আন্দোলন: মহার্ঘ ভাতার দাবিতে সরকারি কর্মীদের মিছিল। ৬ মে, কলকাতা। রণজিৎ নন্দী।
ভাল বাংলা সিনেমা যাঁরা দেখেন, তাঁরা একটি সিনেমার নাম অবশ্যই জানেন— শূন্য থেকে শুরু। যদিও চলচ্চিত্রটির প্রতিপাদ্য বিষয় বেশ কিছুটা আলাদা, কিন্তু বর্তমান বঙ্গ সার্কাসে নামটির তাৎপর্য আছে। শূন্য পাওয়া শিক্ষক ক্লাসে পড়াচ্ছেন, আর যিনি ভাল শিক্ষক হতে পারতেন, তিনি ধর্না মঞ্চে। রাজ্যে এখন বিভিন্ন রকমের ধর্নামঞ্চ চারিদিকে। সৎ পথে চাকরি পাওয়া সরকারি কর্মচারীরাও ধর্না মঞ্চে, তাঁরা তাঁদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না। তাঁরা নাকি বেশি চাইছেন, অপরাধ করছেন। যাঁরা সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করলেন, রাত জেগে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলেন, ভাল সরকারি চাকরি পেলেন, তাঁরা কেন মহার্ঘ ভাতা পাবেন, সেই নিয়ে তরজা হচ্ছে। অবশ্য, যাঁরা সৎ পথে চাকরি পেয়েছেন, আমি শুধু তাঁদের কথাই বলছি। মহা দুর্ভাগ্য যে, আজকাল এটাও স্পষ্ট করে বলে দিতে হচ্ছে।
মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়, যাতে চাকরিজীবী মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। সাধারণত এক জন সরকারি চাকরিজীবী নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করেন, অর্থাৎ তার বেতন বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন রকম হয় না। যদি মূল্যস্ফীতি হয়, তা হলে সেই নির্দিষ্ট বেতন থেকে তাঁর ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। মহার্ঘ ভাতা কোনও দয়ার দান নয়। এক জন সরকারি কর্মচারী দশটা-পাঁচটা কাজ করে এটি অর্জন করেন, কোনও লাইনে দাঁড়িয়ে নয়। আবার বলি, এই অধিকার তাঁরা অর্জন করেন যৌবনে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যয়নের ফলে। তাঁদের ‘চোর-ডাকাত’ বলার অর্থ মুড়ি-মিছরি এক দর করার প্রচেষ্টা। কারা মুড়ি কারা মিছরি, তা আমাদের জানা।
মহার্ঘ ভাতা না দেওয়ার পিছনে অদ্ভুত কিছু যুক্তি দেওয়া হয় আজকাল। যেমন, যে মানুষটি রাস্তায় ফল বিক্রি করছেন, তিনি তো মহার্ঘ ভাতা পাচ্ছেন না— তা হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে তাঁকে কী ভাবে রক্ষা করব? একটা কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্য যখন বৃদ্ধি পায় তখন ফলের দামও বাড়ে। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গেবর্ধিত হারে ফল বিক্রি করে নিজের রোজগার বাড়ান, যা বাজারের নিয়মেই হয়। এক জন সরকারি কর্মচারীর মাইনে কিন্তু সারা বছর ওঠা-নামা করে না। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের আয়ও নির্দিষ্ট থাকে না। তাঁদের আয় অনেক ক্ষেত্রে যাঁরা নির্দিষ্ট বেতনে কাজ করেন তাঁদের তুলনায় বেশি হয়। আর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাঁদের অনেকের আয় বাড়ে, কারণ তাঁরা তাঁদের ‘সার্ভিস’-এর দাম অনেক ক্ষেত্রে বাড়াতে সক্ষম হন, এই ‘সার্ভিস’-এর দাম বাড়াটাও মূল্যস্ফীতিরই একটি অঙ্গ।
আর একটি যুক্তি হল যে, সরকারি কর্মচারীরা যথেষ্ট বেতন পান, তাই ‘জনগণের টাকা’ আর তাঁদের দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যদিও এখানে বলে রাখা দরকার যে, সব সরকারি কর্মচারী কিন্তু যথেষ্ট বেতন পান না। অনেকেই যথেষ্ট কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছেন। ‘জনগণের টাকা’ বলতে কী বোঝায়, তা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। সরকারের কাছে অর্থ আসে বিভিন্ন কর বাবদ, যার একটা বড় অংশ আসে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর থেকে। আর একটি অংশ আসে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে, যা বর্তমানে প্রধানত জিএসটি-র অন্তর্ভুক্ত। জিএসটি কেন্দ্র ও রাজ্য সমান সমান পাওয়ার কথা; মোট আয়কর সংগ্রহের একটি অংশ কেন্দ্র রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কিছু নিয়ম অনুসারে ভাগ করে নেয়। এই ভাগাভাগি নিয়ে অনেক সময় বেশ কিছু রাজ্য অখুশি থাকে— আমরা বঙ্গবাসীরা যেমন ‘কেন্দ্রের চক্রান্ত’ কথাটা ছোটবেলায় ‘অ-আ ক-খ’ শেখার আগেই শিখে এসেছি। আরও কিছু কর বা শুল্ক আছে যার থেকে সরকারের আয় হয়, যেমন কর্পোরেট কর, আমদানি রফতানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক, জ্বালানি শুল্ক, বাড়ি-জমি কেনার কর ও রেজিস্ট্রেশন চার্জ ইত্যাদি, যার মধ্যে বেশ কিছু রাজ্য পুরোটা পায়। এই নিয়ে বিশদে আলোচনা এই লেখনীর প্রতিপাদ্য বিষয় নয়।
আয়কর কারা দেন? প্রধানত চাকরিজীবীরা, যার একটা বড় অংশ সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়র প্রভৃতি। অর্থাৎ, যা আমাদের ‘জনগণের টাকা’ বলে শোনানো হচ্ছে, তার একটা বড় অংশ আমাদের থেকেই নেওয়া হয়। এবং সেই টাকায় উন্নয়নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দানছত্র খোলা হয়েছে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য, ভোটে জয়লাভ নিশ্চিত করার জন্য। এমনিতেই রাজ্যের একটা বড় অংশ উন্নয়নের মানেই বোঝে না। তাদের কোনও উচ্চাশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। তারা অল্পে সন্তুষ্ট, আর এই অল্পে সন্তুষ্ট হওয়াটা যে একটা ‘মহান’ ব্যাপার, তা আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম শেখানো হয়েছে।
এর উপর কবিতা, গান লেখা হয়েছে, যা আমরা গণসঙ্গীত হিসেবে গলা কাঁপিয়ে অনেক দিন ধরে গেয়ে চলেছি। তাই এই ঐতিহ্য আমাদের অনেক দিনের। তা সহজে যাবে কি? আর সর্বত্র একটি ছোট স্বার্থপর সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী থাকে, যারা শুধু নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত। মহার্ঘ ভাতার বিরুদ্ধে এই বিচিত্র যুক্তিক্রমের রচয়িতা মূলত তারাই। এই যুক্তিক্রম ভেঙে বেরোতে বললে হয় আমরা শ্রেণিশত্রু হয়ে যাব, না হলে বুর্জোয়া।
এ বার জিএসটি-র কথা ধরা যাক। যখনই কিছু জিনিস আমরা কিনি, আমাদের সবার থেকে জিএসটি নেওয়া হয়। তাই ‘জনগণের টাকা’ জিএসটি-তে সবার অবদান আছে— যার মধ্যে সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়র সবাই আছেন। অর্থাৎ আয়করে অবদান, আবার জিএসটি-তে অবদান, তার পরও শুনতে হয় যে, ‘ওরা’ অনেক পায়, জনগণের টাকা ওদের দেব কেন! একদম ঠিক। মানুষ লেখাপড়া করে ভুল করেছে। সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, চিকিৎসক হয়ে ভুল করেছে। এমনিতেই প্রতিভার দাম কোথাও নেই। মুড়ি-মিছরি এক দর করে তোলার প্রচেষ্টা সর্বত্র। আজকাল কঠোর পরিশ্রম করা মানুষেরা রাস্তায় চাকরির জন্য ধর্নায় আর শূন্য-পাওয়ারা বিভিন্ন চাকরিতে— কেউ আবার স্কুলে পড়াচ্ছেন, কেউ বোর্ডে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে চক ভেঙে ফেলছেন।
ইদানীং আবার সাম্যের যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, রাজ্য, কেন্দ্র— কারও নাকি মহার্ঘ ভাতা দেওয়া উচিত নয়। তাতে নাকি অসাম্য বাড়ছে। সেই যুক্তিতে তো সমস্ত ভারতবাসীকে তাদের গড় জাতীয় আয় অর্থাৎ মাসে সতেরো হাজার টাকা দেওয়া উচিত। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, অধ্যাপক, শিক্ষক, খেলোয়াড়, সাংবাদিক, শিক্ষাকর্মী— সবাই মাসে সতেরো হাজার পাবেন। যাঁরা ‘সরস্বতী’ বানান লিখতে কলম ভেঙে ফেলেন, কিন্তু বিসর্জনে উদ্দাম নৃত্য করেন, তাঁরাও মাসে সতেরো হাজার। এ পথে গেলেই বুঝি আমরা চরম সাম্যের দিকে এগিয়ে যাব।
মুড়ি-মিছরিকে এক ভাবে দেখানোর চেষ্টা, এবং এর থেকে রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনের চেষ্টা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। পিরামিডের নীচটা যে বরাবরই অনেক বড়, জনসংখ্যা অনেক বেশি। রাজনীতি আসলে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চায় যে, দেখো তুমি জীবনে কিছু করতে না পারলেও ‘আমরা’ আছি। অতি উত্তম প্রস্তাব। তাঁদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করুন, কলকারখানা খুলুন, শিল্প আনুন। তাতে সমস্ত মানুষের তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী কিছু না কিছু চাকরি হবে। আর দানছত্র খুলতে হবে না। কিন্তু এ যে বড় পরিশ্রমের কাজ। তার থেকে দানছত্র খুলে জনপ্রিয়তা পাওয়া সোজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy