—প্রতীকী ছবি।
ভারতের সংবিধানের একদম প্রথম অর্থাৎ ১-এর (ক) ধারায় ইন্ডিয়া এবং ভারতের মধ্যে ব্যবধান না থাকলেও, শ্রেণিকক্ষের বাইরে, অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ভারত এবং ইন্ডিয়ার মধ্যে একটা দূরত্ব বার বারই নির্দেশ করা হত। ভারত এবং ইন্ডিয়া নিয়ে সুবিধাজনক ভাবে বরাবরই তৈরি করা হত ন্যারেটিভ। বলা হত— ভারত থাকে ফ্লাইওভারের নীচে, ফুটপাতে, বস্তিতে। ইন্ডিয়া থাকে ঝকঝকে অট্টালিকায়, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স আর স্টেডিয়ামের গ্যালারির চিৎকারে। ইন্ডিয়ার ঝলমলে চাকচিক্যের দিকে বুভুক্ষু চোখে তাকিয়ে থাকে ভারত।
সময় বদলায়, সেই সঙ্গে ন্যারেটিভও বদলায়। আসন্ন লোকসভা ভোটের জন্য প্রস্তুত হওয়া বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’-র সুবাদে আবার ফিরে এল সেই ‘বাইনারি’। এখন বলা হচ্ছে— ইন্ডিয়া নয়, ভারত-ই প্রকৃত দেশীয়। ভারত সরকারে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষভাগ থেকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইন্ডিয়ান শব্দটি বিভিন্ন ভারতবিরোধী নাশকতামূলক শক্তির নামের সঙ্গেও ব্যবহৃত হয়। এরই মধ্যে জি২০ নেতাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’-র জায়গায় লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। জল্পনায় উঠে আসছে— সামনের লোকসভা নির্বাচনের আগে সংসদের বিশেষ যে অধিবেশন রাখা হয়েছে, সেখানে বুঝি ভারতের ‘ইন্ডিয়া’ নাম ঘুচে যাবে। সংবিধানে ভারত এবং ইন্ডিয়ার সহাবস্থান থেকে ইন্ডিয়াকে অপনয়ন করার ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনী বিল ইত্যাদি জটিল পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
জি২০ নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’-র পরিবর্তে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’ লেখার অর্থ নিশ্চিত ভাবেই আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে ইন্ডিয়াকে সরিয়ে ভারতকে সামনে তুলে ধরা। প্রশ্ন হল, গোড়া থেকেই ইন্ডিয়ার পাশাপাশি ভারত নামটি তো ছিলই, তবে আজ হঠাৎ ইন্ডিয়াকে সরিয়ে ভারত নামটিকে সামনে আনার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে কেন? বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র কথা মাথায় রেখে? এই যুক্তি কি খুব বেশি কার্যকর? কিছু দিন আগেই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ সম্পূর্ণ করেছেন রাহুল গান্ধী। তখন কি ‘ভারত ভাবনা’ থেকে কোথাও বিচ্যুত হয়েছিল কেন্দ্রের শাসকদল?
‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর মতো নাম ব্যবহার করে এই সরকার আবারও বুঝিয়ে দিয়েছে তারা ভারত-এর পক্ষে। সম্প্রতি, ইন্ডিয়ান পিনাল কোড তথা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে রদবদল ঘটাতে চেয়ে বিল এনেছে সরকার। ব্রিটিশ আমলের আইনকে বাতিল করে কোথাও লঘু আবার কোথাও গুরুতর শাস্তির বিধান প্রস্তাবিত হয়েছে। বদল করা হয়েছে নামে। সংসদে ইন্ডিয়ান পিনাল কোড-এর নাম বদলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর কোড-এর নাম বদলে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর নাম বদলে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম করার প্রস্তাব এনেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রস্তাবিত সেই বিল এখন আপাতত সিলেক্ট কমিটির কাছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন— ব্রিটিশদের তৈরি আইন আর নয়, নতুন ভারত ব্যবহার করবে ভারতের সংসদে তৈরি করা আইন। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় বলেছেন— ভারত নামটি সকলের গ্রহণ করা উচিত। বিজেপি সাংসদ সুশীল মোদী বলেছেন— “আমরা ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলি, ‘ইন্ডিয়ামাতা কি জয়’ বলি না।” তালিকায় যুক্ত হয়েছে অমিতাভ বচ্চন থেকে বীরেন্দ্র সহবাগের নাম। ইন্ডিয়া নাম ব্রিটিশের দেওয়া এই অভিযোগ তুলে, ভারত নাম সরকারি ভাবে ফিরিয়ে আনার পক্ষে সওয়াল করেছেন সহবাগ।
কিন্তু ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্টআপ ইন্ডিয়া’— এদের কী হবে? হয়তো এগুলোও পাল্টাবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াও। বিভিন্ন দেশের নাম বদলের নজির আছে। এই দেশেও, সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করিয়ে, ক্ষমতায় থাকা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তা করতেই পারে। কিন্তু, ভারত নামটা হঠাৎ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন— এই প্রশ্ন বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। শেষ অবধি তা হলে ভাবনা বা সত্যিকারের কাজের দাম নেই— তার থেকে নাম, চিহ্ন, সঙ্কেত এই সমস্তই বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যে শাসনব্যবস্থা এমন ভেবে চলে ক্রমাগত, সে আসলে কী চায়, এ কি আমরা ভাবব না এক বারও, এ বারও?
আজ়াদির অমৃত মহোৎসব সমাপ্ত হয়ে, ২০৪৭ সালকে মাথায় রেখে ‘অমৃত কাল’ শুরু হতে চলেছে। তার মধ্যে ভারত-কে দিয়ে ইন্ডিয়াকে হটানোর এই তাড়না। সে ভারতই হোক আর ইন্ডিয়াই হোক, দেশ জুড়ে যে সব সাধারণ মানুষ এরই মধ্যে খাদ্যমূল্য বেড়ে চলার সঙ্কটে জীর্ণ হচ্ছেন রোজ, কিংবা বিনামূল্যে মাংস দিতে না চাওয়ার অপরাধে যে দলিত যুবককে সমবেত ভাবে জুতোপেটা করা হচ্ছে, কিংবা শিশুদের ক্লাসে একটি শিশুকে তার ধর্মপরিচয়ের অপরাধে অন্য শিশুদের দিয়ে শারীরিক নিগ্রহ করানো হচ্ছে, একটি-দু’টি মেয়েকে নগ্ন করে তার পিছনে আক্রমণের উল্লাসে মত্ত জনতা ছুটছে— এঁদের কথা ভাবব না আমরা? ভাবব না এই প্রশ্ন যে, ভারত নামটিই এ দেশের একমাত্র নাম হলে ওঁরা সবাই স্বস্তি, শান্তি, নিরাপত্তা পাবেন তো? অমৃতকালের পথে ওঁরাও একই সঙ্গে এসে পৌঁছতে পারবেন তো? খিদের পাতে অমৃতের তুল্য ধপধপে সাদা ভাতের গ্রাস অথবা গরম রুটি নিয়ে বসে তাঁরা নিরাপদে মহাকাশ অভিযানের খবর জানতে পারবেন তো?
সংশয় হয়— কেননা পুরাকালেও তো অমৃত সকলে পাননি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy