষ্ট্রে যদি ‘বন্ধু সরকার’ থাকে, তা হলে কিছু ব্যাপারে চুপ করে থাকতেই হয়। তাও চুপ থাকেননি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’ বলে যথেষ্ট ঝামেলা পাকিয়েছিলেন দ্বিপাক্ষিক স্তরে, বিদেশ মন্ত্রককে নিশিলণ্ঠনের অধিক তেল পোড়াতে হয় সম্পর্ককে আবার সঠিক পথে আনতে।

কিন্তু এ বার বিদেশ মন্ত্রকই কার্যত দিশাহারা। এক সপ্তাহে চারটে কড়া বিবৃতি দেওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কাজ না হওয়া, শত চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশের সরকারের হিন্দু সন্ন্যাসীকে বন্দি করে রাখা, কাঠখড় পুড়িয়ে ভারতীয় বিদেশসচিবের ঢাকা সফর করে ইউনূসকে প্রচুর বুঝিয়ে আসার পক্ষকালের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর এত্তেলা দেওয়া— সাউথ ব্লকের সমানে সমানে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। শুধু দিচ্ছেই না, ঝুলি থেকে বেড়ালটাকে বার করে এনে মোদী সরকারকে বলছে, সংখ্যালঘু প্রশ্নে আপনি আচরি ধর্ম। ব্যাপারটি আর বিদেশনীতিতেই আবদ্ধ থাকছে না, সীমান্তবর্তী রাজ্যে এই মেরুকরণ নিয়ে রাজনীতির রুটি সেঁকছেন রাজ্যের শাসক এবং প্রধান বিরোধী পক্ষ।

২০২৫ সালের প্রারম্ভে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পঙ্‌ক্তি তুলে ভারতীয় বিদেশনীতির কাছে এই আশা রাখি— “যে কথা বলনি আগে-এ বছর সেই কথা বলো।” আর ওই কবিতারই অন্য একটি পঙ্‌ক্তি সামান্য বদলে সাউথ ব্লকের কাছে এই প্রশ্ন করি— পৃথিবীতে ঘটনার ভুল/ চিরদিন হবে/ এ বার পঁচিশে তাকে শুদ্ধ করে নেওয়া কি সম্ভবে?

উত্তর দেবে নতুন বছর।

অন্য বিষয়গুলি:

PM Narendra Modi Amit Shah Foreign Policy External Affairs ministry Central Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy