লোকগণনার হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের প্রথম দু’টি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত সম্প্রদায়ের দাবি বরাবর প্রাধান্য পেয়ে আসছে। সংখ্যায় বেশি উত্তরে রাজবংশী, দ্বিতীয় দক্ষিণের নমশূদ্র, দুটোর মাঝে বাদ পড়ে যাচ্ছে সংখ্যার দিক দিয়ে তৃতীয় জাতিটি। এটি হল বাগদি, যাদের সংখ্যা ২০১১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী ৩০,৫৮,২৬৫। শিক্ষার হারের দিক দিয়ে বাগদিরা তলানিতে, সাক্ষরতার হার ৬১ শতাংশ, রাজ্য গড় থেকে ১৫ শতাংশ বিন্দু পিছনে। প্রধান জীবিকা খেতমজুরি। /২০১১ সালে এদের মোট উপার্জনকারীর ৫৮ শতাংশই খেতমজুরির উপর নির্ভরশীল (রাজ্য গড় ২৫ শতাংশ)।
এক সময় এই জাতির রাজা ছিলেন, রূপা বাগদি। বাগদিরা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয়ও দিত। এদের কাজ ছিল যুদ্ধ করা। এক সময় এল যখন তাদের সমাজে অবনমন শুরু হল, আর সেই যে নামা শুরু হল, আজও তা থামেনি। এরা পরিণত হল ডাকাত সম্প্রদায়ে, ঘোষণা করা হল ১৮৭১-এর ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট-এর অন্তর্গত ডিনোটিফায়েড ট্রাইব হিসেবে, এই চিহ্ন এখনও তাদের বহন করতে হচ্ছে ভারত সরকার নিয়োজিত ২০১৭-র ইদাতে কমিশনের রিপোর্টে। বাগদি জাতির যে একটা গৌরবের অতীত ছিল তা আজও এই সম্প্রদায়ের অনেকের কাছে অজানা। জানার কথাও না, কারণ লেখাপড়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তেলে-জলে। কিছু লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আপনাদের জাতির অতীত নিয়ে কিছু জানা আছে বা জাতির লোকসংখ্যা কত এ রাজ্যে? উত্তর পেয়েছিলাম, এ সব জেনে আমরা কী করব?
অন্য দিকে, মতুয়া বা রাজবংশীরা কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে নিজস্ব দাবি নিয়ে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজবংশী সম্প্রদায় দীর্ঘ দিন ধরে আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠনের মাধ্যমে। রাজ্য সরকার তৈরি করেছে নারায়ণী বাহিনী, পঞ্চানন বর্মার জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা। রাজবংশী ভাষা বোর্ড গঠন এবং তার সঙ্গে দিয়েছে দু’শোটি রাজবংশী-মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুমোদন। অন্য দিকে, নমশূদ্রদের জন্য হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা, পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ-সহ পশ্চিমবঙ্গ নমশূদ্র ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠনের মতো পদক্ষেপ করা হয়েছে।
রাজবংশী বা নমশূদ্রদের উন্নতির ক্ষেত্রে দূরদর্শী ও সমাজমনস্ক নেতাদের উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। যোগেন মণ্ডল, হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর, পঞ্চানন বর্মা প্রমুখের অবদান ভোলার নয়। সেই দিক থেকে বাগদিদের ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের দাবি তোলার জন্য কোনও সংগঠনও গড়ে উঠেনি। রাজবংশী বা নমশূদ্র সম্প্রদায় রাজনীতিতে যে একটা কাঠামো তৈরি করতে পেরেছে, বাগদি সম্প্রদায় তা পারেনি। অধিকারের লড়াইয়ে নমশূদ্র বা রাজবংশীরা সর্বদা এগিয়ে, একটা নির্বাচনে তারা বিজেপির দিকে গেলেও পরের নির্বাচনে তাদের কাছে টানার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাগদিদের নিয়ে কোনও দলের কোনও মাথাব্যথাও নেই।
কিছু দিন ধরে অবশ্য বাগদিদের মধ্যে একটা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। সাংগঠনিক কাঠামো না থাকার জন্য তারা ভোটের আগে গ্রামের রাজনীতিকে বেশি করে গুরুত্ব দেয়। এ ক্ষেত্রে তাদের লড়াই হয়ে ওঠে গ্রামের উঁচু জাতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। তারা যে পার্টিকে সমর্থন করে তার বিপরীত পক্ষকে সমর্থন করে বাগদিরা। লড়াইটা হয়ে ওঠে পাড়াগত। গ্রামের দিকে এই পাড়ার ভাগ এবং এক পাড়ার সঙ্গে অন্য পাড়ার পারস্পারিক নির্ভরতা এবং দ্বন্দ্ব ইতিহাস ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে এই পাড়াগত সম্পর্ক ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে পরিণত হচ্ছে। বাগদিরা দীর্ঘ দিন পড়াশোনাতে পিছিয়ে ছিল, নিজেদের অধিকারের বিষয় না বুঝলেও বর্তমানে তা বুঝতে শিখেছে অল্প হলেও। তাই শেষ নির্বাচনে বীরভূমের বেশ কিছু গ্রামের বাগদি সম্প্রদায় বিজেপির দিকে ঝোঁকে, যদিও সামাজিক দিক দিয়ে বিজেপির মতাদর্শের সঙ্গে তাদের কোনও মিলই নেই। কিন্তু, লড়াইটা যে-হেতু ছিল মূলত ক্ষমতাসীন গ্রামীণ উচ্চজাতির কাছ থেকে নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার, তাৎক্ষণিক স্বার্থের বিচারে তাদের কাছে বিজেপিই যেন বেশি গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ দার্শনিক পার্থক্য বজায় থাকলেও স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রাধান্য পেয়ে যায়।
হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়া এবং বীরভূম মিলিয়ে ষোলো লক্ষের বেশি বাগদি মানুষ বসবাস করেন। গ্রামগুলিতে পাড়া ভাগের পরিষ্কার একটা চিত্র দেখা যায় এবং প্রত্যেক পাড়ায় এই জাতি গ্রামের উঁচু জাতির উপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল। জমি বা শিক্ষা কোনওটাই এঁদের নেই, তাই উঁচু জাতের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না এঁরা। বর্তমানে কিছু মানুষ এই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এলেও যে পার্টি গ্রামে ক্ষমতায় আছে তার উল্টো পথ ধরার ফলে বিশেষ সহায়তাও পাচ্ছেন না। উঁচু জাতের বাড়ি সাধারণত তাঁদের আয়ের উৎস, তাই তাদের বিরুদ্ধে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। দেখা যাবে, যাঁরা আজও উঁচু জাতের উপর নির্ভরশীল তাঁরা এই লড়াইয়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। সবে শুরু হয়েছে উচ্চশিক্ষার প্রতি ঝোঁক। ফেসবুকের সাহায্যে সংগঠন গড়ার চেষ্টাও শুরু হয়েছে। দেখা যাক, এই বাগদি আত্মশক্তির উন্মেষ এ রাজ্যে কতখানি সফল হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy