মুহূর্ত: (বাঁ দিকে) লর্ডস-এ কপিল দেব, ১৯৮৩; ওয়াংখেড়েতে সচিন তেন্ডুলকর, ২০১১ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ধাক্কাটা লাগল সোমবার, ১৩ নভেম্বর। দুপুর দেড়টার সময় পাভলভের পোষ্যের মতো টিভিটা চালিয়েছি, টসে কে জিতল জানতে। কয়েক মিনিট কাটার পর খেয়াল হল, লিগ শেষ— সম্বল বলতে সেমিফাইনাল আর রবিবারের ফাইনাল, ব্যস। খেল খতম, পয়সা হজম। মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। হাজার হোক, বিশ্বকাপ— তার আবার ফাইনাল। চার বছর অন্তর আসে। হারলে সবার মন খারাপ, কান্নাকাটি; জিতলে মাঝরাতে রাস্তা জুড়ে মানুষের ঢল। বিশ্বকাপ ক্রিকেট ছাড়া আর কিসেই বা আসমুদ্রহিমাচল এ ভাবে এক হয়ে হাসিকান্নায় মাতে!
অথচ, ক্রিকেটের বিশ্বকাপ ফাইনাল জিনিসটাই বেশ গোলমেলে। টেস্ট হল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরনো ফর্ম্যাট। পাঁচ দিনের এই খেলা কয়েকটা দেশের বাইরে জনপ্রিয়তা হারালেও আভিজাত্যের জোরে টিকে থাকবে আরও কয়েক বছর। তার বিপরীত মেরুতে টি-টোয়েন্টি শুধু নতুন প্রজন্মের পছন্দই নয়, টাকা আর দর্শকও টানে অনেক বেশি। টাকার অঙ্ক রীতিমতো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে ওয়ান ডে রীতিমতো কোণঠাসা। তা ছাড়াও, অনেকেই একটু বাঁকা হাসি হেসে বলেন, “দশটা দেশের প্রতিযোগিতা, তা আবার নাকি বিশ্বকাপ!” যদিও শ’খানেকের বেশি দেশ ক্রিকেট খেলে, যদিও পরের বার থেকে বিশ্বকাপ খেলবে চোদ্দোটা দেশ, তবুও সমালোচনাটা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবুও, বিশ্বকাপ হল বিশ্বকাপই। এখন যাঁরা মধ্য-চল্লিশের চৌকাঠ পেরিয়ে পঞ্চাশের কোঠার দিকে এগোচ্ছেন, তাঁদের অনেকেরই ক্রিকেট দেখা শুরু তিরাশির রূপকথার পর। সেই বিখ্যাত ফাইনালের দিন কপিলের হাতে ট্রফি ওঠা ছাড়াও আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল— ম্যাচের আগে এমসিসি-র কাছে বাড়তি দুটো পাস চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন তৎকালীন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট নরেন্দ্র কুমার প্রসাদরাও সালভে। সে দিন সালভে প্রতিজ্ঞা করেন, ইংল্যান্ড থেকে তিনি বিশ্বকাপ বার করে আনবেন। দেখা করলেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নুর খানের সঙ্গে। সমর্থন মিলল শ্রীলঙ্কার গামিনি দিসানায়কের থেকেও। তড়িঘড়ি তৈরি হল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল— কোমর বেঁধে মাঠে নামল এশীয় শিবির। চুরাশিতে শারজায় খেলা হয় প্রথম এশিয়া কাপ— ভারত, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা, এই তিনটি দেশের দল খেলতে নামে, চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত।
এশিয়া কাপ নিয়ে বাইরে তেমন হেলদোল না হলেও সালভেরা সাতাশির বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেওয়ায় আলোড়ন পড়ে যায়। সেমিফাইনালে গ্রাহাম গুচ স্রেফ সুইপ করে একটা গোটা দেশের আশা-স্বপ্ন-আবেগ ধসিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু ক্রিকেটবিশ্বের ভৌগোলিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার পথে ভারতের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই সাতাশিতেই।
বর্ণবিদ্বেষের কারণে দীর্ঘ সাতাশ বছর নির্বাসনে থাকার পর ক্রিকেট মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যাবর্তন ঘটল ভারতেই, ১৯৯১ সালে। এই সিরিজ়ের আগে ভারতে খেলা হলে তা থেকে বিসিসিআই-এর বিশেষ আয় হত না— টিকিট বিক্রি আর মাঠের ধারে বিজ্ঞাপন থেকে যেটুকু জুটত, সেটুকুই। বিসিসিআই মাঝেমধ্যে উল্টে দূরদর্শনকে টাকা দিত খেলা দেখানোর জন্য। এ বার আলি বাখার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন— দক্ষিণ আফ্রিকায় এই সিরিজ় দেখানোর জন্য কত টাকা চায় বিসিসিআই? তড়িঘড়ি মিটিং করে ঠিক হল, ম্যাচপিছু দশ হাজার ডলার চাওয়া হোক। বাখার দিলেন তার চার গুণ। সেই শুরু। এর ত্রিশ বছর পর বিসিসিআই আইপিএলের পাঁচ বছরের স্বত্বাধিকার বিক্রি করল ৬.২ বিলিয়ন ডলারে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বকাপ শুরু হয় অস্ট্রেলিয়া আর নিউ জ়িল্যান্ডে। সে অদ্ভুত যুগ, তখন টিভি চালু করতে দু’জন লাগত— এক জন ছাদে উঠে অ্যান্টেনা ঠিক করত, আর এক জন চিৎকার করে জানাত ছবি এসেছে কি না। বিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে ভারত ভাল না খেললেও চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমাদের। সাদা বল, রঙিন জামা আগেও দেখেছি, কিন্তু এত বড় মঞ্চে নয়। তার উপরে চ্যানেল নাইনের ঝকঝকে সম্প্রচার, মাইকের পিছনে বেনো-লরি-চ্যাপেলদের চাঁদের হাট। দূরদর্শনে খেলা ম্যাড়মেড়ে লাগতে শুরু করল।
আর্থনৈতিক মুক্তায়নের বাজারে পরিত্রাতা হয়ে দেখা দিল টিডব্লিউআই। তিরানব্বইয়ের ইংল্যান্ড সিরিজ়ের কভারেজ দেখে মনে হল, দেশের মাঠের খেলা দেখেও চোখের সুখ সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রচারের স্বত্ববাবদ বিসিসিআই-এর অ্যাকাউন্টে ঢোকে ছ’লক্ষ ডলার। মাথায় হাত পড়ে দূরদর্শনের! মামলা-মকদ্দমা করে হিরো কাপের সময় টিডব্লিউআই-কে আটকানোর হাজার চেষ্টা করেও এঁটে ওঠা গেল না। তার মধ্যে ওয়ার্ল্ডটেল অবিশ্বাস্য অঙ্কের বিনিময়ে কিনে নিল ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপ দেখানোর অধিকার।
তত দিনে আইসিসি থেকে ভেটো পাওয়ার হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের নাকের ডগা দিয়ে ছিয়ানব্বই বিশ্বকাপের অধিকার আবার কেড়ে নিয়ে জগমোহন ডালমিয়া বলেছিলেন, “এই বুদ্ধি নিয়ে তোমরা আমাদের উপরে দু’শো বছর রাজত্ব করেছিলে?” বিশ্বকাপের আগেই অবশ্য ভারতের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল কেবল্ টিভি। তার সঙ্গে রমরমিয়ে বিজ্ঞাপনের লড়াই।
ভারতে ক্রিকেটভক্তের সংখ্যা বরাবরই বেশি। বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারে থাকে একটাই টিভি, আর ছিয়ানব্বই বিশ্বকাপের সময় খবর-সিনেমা-সিরিয়ালকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই টিভি দখল করে বসে দিনরাতের ক্রিকেট। ক্রিকেটে ওভারের ফাঁকে ফাঁকে দিব্যি বিজ্ঞাপন চালানো যায়। কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হতে থাকে স্লট। সে বছর রঞ্জি ফাইনাল অবধি ফ্লাড লাইটের আলোয় খেলা হয়।
নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধকে ভারতে ওয়ান ডে ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ বললেও অত্যুক্তি হবে না। খেলার গুণগত মানের কথা বলছি না: এ হল খেলা দেখার কথা। অস্ট্রেলিয়ায় বরাবরই চল ছিল ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতার, কিন্তু সেখানে হত বছরে এক বার। ১৯৯৭ আর ১৯৯৮ মিলিয়ে ভারত খেলে দশটা ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতায়, তার ন’টাই এশিয়ায়।
এশিয়ায় হওয়ার বাড়তি সুবিধা কী? সন্ধেবেলা ওয়ান ডে ম্যাচ মানেই টিভির সামনে গোটা পরিবার। এই এত খেলার ফলে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ভারতে ওয়ান ডে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা তুঙ্গে ওঠে। আর তার মধ্যেই ভারত ইংল্যান্ডে যায় বিশ্বকাপ খেলতে। দেশ জুড়ে তখন গরমের ছুটি। টিভি কোম্পানিগুলো ছাড়ের মান বাড়িয়ে দেওয়ায় হুহু করে বাড়তে থাকে বিক্রিবাটা।
সে বছর ভারত মোটামুটি হতাশ করলেও চার বছর পর ছবিটা বদলে যায়। ২০০৩-এর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে পর পর আটটা ম্যাচ জিতে ভারত ফাইনালে উঠল। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার সামনে ধরাশায়ী হলেও কিন্তু এই সময়ই মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, দর্শকসংখ্যার দিক থেকে ভারতের ধারেকাছেও নেই কোনও দেশ।
এর পর ২০০৭-এর ভরাডুবি। ২০১১ সালে অবশ্য ছবিটা বদলে গেল। অন্যতম ফেভারিট হিসাবেই শুরু করেছিল ভারত। তত দিনে ফেসবুক-টুইটারও এসে গেছে, কাজেই উত্তেজনা ছিল চরম। বিশ্বকাপ জিতে সচিন তেন্ডুলকরকে কাঁধে তুলে ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণের ছবিটা এক যুগ পরেও অমলিন আমাদের মনে।
পনেরো আর উনিশে দুর্ধর্ষ খেলে লিগে সবার উপরে শেষ করলেও ফাইনালে ওঠেনি। কোন দল সেরা, সেটা বোঝার জন্য অবশ্য রাউন্ড রবিন লিগই যথেষ্ট। নকআউট কিছুটা অযৌক্তিক, কারণ সবাই সেখানে সমান, ভাল দলের বিশেষ সুবিধা থাকে না। কিন্তু শুধু সে বিচারের জন্য তো খেলা দেখতে বসা নয়! লিগে সবাইকে দুরমুশ করে একটা দলের ট্রফি হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি যাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত হলেও খুব ম্যাড়মেড়ে একটা ব্যাপার। তাই সেমিফাইনাল, ফাইনাল। কোনও মতে কেঁদে ককিয়ে ওঠা দল আচমকা বড় দলকে হারালে তবে না সেটা আলোচনার বিষয় হয়! নকআউটে দু’-একটা অঘটন ঘটলে তবে না সেটা বিশ্বকাপ!
আর তাই ওয়ান ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো মঞ্চ ক্রিকেটে দু’টি নেই। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা হয় দু’বছর ধরে ঘুরে ঘুরে, তার পর ফাইনাল হয় ইংল্যান্ডে। সবাই এক দেশে এসে দেড় মাস জুড়ে উৎসব চলে না সেখানে। টি-টোয়েন্টিরও বিশ্বকাপ আছে বটে, কিন্তু সে-ও হয় দু’বছর পর পর। আর, টি-টোয়েন্টির জন্য তো বছর বছর আইপিএলই আছে। শবরীর প্রতীক্ষা জিনিসটা ওয়ান ডে বিশ্বকাপের একচেটিয়া।
অপেক্ষা আছে বটে, কিন্তু সেই বাজার নেই। যে বাজার এক দিন ওয়ান ডে-কে নিরঙ্কুশ সাম্রাজ্য দিয়েছিল, সেই বাজারই ক্রমে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে— বাজারের সুয়োরানি আজ টি-টোয়েন্টি। ওয়ান ডে-র ভবিষ্যৎ বিশেষ সুবিধার নয়। বিশ্বকাপ থাকলেও তার বাইরে খেলার সংখ্যা কমতে চলেছে অচিরেই। অস্ত যাওয়ার আগে অবশ্য থাকবে আরও কিছু দিন। চলুন, তত দিন চোখ ভরে দেখে নিই। মধ্যগগনের তেজ না থাকলেও সূর্যাস্তের সৌন্দর্যও কম নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy