Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
উৎসবের আলো ম্নান হয় নারীর অমূল্যায়িত শ্রমের কথায়
Housewives

কেন চেয়ে আছ, গো মা

ছুটি এবং উৎসব মানেই মেয়েদের মাথায় গৃহশ্রমের বাড়তি বোঝা। বাঙালিকে ছন্দ শেখাতে গিয়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “দিদি আসুন, ময়দা ঠাসুন, আজকে রবিবার/ মোহনভোগের সঙ্গে লুচি জমবে চমৎকার।”

An image of a woman

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪৫
Share: Save:

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুপঠিত কবিতায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে লিখতে ইচ্ছে করে, ‘উৎসবের দিনে আমি আশাপূর্ণা দেবীর লেখা পড়ি না... কেননা তাঁর কিছু লেখা উৎসবের দিনে আমাদের মুখ ম্লান করে দেয়।’ কতই বা আগের গল্প সে সব? আমাদেরই মাতামহী বা মায়ের মাতামহীদের কথা— ভাদ্র মাস শুধুই আগমনীর প্রস্তুতির সময় নয়, এ সময় গেরস্তর মেয়েদের দম ফেলার সময় থাকে না। স্যাঁতসেঁতে বিছানা, কাঁথা, তোরঙ্গে তোলা কাপড়, চাদর, ভাঁড়ারের সম্বচ্ছরের মজুত বড়ি, আচার, মশলাপাতি, ডাল সমস্ত কিছু ভাল করে ভাদুরে রোদ খাইয়ে তুলে রাখতে হয়। পুজোকাটালির দিনে ছেলেপিলেরা ইস্কুলের ছুটি পেয়ে ঘুরেফিরে মুখরোচক কিছু খেতে চায়। বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করতে এলে আত্মীয়স্বজনদের সামনে ধরে দিতে হয় নিমকি, জিবেগজা, নাড়ু, মালপোয়া। হাঁড়িভর্তি মুগের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু বা তিলের নাড়ু মাচায় তুলে রাখতে পারলে হয়তো মেলে ‘মাসখানেকের মতো জলপানের দায়ে নিশ্চিন্দি’। কেউ হাতের জোরে কুরিয়ে চলে নারকেলের পর নারকেল, কেউ বা জাঁতা ঘুরিয়ে মুগডাল ভাঙে।

আশাপূর্ণার সময়ের হিন্দু গৃহস্থের মেয়ে-বৌদের জগৎ থেকে অনেক দূরে, অনেক বছর পরে, গ্রামে জলসা বসার সময়ে মিড-ডে মিলের কর্মী এক দিদি বলছিলেন, “বাড়িতে কত কুটুম এসেছে জানো?” কাকভোরে উঠে এক প্রস্থ রান্নাবান্না সেরে ইস্কুলে ছেলেমেয়েদের জন্যে রান্না করতে এসেছেন তিনি। কাজ মিটলে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি ঢুকেই বাকি সমস্ত কাজ সারবেন।

ছুটি এবং উৎসব মানেই মেয়েদের মাথায় গৃহশ্রমের বাড়তি বোঝা। বাঙালিকে ছন্দ শেখাতে গিয়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “দিদি আসুন, ময়দা ঠাসুন, আজকে রবিবার/ মোহনভোগের সঙ্গে লুচি জমবে চমৎকার।” পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের অন্দরে বণ্টনের অসাম্য যার ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্র, সে এমন ফিল-গুড, আপাত-মজাদার লাইনের ভিতরেও খুঁজে পায় অমূল্যায়িত শ্রমের জটিল রাজনীতি। ছুটির দিন জমিয়ে দিতে রসনাতৃপ্তির রকমারি আয়োজন করতে গিয়ে ঘরের মেয়েদের আর ছুটি মেলে না। কাজের চাকা ঘুরে চলে ‘একটানা এক ক্লান্ত সুরে’, সপ্তাহের সাতটি দিনেই।

কলকাতার এক পুরনো পুজো-পরিবারে জন্মানোর সূত্রে ছোট থেকে দেখেছি, পরিবারের মহিলারা কী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এই ক’দিন। কাঠের জ্বালে রান্না হয় ঠাকুরের রকমারি অন্নব্যঞ্জন। পরিবারের যে বধূ ভোগ রাঁধেন, ভোগ নামার আগে জলস্পর্শ করতে পারেন না তিনি। ভোগ বিতরণের পালা মেটার পরে যত ক্ষণে তিনি খেতে বসেন, তত ক্ষণে হেমন্তের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে। ষষ্ঠী বা অষ্টমীর দিন অন্নস্পর্শ করা চলে না। মুখে কিছু তুলতে না তুলতেই আবার সন্ধেবেলার লুচি ভাজার ডাক পড়ে। কাজের ধকলে ব্লাড প্রেশার আর ডায়াবিটিসের রোগী মা-জেঠিমারা অনেকেই পুজো মিটতে না মিটতে অসুস্থ হয়ে পড়েন ফি বছর।

এ পরিবারে বিয়ে হয়ে আসার আগে, খুব ছোট বয়স থেকেই আমার মা সামলাতেন দিদিমার সংসার। এগারোটি সন্তানের জন্ম দিয়ে বছরের বেশির ভাগ সময়টাই একা হাতে গৃহকাজ সারার জোর থাকত না দিদিমার। কাজেই প্রথম দিকে জন্মানো মেয়েদের কাঁধেই ন্যস্ত হয়েছিল হেঁশেল ঠেলা এবং শিশুপালনের গুরুভার। আমার স্কুলপড়ুয়া মা উনুনে আঁচ ধরাতে ধরাতে ক্লাসের পড়া মুখস্থ করত, যৌথ পরিবারের সকলের জলখাবার এবং দুপুরের খাওয়াদাওয়ার অনেকখানি বন্দোবস্ত করে তবে দু’পাশে দুই বিনুনি ঝুলিয়ে স্কুলে ঢুকতে পেত। বিকেলে মা আর মাসি আটা মেখে রুটি করতে বসত। পাড়ার লোকেরা বলত দেড় বছরের বাচ্চা বসে থাকলে যতখানি উঁচু হয়, ওদের বাড়িতে ততগুলো রুটি হয়। পুজোর ছুটিতে কাজ বাড়ত অনেক বেশি। আচার-বড়ি-জোয়ান-আমসত্ত্ব-পাঁপড়— রকমারি রান্নাবান্না, শীতের জামাকাপড় রোদে দেওয়া— হুশ করে কেটে যেত ছুটির এক মাস। মেয়েরা বাড়িতে থাকলে সংসারের কাজ সহজে হয়ে যায়। ভগ্নস্বাস্থ্য, কাজে খানিক অপটু দিদিমার একটু সুসার হয়।

এমনই এক পুজোর ছুটির পরে, দিদিমা ক্লাস এইটের মাকে বললেন, আর ইস্কুলে গিয়ে কাজ নেই। মা যে ঠিক করে রেখেছে বড় দিদিমণির মতো বাংলায় এম এ পাশ করে স্কুলে পড়াবে, সে খবর দিদিমা রাখতেন না। প্রবল কান্নাকাটি করে ইস্কুলের খাতায় নাম কাটানো আটকায় মা। কান্নাকাটি, জেদাজেদির ফলে রেজিস্টারে নাম থাকে, সে নাম ডাকাও হয়, কিন্তু দিনের পর দিন মায়ের নামের পাশে লেখা হতে থাকে ‘অনুপস্থিত’। দিদিমার শরীর ভোগাতে থাকে, নিত্য অসুখ লেগে থাকে। এক দিন স্কুলে অ্যানুয়াল পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হচ্ছে। অনেক দিন পর ক্লাসে উপস্থিত মা। হঠাৎ দারোয়ান এসে মায়ের নাম ধরে ডেকে যান, বাড়ি থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। বার বার ডাকার পরেও মা মাথা নিচু করে থাকে, সাড়া দেয় না। তখন ক্লাসে আসেন মায়ের প্রিয় মানুষ, স্কুলের বড়দি। গম্ভীর স্বরে বলেন, “কী ব্যাপার? সাড়া দিচ্ছ না কেন? তোমার মা অসুস্থ, বাড়ি থেকে ডেকে পাঠিয়েছে যে!” দু’চোখে জলের ফোঁটা টলটল করে, কোনও মতে মা বলে, “আঠেরো দিন আসিনি, আজ এলাম। পরীক্ষার রুটিন টুকছি৷ একটা পিরিয়ডও হয়নি...।” বড়দি খানিক ক্ষণ চুপ করে থাকেন। তার পর মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। নরম গলায় বলেন, “যাও। বাড়ি যাও। অদৃষ্টকে তো মেনে নিতে হবে।”

‘ভাল’ মেয়েরা মুখ বুজে সকলের সেবা করে; পরিবারের ভিতরে অন্যায়, অসাম্য বা বঞ্চনা থাকতে পারে সে কথা অস্বীকার করে— এমন একটা আখ্যানের উপরেই যে আমাদের সমাজ অনেকখানি দাঁড়িয়ে আছে, সে কথা সমাজতাত্ত্বিকেরা অনেক আলোচনা করেছেন। বস্তুত মেয়ে-পুরুষ মিলিত ভাবে টিকিয়ে না রাখলে এ ব্যবস্থা তো কবেই ভেঙে পড়ত! জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক বার দেখেছিলাম স্বামীর হাতে মার খেয়েও অপমানিত বোধ না করার সম্ভাবনা উচ্চবর্ণ হিন্দু পরিবারে বেশি। পিয়ের বর্দিউর ‘সিম্বলিক ভায়োলেন্স’-এর ধারণার অবতারণা করে এই ‘রেজ়াল্ট’টির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। আশাপূর্ণা অবশ্য অনেক আগেই দেখিয়ে গিয়েছেন, অত্যাচার এবং বঞ্চনাকেই স্বাভাবিক মনে করে, আত্মত্যাগের মোড়কে সে সব গ্রহণ করে মহীয়সী হতে চেয়েছে কত মেয়ে।

মায়ের গল্পের সঙ্গে কী ভীষণ মিল সুবর্ণলতা বইয়ের মল্লিকার গল্পের! ঠাকুমার সঙ্গে তাকে বেড়াতে যেতে দিতে চায় না তার লবেজান, মুখচোরা মা। যে নিজেও যাচ্ছে বড়লোক দিদির বাড়িতে। কিন্তু বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে অতগুলি ছেলেমেয়েকে সামলাবে কে, বড় মেয়ে মল্লিকা ছাড়া? নিতান্ত নিরুপায় হয়েই বাক্সে জমানো কয়েনটির লোভ দেখায়। বলে, “চল না মা আমার সঙ্গে...।” মেয়েদের অবসর, উৎসব, ছুটির রাজনীতি এমনই করুণ ভাবে উঠে আসে আশাপূর্ণা দেবীর লেখায় যে, উৎসবের দিনে আমি তাঁর লেখা পড়ি না। বন্ধ করে রাখি তাঁর বই। আর ঠিক তখনই তাঁর চরিত্রের সমনাম্নী বাংলা সাহিত্যের আর এক শক্তিশালী নারী, মল্লিকা সেনগুপ্ত ফিসফিস করে কানের ভিতরে পড়ে দেন মেয়েদের বর্ণমালা— “ৎ-এ ক্রান্তিকাল/ পার্সোনাল ইজ় পলিটিকাল।”

মেয়েদের জন্য ভোটের বাজারে সারি সারি ঘোষণা, সরকারি প্রকল্পের পর প্রকল্প, সিনেমা-সিরিজ়ে মেয়েদের গল্পের ছড়াছড়ি। এ যদি ক্রান্তিকাল না হয়, তবে ক্রান্তিকাল বলব কাকে? শুধু ভয় দেখায় কতকগুলো সংখ্যা। আঠারোর আগে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ের সংখ্যা, শ্রমের বাজারে যোগ দিতে না পারা মেয়ের সংখ্যা, গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়া মেয়ের সংখ্যা, আর গার্হস্থ হিংসায় ন্যায্যতা খুঁজে পাওয়া মেয়ের সংখ্যা। আমরা যারা নানাবিধ সুযোগ ও সুবিধা পেয়ে সে সব কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, তারা যেন এই ক্রান্তিকালেও মায়ের স্কুলের বড়দির মতো এই মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে চলেছি, “যাও, বাড়ি যাও৷ অদৃষ্টকে তো মেনে নিতে হবে!”

অন্য বিষয়গুলি:

Housewives Household Chores festive season
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy