দু’শো বছর আগে ক্যাথলিক গির্জার এক পাদরি ঘোষণা করেছিলেন, জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়। তিনি ‘বংশগতির জনক’ গ্রেগর জোহান মেন্ডেল (ছবিতে)। মেন্ডেলের ঘোষণা সে সময়ে বৈপ্লবিকই ছিল। কারণ, তার আগে পর্যন্ত বংশগতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনও তত্ত্ব ছিল না। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সঙ্গে মেন্ডেলের তত্ত্ব জীববিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ২০ জুলাই ছিল মেন্ডেলের ২০০তম জন্মদিন।
মেন্ডেল অস্ট্রিয়ার ‘মগজের আখড়া’ ট্রপাউ জিমনেসিয়ামে পড়তেন। তাঁর পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ফ্রেডরিখ ফ্রাঞ্জ নিজেও যাজক ছিলেন। মেন্ডেলকে তিনি জানান, ক্যাথলিক গির্জার অগাস্টিনিয়ান অর্ডার বুদ্ধিবৃত্তির সাধনাকে মূল্য দেয়। তিনি জোহানকে যাজক হওয়ার পরামর্শ দেন। বলেন যে, এই জীবনে তিনি পড়াশোনা ও শিক্ষকতা, দুই-ই করতে পারবেন। জোহান ১৮৪৩ সালে ব্রুনে সেন্ট টমাস গির্জায় যোগ দেন।
১৮৫৭ থেকে ১৮৬৪ পর্যন্ত মেন্ডেল গির্জার বাগানে উদ্ভিদ প্রজননের অসংখ্য পরীক্ষা করেছিলেন। একাধিক প্রজন্ম ধরে কয়েক হাজার মটরগাছের তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের গণনা করেছিলেন। মটরগাছের তথ্য থেকে বংশগতির যে সব নিয়ম খুঁজে পেয়েছিলেন, তা অন্যান্য গাছেও প্রযোজ্য। তিনি গণনা ও অনুপাত থেকে বংশগতির নিয়ম (মেন্ডেলের তত্ত্ব) আবিষ্কার করেছিলেন। ১৮৬৫-তে ব্রুনের ‘সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব দ্য ন্যাচারাল সায়েন্সেস’-এর সদস্যদের সামনে মেন্ডেল তাঁর উদ্ভিদ সঙ্করায়ণের পরীক্ষার ফলাফল সম্বলিত গবেষণাপত্র পেশ করেন। ইতিহাসবিদ লরেন আইজ়লি-র লেখায় পাওয়া যায়, “শ্রোতারা স্থির ভাবে শুনেছিলেন… কেউ প্রশ্ন করেননি, একটি হৃদ্স্পন্দনেরও গতি বাড়েনি। …এক জনও তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারেননি।” পরবর্তী ৩৫ বছরে তাঁর কাজ মাত্র তিন বার উদ্ধৃত হয়েছিল।
১৯০০ সালে তিন উদ্ভিদবিজ্ঞানী— হুগো ডি ভ্রিস (নেদারল্যান্ডস), কার্ল কোরেন্স (জার্মানি) এবং এরিখ ভনশেরমাক (অস্ট্রিয়া) স্বাধীন ভাবে মেন্ডেলের প্রণালীগুলো ফের আবিষ্কার করেছিলেন। তখন মেন্ডেলের নিয়মগুলি পরিচিতি পায়। তবে বিজ্ঞানীরা খুব দ্রুত অনুধাবন করেছিলেন যে, মেন্ডেলের ফলাফলগুলি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর্চিবল্ড গ্যারোড ১৯০২ সালে ঘোষণা করেছিলেন যে, আলকাপটোনুরিয়া নামক মানব রোগের সংক্রমণ— যা ত্বকের বিবর্ণতা এবং কালো ঘাম-সহ আরও নানা সমস্যা ঘটায়— তা মেন্ডেলিয়ান নিয়মেই চলে।
দুর্ভাগ্যবশত, স্তালিনের (১৮৭৮-১৯৫৩) শাসন কালে মেন্ডেলিজ়মের যুক্তিবাদী ভিত্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। জীবনভর মেন্ডেলকে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রথমত, তাঁর আবিষ্কার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। দ্বিতীয়ত, তিনি যাজক ছিলেন। বিজ্ঞানীরা সাধারণত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের বাইরের মানুষের আবিষ্কারকে সহজে গ্রহণ করেন না। তৃতীয়ত, মেন্ডেল যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, তা তাঁর সময়ের জন্য বৈপ্লবিক ছিল। তিনিই হয়তো প্রথম, যিনি জীববিজ্ঞানে গুরুত্বের সঙ্গে গণিত প্রয়োগ করেছিলেন। উদ্ভিদবিদেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিবর্তে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কাজ করতেন। চার্লস ডারউইনও ফলাফল বিচারের সময় গণনার পরিবর্তে পর্যবেক্ষণের উপরই নির্ভর করতেন।
মেন্ডেলের তত্ত্ব খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়াতে, মানুষের রোগের কারণ বুঝতে, ওষুধ আবিষ্কারে সাহায্য করেছে। জিনোমিক মেডিসিনের যুগ এনেছে। যদিও মেন্ডেলের বৈজ্ঞানিক অবদানের প্রতি যে ঐতিহাসিক অবহেলা হয়েছিল, তা থেকে শেখার যে, নতুন চিন্তা বা মতামত গ্রহণ করায় আমাদের আরও উদার হওয়া উচিত। আজ তো ‘অভিনব’ কিংবা ‘উদ্ভাবন’ শব্দগুলোর সঙ্গে গোটা বিশ্ব পরিচিত, তা সত্ত্বেও ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনা আদৌ কতটা স্বাগত?
তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব তো রয়েইছে। ১৯৪০-এর দশকে সোভিয়েট রাশিয়ার জেনেটিক্স ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ট্রফিম লাইসেঙ্কো মেন্ডেলের তত্ত্বকে বলপূর্বক খারিজ করিয়ে একটি ধূর্ত তত্ত্ব উত্থাপন করেছিলেন, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। কিন্তু সরকার-ঘনিষ্ঠ বিজ্ঞানী লাইসেঙ্কোর তত্ত্ব রাশিয়ায় তদানীন্তন শাসনকর্তাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। ফলে তৎকালীন সোভিয়েট রাশিয়া মেন্ডেলের তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছিল। যাঁরা লাইসেঙ্কোর বিরোধিতা করেছিলেন বা মেন্ডেলিয়ান তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল। মৃত্যুদণ্ডও হয়েছিল বহু বিজ্ঞানীর।
সেই ‘ছদ্ম-বিজ্ঞান’এর জয়জয়কার এখনও অব্যাহত। তা রাজনৈতিক বিশ্বাস ও অন্ধ মতাদর্শ দ্বারা চালিত হয়। ভারতে এই উন্মাদনা তুঙ্গে। এমন ক্ষেত্রে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy