প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সপ্তাহে সত্তর ঘণ্টা কাজের ‘সুপরামর্শ’ নিয়ে সম্প্রতি ভারতে খুব হইচই হচ্ছে। এমনিতে দুনিয়ার জনমত ক্রমেই ঢলে পড়ছে পাঁচ দিনের পরিবর্তে সপ্তাহে চার দিন কাজের পক্ষে। অতিমারি আবার ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-কে স্বাভাবিক কর্মসংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। কিছু অতিধনী ব্যবসায়ী অবশ্য মাঝেমধ্যেই কর্মীদের কাজের সময় বৃদ্ধির কথা বলেন। ২০১৯ সালে চিনের ধনীতম ব্যক্তি জ্যাক মা সরাসরি সওয়াল করলেন সে দেশের বিতর্কিত ‘৯-৯-৬’ নীতির পক্ষে— সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত ছ’দিন, অর্থাৎ সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টার কর্মসংস্কৃতি। গত নভেম্বরেই টুইটার অধিগ্রহণের পর কর্মীদের হুঁশিয়ারি দিলেন ইলন মাস্ক: টিকে থাকতে হলে তাঁদের প্রস্তুত থাকতে হবে সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টা কাজ করার জন্য। ইনফোসিস-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির কথার সুর এর থেকে বিশেষ আলাদা নয়।
বিতর্কে উঠে এসেছে অনেক মতামত। জানা যাচ্ছে, জিডিপি-র নিরিখে বিশ্বের প্রথম দশটি দেশের মধ্যে ভারতে কর্মীদের গড় কর্মসময় নাকি সবচেয়ে বেশি। মাত্রাছাড়া কাজ করলে ক্লান্তি এবং একঘেয়েমির ফলে উৎপাদন কমতে পারে, মনে করিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ বলেছেন, কাজের সময়কাল নয়, তার গুণমানই মুখ্য। অনেকেই জোর দিয়েছেন কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবনের সুষ্ঠু সমন্বয়ে। নিয়োগকারী ৪০ ঘণ্টার মাইনে দিয়ে ৭০ ঘণ্টার কাজ চাইতে পারেন না, এমন কথাও শোনা গিয়েছে। কর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং মানসিক শান্তি নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেকে।
সফল হওয়ার জন্য কত ক্ষণ কাজ করা প্রয়োজন? ২০০৬ সালে হার্ভার্ড বিজ়নেস রিভিউ-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে দেখছি, আমেরিকার উচ্চ-আয়ের মানুষদের ৬২% নাকি সপ্তাহে অন্তত ৫০ ঘণ্টা কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রতি দু’জনের এক জন সপ্তাহে কাজ করেন অন্তত ৬০ ঘণ্টা, ছ’জনের এক জন করেন সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টারও বেশি। কর্পোরেট কর্তারা ইদানীং বলছেন, তরুণ প্রজন্ম সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা সংস্থার জন্য কাজ করে বাকি ৩০ ঘণ্টা ব্যয় করতে পারে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে, যা মাত্র ছ’বছর সময়ে হয়ে উঠতে পারে মোট ১০,০০০ ঘণ্টার প্রস্তুতি। নিউ ইয়র্কার-এর সাংবাদিক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল তাঁর বই আউটলায়ার-এর মাধ্যমে জনপ্রিয় করেছিলেন এই সূত্রটা— যে কোনও ক্ষেত্রে সত্যিকারের দক্ষতা অর্জনের চাবিকাঠি হল সঠিক উপায়ে অন্তত ১০,০০০ ঘণ্টার অনুশীলন।
তা হলে কি সত্যিই রোজকার কাজের সময় বাড়ানো উচিত সাধারণ মানুষের? সপ্তাহে ৭০ বা ৮০ ঘণ্টা, কিংবা তারও বেশি? এটা কি সভ্যতার স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী নয়? মানুষের কাছ থেকে মানুষের উদ্ভাবিত যন্ত্রের মধ্যে শ্রমের স্থানান্তরই তো সভ্যতার ইতিহাস। মানুষকে যদি আরও বেশি কাজ করতে হয়, তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এসে লাভ কী হবে?
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেন্স ১৯৩০ সালে ‘ইকনমিক পসিবিলিটিজ় ফর আওয়ার গ্র্যান্ডচিলড্রেন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন— শতবর্ষ পরে তাঁর নাতি-নাতনিদের সামাজিক জীবন এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ে। আসলে বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের একটি বৃহৎ গোষ্ঠীকেই অনুসরণ করেছেন কেন্স, যাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল— উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে ন্যূনতম সময়ের বেশি শ্রমের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না মানুষের। কর্মকাল হ্রাসের ফলে জনগণের পক্ষে দিনযাপন করাই হবে অত্যন্ত কঠিন। এক শতাব্দী সময়কালের মধ্যে বিপুল আয়বৃদ্ধির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কেন্স। ফলে মানুষের জীবনযাত্রাও উচ্চতর হতে বাধ্য। কেন্স লিখছেন, সেই অভূতপূর্ব প্রায়-অবসরের সময়কালে মানুষ কাজ করবে দৈনিক তিন ঘণ্টা করে সপ্তাহে মোট পনেরো ঘণ্টা; বাড়তি সময়কে কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজের জন্য করবে কিছু! আজকের কর্মসংস্কৃতির রকমসকম দেখে বলা চলে, এ গ্রহের সার্বিক শ্রমনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি অনুমানে ব্যর্থই হয়েছিলেন কেন্স।
সত্যিই কি ভুল বলেছিলেন কেন্স? চিনের কুখ্যাত ‘৯-৯-৬’ সংস্কৃতির ঢাক পেটানোর মাসকয়েক পরেই শাংহাইতে বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্মেলনে জ্যাক মা বলেছিলেন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ঠিকমতো হলে পরবর্তী দশ-বিশ বছরেই দিনে চার ঘণ্টা করে তিন দিন, অর্থাৎ সপ্তাহে ১২ ঘণ্টা কাজ করাই যথেষ্ট হতে পারে মানুষের। বিশ শতকে বিদ্যুৎ যেমন পাল্টে দিয়েছিল সাধারণ মানুষের কাজ আর অবসরের ধারণাকে, একুশ শতকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই সেই আলিবাবার রত্নগুহার চিচিং ফাঁক মন্ত্র। যে গুহায় প্রবেশাধিকারই জনগণকে দিতে পারে ‘মানুষ’ হিসাবে নিজেদের উপভোগের জন্য আরও বেশি সময়। তাঁর কথা ঠিক হলে, ২০৩০-এর আগে-পরেই তো আমাদের পৌঁছে যাওয়া উচিত কেন্স-বর্ণিত সেই স্বপ্নের ইস্টিশনে।
তবু, দিনের শেষে সে স্টেশনখানা হয়তো আরব্য উপন্যাসের মতো স্বপ্নের জগৎ হয়েই থেকে যাবে। এ গ্রহের শ্রম আইনগুলি বোধ হয় কিছুতেই সেই সীমান্ত ছুঁতে পারবে না অদূর ভবিষ্যতে। আমরা ৪০, ৭০, কিংবা ৮০ ঘণ্টা, অথবা সপ্তাহে পাঁচ দিন না চার দিন কাজ করা উচিত, সেই সব আলোচনাতেই ক্লান্ত হতে থাকব। গুণোত্তর প্রগতির ছন্দে ঊর্ধ্বগামী প্রযুক্তি আর উৎপাদনশীলতার রেখচিত্রের সঙ্গে শ্রমনীতির অতলান্তিক ফারাকের কারণও হয়তো বিশ্লেষণ করতে বসবেন একুশ শতকের কোনও দিকপাল চিন্তানায়ক। সঙ্গে তিনি আশাবাদী অনুমানও করতে পারেন ২১৩০ নাগাদ মানুষের শ্রম-সপ্তাহের পরিমাণের। তা প্রমাণ-অপ্রমাণের দায় অবশ্য আমাদের নাতিপুতিদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy