Advertisement
E-Paper

ইচ্ছেমতো ওষুধে বিপদ

খানে ওষুধের দোকানে ইচ্ছেমতো ওষুধ পাওয়া যায়। ঘুমের ওষুধ আর কিছু নার্ভের ওষুধ ছাড়া, প্রেসক্রিপশন তেমন লাগে না বললেই চলে। ছোটখাটো ইঞ্জেকশন ইত্যাদি বিষয় ওষুধের দোকানেই মিটে যায়।

আবির্ভাব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৪ ০৮:১০
Share
Save

কলকাতা থেকে মফস্‌সলে ফেরার বাসে চোখ লেগে গিয়েছিল। তন্দ্রা ভাঙল সহযাত্রীর ফোনের উদ্বেগময় কথায়। “লাল ওষুধটা দিয়ে দিয়েছ? এখনও লাগছে? কমছে না? না না, এখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। পনেরো মিনিট পরে নীল ওষুধটা দিয়ে দাও। কিছু হবে না। ও ও-রকম হয়। বলছি তো কিছু হবে না।”

মুম্বই, ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের বাইরে পা রাখতেই নরম চামড়ার চটি ভেদ করে বেশ গভীর ভাবেই পায়ে ফুটে গেল পেরেক। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে লোকজন এসে মরাঠি আর হিন্দি মিশিয়ে বোঝালেন— এখনই ইঞ্জেকশন নেওয়া প্রয়োজন, হাসপাতালে যেতে হবে। বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানে ইঞ্জেকশন নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সকলেই দেখতে চাইছেন প্রেসক্রিপশন। যেতে বললেন হাসপাতালে।

ঝকঝকে বেসরকারি হাসপাতালে যেতেই লিখে দেওয়া হল প্রেসক্রিপশন। ওষুধের অ্যাম্পুল আর সিরিঞ্জ কিনে আনা হল। বেডে নেওয়া হল। এল মিনারেল ওয়াটারের বোতল। জল খাইয়ে নার্স ইঞ্জেকশন দিলেন। দশ মিনিট পরে ছুটি। ছুটির সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল বিছানার চাদর। বিলের লাইনে দাঁড়িয়ে যে বিল পাওয়া গেল তার অঙ্ক শূন্য।

এই দৃশ্য দেখে মনে হল, আমাদের রাজ্যের মফস্‌সলগুলিতে কিন্তু এ সব একেবারেই অপরিচিত। এখানে ওষুধের দোকানে ইচ্ছেমতো ওষুধ পাওয়া যায়। ঘুমের ওষুধ আর কিছু নার্ভের ওষুধ ছাড়া, প্রেসক্রিপশন তেমন লাগে না বললেই চলে। ছোটখাটো ইঞ্জেকশন ইত্যাদি বিষয় ওষুধের দোকানেই মিটে যায়। প্রয়োজন মতো এক দিন বা দু’দিনের ওষুধ কিনে নেওয়া যায়। সমস্যা মিটে গেলে ওষুধ খাওয়া অপ্রয়োজন বলে মনে হয়। কোর্স শেষ করা বাহুল্য মনে হয় তখন। সকলেই এই ভাবেই চলেন— ওষুধ-ক্রেতা এবং ওষুধ-বিক্রেতা।

শিক্ষিত বাঙালির হোমিয়োপ্যাথি চর্চার একটা রেওয়াজ ছিল। কখনও কখনও সেটা ছিল যেন কিছুটা শ্লাঘারও বিষয়। সেটা একটা অন্য দিক। কিন্তু, বাঙালি যেন সহজাত ভাবে বোরোলিন আর প্যারাসিটামলের সর্বব্যাপী ব্যবহারবিধি জেনেই জন্মায়। ছোটখাটো চোট-আঘাত, ব্যথা-যন্ত্রণা আর জ্বর-জ্বালাকে সে তেমন পাত্তা দেয় না। আর, এখান থেকেই জন্ম নেয় ওষুধের দোকান থেকে ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খাওয়ার প্রবণতা, কোর্স শেষ না করার এই অভ্যাস। এর থেকেই আসছে ‘ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্স’।

গণচেতনা হল এই যে— ডাক্তারের কাছে গেলেই ওঁরা অহেতুক অতিরিক্ত ওষুধ লেখেন, এটা-ওটা পরীক্ষা করতে দেন। গত বছরের শেষ দিকে রাজ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতর থেকে অ্যান্টিবায়োটিক সংক্রান্ত একটি বিস্তৃত গাইডলাইন প্রকাশ করা হয়, যেখানে কোনও রোগের জন্য কী কী ওষুধ ব্যবহার করা যাবে, কোন ওষুধগুলি অতিরিক্ত, কখন কোন অ্যান্টিবায়োটিক টেস্ট করতে হবে অথবা কখন টেস্ট না করে ওষুধ দেওয়াই যাবে না— তার একটি খসড়া করে দেওয়া হয়।

অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে এত ভাবতে হচ্ছে কেন? ভাবতে হচ্ছে, কারণ যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ফলে রেজ়িস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে। ফলে, প্রয়োজনের সময় আর কাজ করছে না ওই অ্যান্টিবায়োটিক। নীরবে চোখ রাঙাচ্ছে ‘ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্ট টিবি’। এই ‘ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্ট টিবি’র জন্য বিসিজি টিকার মতো প্রতিষেধকের কথাও ভাবছে কেন্দ্র। সেই মর্মে চলছে গবেষণা ও প্রস্তুতি। কিন্তু এর ভয়াবহতা অনুধাবন করার জন্য সরকারের তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে দরকার নাগরিক সচেতনতা। বোঝা দরকার, কিছু কিছু কাজ করে আমরা কেবল নিজেদের অপকারই করছি না, গোটা সমাজকেও বিপদে ফেলছি।

অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন যথাযথ কার্যকর হলে হয়তো বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনাবশ্যক কিছু ওষুধ লেখা নিয়ন্ত্রিত হবে। তবে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে লং-কোভিডের ফলে ইমিউনিটি দুর্বল হয়ে পড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বেলাগাম নগরায়ণ প্রভৃতি কারণে সারা বছরই মানুষের জ্বর-জ্বালা লেগে থাকছে। ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার আগে একটা মরসুম ছিল, এখন আর তা সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। এই পরিস্থিতিতে ‘ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্স’ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন না হলে, ইচ্ছেমতো ওষুধ খাওয়া ও ইচ্ছে হলে বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে না এলে সমূহ বিপদ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Health care life risk

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}