পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে এখন বর্ষা নেমেছে। আর নেমেছে বাঙালি পর্যটকের ঢল। এ বাঙালি নতুন বাঙালি। তাদের ছল-বল-কলকলের ভাষা আলাদা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এরা গতিময়, শুচিবায়ুগ্রস্ততাহীন, নিজেদের ভাষিক-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ঢেকে হিন্দিতে আত্মহারা, ইংরেজিতে মুখ-সচল। শুধু মাঝে মাঝে কখনও খাবার টেবিলে, হোম-স্টে’র কুহরে বাংলা ভাষা আত্মপ্রকাশ করে। সে ভাষায় তাঁদের কূপবর্তী সংস্কার ও বিস্ময় উঁকি দেয়। “এ ভাবে তো আমরা উচ্ছে ভাজি না। কী সুন্দর গোল করে কেটে বেসনে ডুবিয়ে পোস্তর দানা দিয়ে ভেজেছে। খা খা। একটুও তেতো লাগবে না।” শুনলেই পরশুরামের ‘কচি-সংসদ’ গল্পের গিন্নির পাহাড়গামী বাঙালির পরিচয় ফিরিস্তি মনে পড়বে। “দার্জিলিং-এ বরঞ্চ কত চেনাশোনা লোকের সঙ্গে দেখা হবে। টুনু দিদি, তার ননদ, এরা সব সেখানে আছে। সরোজিনী, সুকু-মাসী এরাও গেছে। মাংকি মিত্তিরের বউ তার তেরোটা এঁড়িগেঁড়ি ছানাপোনা নিয়ে গেছে।” সেই ফিরিস্তিবদ্ধ বাঙালির একেলে সংস্করণেরা শুধু খাবার টেবিলে বাংলায় খলবল করছে। এই পাহাড়িয়া বর্ষায় কলকলে বঙ্গভাষা বুঝিয়ে দেয় এ বাঙালির আর যা-ই থাক আত্মবিশ্বাস নেই, নিজত্ব বজায় রেখে অন্যকে গ্রহণ করার উদারতাও নেই। এক দিকে হাবেভাবে ভাষায় নিজত্বকে লুকোচ্ছে, অন্য দিকে আর এক রকম কিছু দেখলেই কেমন একটা হামলে-পড়া ভাব। অস্থিত, ছন্নছাড়া— মন যেন খালি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। তার কোনও লক্ষ্য নেই, বর্ষার মেঘের ভাসমানতার সঙ্গে এই উড়ে উড়ে যাওয়ার পার্থক্য অনেক। সে পার্থক্য যত না রূপগত, তার থেকে অনেক বেশি গুণগত।
অথচ, বাঙালি যদি একটু মন দিয়ে এই বর্ষায় মেঘ-পাহাড় আর পশ্চিমবঙ্গের হিমালয়লগ্ন কম কথার মানুষদের দেখত, তা হলে বুঝতে পারত হিমালয়ের জীবনযাত্রার, সেখানকার প্রকৃতির অন্যতর এক ভাষা আছে। সে ভাষা সারাক্ষণ খলবল করে না, লোলুপ প্রত্যয়হারা ভঙ্গিতে উড়ে উড়ে যায় না— ধারণ করে, আর পাহাড়ের বুকে ভেসে যাওয়া মেঘের মতো মাঝে মাঝে বারিধারা হয়ে ঝরে পড়ে সজল-সবুজ করে তোলে চার পাশ।
তখন বারিষ একটু ধরেছে। কোলাখামের দিকে আস্তে আস্তে নামছিলেন ক্ষেম বাহাদুর। বিরাশি বছরের হাসিখুশি যুবক যেন। তিন কুলে এখন কেউ নেই তাঁর। ছিলেন। বাবা ছিলেন গোরা পল্টনের ‘সিপাহি’। ইংরেজরা তো এ দেশে এসে এখানকার মানুষজনকে দু’দলে ভাগ করে ফেলেছিল। এক দল সামরিক, ‘মার্শাল’। অন্য দল অসামরিক, ‘নন-মার্শাল’। বাঙালি বাবুরা সেই নন-মার্শাল ধারার, আর ক্ষেম বাহাদুরের পূর্বপুরুষরা মার্শাল— ক্ষেমও বহন করছেন যোদ্ধার রক্ত। তবে পাশ্চাত্যের ইংরেজ সাহেবরা যুদ্ধ বলতে যা বুঝতেন, ভারতের ক্ষেমেরা যুদ্ধ বলতে সব সময় তা বোঝেন না। তাঁদের যুদ্ধের পরম্পরা আর এক রকম। সে যুদ্ধের নাম প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া। সেই বোঝাপড়ার সূত্রেই ক্ষেম জানেন প্রকৃতিকে কী ভাবে কাটতে হয়, কী ভাবেই বা রাখতে হয়।
এত কথা অবশ্য ক্ষেম বলেননি। বলার মানুষই নন তিনি। দূরে লাভার বৌদ্ধ গুম্ফার গায়ে তখন ভাসা-ভাসা সাদা মেঘ। জল-ঝরানো মেঘেরা ভাসতে জানে, ঝরতেও জানে, কিন্তু লঘু কথা বলতে চায় না। সমতলের বর্ষার সঙ্গে হিমালয়ের বর্ষার পার্থক্য সেখানেই। সমতলের বর্ষা লঘু ও বহমান, হিমালয়ের বর্ষা সু-উচ্চ ঘন পাইনের বনে সুগম্ভীর মার্গসঙ্গীতের মতো। ক্ষেম বললেন তিনি চলেছেন কাঠ আনতে। জোঁকের হাত থেকে বাঁচার জন্য সঙ্গের বোতলে নিয়েছেন নস্যরঙা তরল। সে তরলে আছে নুন-খৈনি-চুন। জোঁকের মুখে তা পড়লে আর দেখতে হবে না। ক্ষেমের হাতে কাঠ কাটার অস্ত্রটি ধারালো তবে দীর্ঘ নয়। তাঁর মুখে সারল্য— অরণ্য জানে মানুষটি অপহরণ করতে যাচ্ছেন না, আহরণ করতে যাচ্ছেন। অরণ্য মানুষকে দিতেই চায়, শুধু সেই সহজ দেওয়ার ভাঁড়ারে তখনই টান পড়ে যখন মানুষ অপহরণের লোভে ওঠে মেতে। কথাটা বাঙালি না বুঝলেও, বাঙালি কবি বিশ্ববাসীকে বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছিলেন। মংপুতে সেই কবির বাস-করা বাড়িটি এখন সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই সব ভাবনা! সংরক্ষণ হবে বুঝি টুরিস্ট বাঙালির মনে?
ক্ষেম যে পথে নীচে নেমে গেলেন সে পথ চলে গেছে রাইদের গ্রামে। নেপালি রাইরা নিরামিষ খান। তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাইরের কাজে ছড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের মুখে আমিষের স্বাদ লেগেছে। গ্রামের বাড়িতে অবশ্য এখনও আমিষ ঢোকে না। আনাজপাতি যেটুকু ঘরযোগে আর বারযোগে ফলান তাঁরা, তাতে রাসায়নিকের দাপট নেই। ক্ষেমের পথে না গিয়ে, উপরে নিজেদের ডেরায় ঢুকতে গিয়ে পালবাবুর সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করেন, “ক্ষেমের সঙ্গে দেখা হল? আমাদের এখানকার সবচেয়ে ফিট মানুষ। পাহাড়কে তো শুধু কাটলেই হয় না, পাহাড়কে বাঁধতেও হয়। ক্ষেম সেই পাথর বাঁধার কারিগর। শিল্পীও বলা চলে। এখানে এই যে পাথরের দেওয়াল তা সব ক্ষেমই বেঁধেছে।” পাথর-বাঁধা ক্ষেমের পূর্বপুরুষের কথা পালবাবুর কাছ থেকে শুনে এগিয়ে যাই পাথরের সিঁড়ি বেয়ে, দিন-দুয়েকের থাকার জায়গায়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বর্ষা আমাদের নানাখানা মনকে একখানা করে দেয়। বর্ষা তো কালিদাসের কাব্যে বিরহের ঋতু। বিরহী যক্ষ মেঘকে দূত করে পাঠাল তার প্রিয়ার কাছে। যাত্রাপথে মেঘ অনেক কিছু দেখতে দেখতে গেল। মেঘ যাত্রাপথে কী কী দেখবে তার বিবরণ দিল বিরহী যক্ষ। যেন এক ভ্রমণরসিকের পর্যটনপথের দৃশ্য বর্ণন। তবে সেই দৃশ্যগুলি এলোমেলো নয়। বিরহী যক্ষের মনের কেন্দ্রে যে এক— উজ্জয়িনীবাসিনী তার প্রিয়া। সেই প্রিয়াবিরহেই যক্ষ বর্ষায় একখানা মনের অধিকারী, নানাকে ছুঁয়ে একে সুস্থির। ক্ষেম পাথর কাটেন পাথরকে বাঁধার জন্যই, যেমন বিরহী যক্ষ মেঘকে নানা পথদৃশ্যের কথা বলেন প্রিয়ার কাছে উপনীত হওয়ার জন্যই।
ক্ষেম এখনও এই পাহাড়িয়া পথে সচল। তবে চলে গিয়েছেন সেই নামহারা মানুষটি। ছবি আছে তাঁর। সিকিমের পেম-ইয়াংসি বৌদ্ধ মঠে একমনে পাথর কাটার কাজ করতেন তিনি। পাথর কেটে খোদাই করতেন বুদ্ধের শরণমন্ত্র। সমস্ত দিনমান যতক্ষণ পারেন সেই মন্ত্র খোদাই করাই ছিল তাঁর সাধনা। কেউ কখনও তাঁকে বিরক্ত হতে দেখেনি। টুরিস্টরা তাঁর সেই বুদ্ধমন্ত্র খোদাই করা হাতে ধরিয়ে দিতেন টাকা, যে টাকায় গান্ধীর ছবি আছে সেই ভারতের একশো-দু’শো টাকা গুঁজে দিয়ে আসতেন হাতে। আর সেই বুদ্ধভক্ত উদাসীন অবলীলায় টাকার নোটখানি পাশে বা হাতে রেখেই করে যেতেন তাঁর কাজ। হয়তো ভাবতেন এই খোদাইকার্যে যে শরণ-শব্দাবলি লিখে গেলেন তিনি তা মানুষকে কাটবে না, মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধবে। একমনা না হলে এই বাঁধার কাজ করা যায় না।
ভারতের বর্ষা, পাহাড়িয়া বর্ষা, কত কাল ধরে যে মানুষের নানাখানা মনকে একখানা করার কথা বলে যাচ্ছে! কালিদাস সে কথা শুনেছিলেন। তাই তাঁর বিরহী যক্ষ একমনা পর্যটক, তার মন নানা পথে পর্যটন করতে শেষে গিয়ে মিলেছে প্রিয়ার কাছে। এই একমনা পর্যটনের পরম্পরাতেই এগিয়েছেন পেম-ইয়াংসির সেই শরণমন্ত্র খোদাইশিল্পী। বুদ্ধমন্ত্রে লেগে ছিলেন তিনি। সেই একের পথেই চলেছেন ক্ষেম বাহাদুর, পাথর কাটার কাজ করেন তিনি একমনে পাথর বাঁধার জন্যই।
মংপুতে রবীন্দ্রনাথের বাস-করা বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের পর খুলে দেওয়া হবে। এ কালের বাঙালি টুরিস্টরা উড়ু-উড়ু মন নিয়ে ছবি তুলে ফিরে আসবেন সেখান থেকে। তাঁদের সেই মন কি কোনও দিন বুঝতে পারবে যক্ষের একমনা পর্যটনের দর্শন!
হিমালয়ের বুকে আবার ভাসমান মেঘ জল ঝরায়। সেই জল ধারণ করে ঘন থেকে ঘনতর হয়ে ওঠে চার পাশ। ক্ষেম বাহাদুর ফিরে এসেছেন। অরণ্য যে কাঠ তাঁকে দিয়েছেন তার আহরণ সমাপ্ত। বসে আছেন শেড-এর তলায়। বৃষ্টি দেখছেন। আর তাঁর কোলে এসে বসেছে ছোট একটি বেড়াল। আশ্রয় দিয়েছেন তিনি পরম আদরে। নাম তার ‘ফুসরে’, বাংলায় অর্থ ধূসর। একটু পরে সন্ধে নামে, ধূসর সন্ধ্যায় মেঘেরা ভেসে যায় দূরে, পাহাড়ের বুকে জেগে ওঠে লাভা শহরের আলোকমালা।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy