Advertisement
০৭ জানুয়ারি ২০২৫
RG Kar Protest

‘জেগে থাকাও একটা ধর্ম’

পাশা খেলায় দক্ষ শাসককুল তাঁদের আগুন ছাইচাপা দেওয়ার কাজে আপাত সাফল্যের মৌতাতে বিভোর। সব আওয়াজ নাকি থেমে গেছে। প্রতিবাদীদের পাল্টা শিক্ষা দেওয়ার সময় এখন।

অভিজিৎ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:১৭
Share: Save:

অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন, বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা শোক, ক্ষোভ এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রতারণার ক্ষত নিয়েই বাঙালির জীবনে নতুন বছর শুরু হল। ফেলে আসা বছরের শেষ কয়েক মাসে প্রত্যকের মনে আলোড়িত প্রশ্নগুলোর এখনও কোনও মীমাংসা হয়নি। দিন যত এগিয়েছে, ততই আশঙ্কা বেড়েছে যে, আর জি কর হাসপাতালের দুঃসহ বর্বরতার বিচার আদৌ হবে না। নিকষ কালো আকাশের আঁধার সরানোর লক্ষ্যে যাঁরা মুখর ছিলেন, তারা এখন ফুঁসছেন— সংশয় বুকে নিয়েই। পাশা খেলায় দক্ষ শাসককুল তাঁদের আগুন ছাইচাপা দেওয়ার কাজে আপাত সাফল্যের মৌতাতে বিভোর। সব আওয়াজ নাকি থেমে গেছে। প্রতিবাদীদের পাল্টা শিক্ষা দেওয়ার সময় এখন।

অচলায়তনের রক্ষকরা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলছেন, সময়ের অস্থিরতা নিবারণের বড় ওষুধ হচ্ছে কালক্ষেপ। তাঁদের বিশ্বাস, দুঃখ, ক্ষোভ, ক্ষত সব নিবিয়ে দেয় সময়। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, প্রতিবাদীকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করো রাস্তার কাদা ছুড়ে— সংবেদনশীল প্রতিবাদী এতে অবসৃত হবেন। এর পর অপেক্ষা করো সেই সময়ের জন্য, যখন নিরন্তর অবিচারের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বেশির ভাগ প্রতিবাদী পথ হাঁটার প্রেরণা হারাবেন। পাশাপাশি, দ্রুত এবং তড়িদ্গতিতে তৈরি করে রাখতে হবে ফাঁসির মঞ্চ— ‘অপরাধী’র শাস্তি হবেই, তার অলীক আশ্বাস। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদীরা প্রাতিষ্ঠানিক ধোঁয়ার সামনে পড়ে ক্রমশ ভরসা হারান। এক সময় তাঁরা ভাবতে শিখুন যে, প্রতিবাদের থেকে স্বস্ত্যয়ন ভাল। তবে, প্রতিবাদের আগুন কেন আর কী ভাবে জ্বলে, কী ভাবে বিস্ফোরণ ঘটে আপাত-নিরীহ ছাপোষা মনেও, সে হদিস অচলায়তনের চৌকিদারদের কাছে থাকে না।

৯ অগস্ট সকাল থেকেই চলমান বহু অনাচারেও মুখ বুজে থাকা সর্বংসহ প্রকৃতিসমৃদ্ধ এ বাংলার সমাজচিত্রটা হঠাৎই বদলে গেছিল। দুঃখের কোন সুর বাজলে বহু মানুষের হৃদয় এক সঙ্গে কাঁদে, তার কোনও নির্দিষ্ট সমীকরণ নেই। রাত দখল, লালবাজার ও স্বাস্থ্য ভবনে ক্লান্তিহীন অবস্থান, রাজপথ জুড়ে মানবশৃঙ্খলের শপথ, দ্রোহের উৎসব, যুব-চিকিৎসকদের অনশন, সব মিলিয়ে এ যেন ছিল প্রতিবাদের উৎসবের অঙ্গনে বাংলার পুরনো ইতিহাসকে ফিরে পাওয়া। ব্যথা থেকে প্রতিবাদে উত্তীর্ণ হয়ে বিচারের দাবিতে চোয়াল শক্ত উচ্চারণের প্রায়-ভুলতে-বসা ছবি নতুন করে দেখল বাংলা— সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।

পাশাপাশি দেখা গেল প্রশাসনিক শঠতা, ঘটনার গভীরতাকে হালকা করা ও দোষীদের আড়াল করার বিভিন্ন ফন্দিফিকির, ব্যবস্থা গ্রহণের ভান করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা যে, সরকার পরম স্নেহশীল। এবং দেখা গেল, যাদের উপরে ভরসা ছিল রহস্যের নিষ্পত্তি করার, তারাও কেমন গা এলিয়ে দিল তদন্তে। শোনা গেল, এমন সব প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, যাতে ভেঙে পড়বে দুর্নীতি আর প্রশাসনিক অবহেলার অচলায়তন। কোথায়? কয়েক জনকে কয়েক দিনের জন্য জেলে পোরা হল। তাঁরা জামিনও পেলেন। শেষ অবধি বিচার পাওয়া যাবে, এই আশা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এল। গ্রামে-শহরে দমবন্ধ করা ভয়ের পরিবেশ থেকে মুক্তির কামনায় যাঁরা পথে নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকেই সত্যিই এখন হতাশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতিবাদীদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করে শাসকের পাল্টা আক্রমণ শাণানোর নানা পদক্ষেপ।

এমন এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে আলোড়িত জনচিত্তের উল্টো দিকে অবস্থান নেওয়ার কোন তাগিদ ছিল প্রশাসনের, তা এখনও পরিষ্কার নয়। বর্বর হত্যাকাণ্ডের অপরাধী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও ‘আমরা করেছি, এ বার ওরা করে দেখাক’ বলার যে ভঙ্গিটি রাজ্যের প্রশাসন নিয়েছে, তাও মানুষকে সুরক্ষার অনুভূতি দেয় না। চটজলদি সিসিটিভি লাগানো, আর গন্ডাখানেক কমিটির ললিপপ ঝুলিয়ে ব্যবস্থার ত্বরিত উন্নতি করার ভানের অন্তঃসারশূন্যতাও স্পষ্ট। প্রশ্ন তাই থেকেই যায়— পাপ ঢাকার ও অপরাধীদের আড়াল করার এই চেষ্টা কেন? তারা কি প্রশাসনের আত্মার আত্মীয়? প্রশ্নগুলো থাকে, তাই মানুষের আশঙ্কাও থাকে।

আন্দোলন থমকে গেলে হায়েনার দল আবার জঙ্গলে ফিরবে, এ সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে বলেই রাত জাগার এখনও দরকার অনুভূত হচ্ছে। এ রাজ্যের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার সামগ্রিক অঙ্গনে লুটপাটের ও বিলিবণ্টনের যে মৌরসিপাট্টা প্রায় এক দশক ধরে কায়েম হয়েছে, তারই ফল তিলোত্তমার মৃত্যু। প্রসাধনী অদলবদল, কয়েক জন আধিকারিককে এ দিক-ও দিক করে, বা গন্ডাকয়েক কমিটির দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে এ রোগ সারবে না। তিলোত্তমার মৃত্যু যদি শেষ অবধি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রকৃত সংস্কারের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে, তা আসলে এক প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হবে— মানুষের রোষের মুখে সর্বাধিপত্যকামী শাসকের নতিস্বীকারের প্রতীক। গোটা রাজ্যের জন্যই সেই প্রতীকটি গুরুত্বপূর্ণ, কেবলমাত্র স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জড়িতদের জন্য নয়।

আন্তিগোনের পাথর চাপা আর্তির মধ্যে ছিল স্বৈরাচারী আত্মদুর্বল শাসকের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার ডাক। নন্দিনীর সুরে যমপুরীর পাহারাদাররাও আলোড়িত হত। রাজা হত সন্ত্রস্ত। এ রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অচলায়তনের অঙ্গনে তিলোত্তমার মৃতদেহ সেই আন্তিগোনে-নন্দিনীর আঁধার ভাঙার ডাক শুনিয়েছে। এখানে শোক থাকবে, তা প্রতিবাদের মশালে উদ্ভাসিত হবে। হতাশা, ‘কিছু হল না’ ভাবনার মালিন্য যেন এ পবিত্র প্রতিজ্ঞার দেহে ছোপ না ফেলতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

RG Kar Rape and Murder Case Doctors Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy