চুক্তিতে তরমুজ নেবে, এমন কাউকে চেনেন? এক জন প্রশ্নটা করতেই বাকিরা ঝুঁকে পড়লেন উত্তরটা শুনতে। হরদম বড় বড় ট্রাক যাচ্ছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে রাস্তার ধারের ছোট অফিস-কাম-গুদাম। দেওয়ালে ফ্লেক্স, তাতে একটি বহুজাতিক চিপস কোম্পানির নাম আর লোগো। নীচে লেখা “সংযোগে আলুচাষ করে লাভবান হোন।” দশঘরার সুনীল সামন্ত, ঈশা খলিফা, মশাটের উজ্জ্বল ঘোষ, রামনারায়ণপুরের বাসুদেব খামরুই চুক্তিতে আলু চাষ করে লাভ করেছেন। চুক্তিতে কলার চাষে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া— ক্ষতি হয়নি, তবে লাভও তেমন নেই। এ দিকে প্রচুর তরমুজ প্রতি মরসুমে জলের দরে দিতে হয়। তাই আগ্রহ, চুক্তিতে তরমুজ চাষ কি কেউ করাবে?
না, তা জানা নেই। তবে চুক্তি চাষ যে চাষির কাছে আকর্ষক, তা তো জানা গেল। হুগলি, বাঁকুড়ার চাষিরা বলছেন, এর প্রধান সুবিধে দামের নিশ্চয়তা। আলু বসিয়ে বলে দিতে পারি, কত টাকা ঘরে আসবে, বললেন চাষিরা। গত বছর কোম্পানির আলুর দর ছিল ৯৩০ টাকা, জ্যোতি আলুর বাজার দর উঠেছিল ১২০০-১৪০০ টাকা কুইন্টাল। এ বছর মস্ত পতন— জ্যোতি আলু ছ’শো টাকাও ওঠেনি। কোম্পানি দিচ্ছে ৯৪০ টাকা কুইন্টাল। লাভ বিঘায় দশ-পনেরো হাজার টাকার মতো। “গত বছর জ্যোতি আলুর চাষিরা আমাদের দেখিয়ে বগল বাজিয়েছিল, এ বছর আমরা বাজাব”, বললেন বাসুদেব খামরুই। দেড় বিঘা জমির পুরোটাই কোম্পানির আলু চাষ করেন তিনি। চুক্তি চাষ খোলা বাজারের অনিশ্চয়তা থেকে তাঁকে সুরক্ষা দিয়েছে, এই হল তাঁর সাত-আট বছরের অভিজ্ঞতা।
‘বেসুরো’ মনে হচ্ছে কি? যে কৃষি আন্দোলন সারা দেশকে উতলা করেছে, তার দাবির সঙ্গে বাংলার চাষির কথা মেলে না। এমন আরও আছে। কেন তাঁরা মান্ডিতে গিয়ে নিজেরাই তরমুজ বিক্রি করেন না, প্রশ্ন করলে তারকেশ্বর অঞ্চলের চাষিদের উত্তর, মান্ডিতে খোলা বাজারের চাইতেও কম দাম মেলে। অর্থাৎ, সরকার-নিয়ন্ত্রিত মান্ডি (এপিএমসি), কৃষি আন্দোলন যাকে চাষির রক্ষাকবচ মনে করছে, তা বাংলার চাষিদের হতাশা ও বিরক্তির স্থান। তাঁরা মান্ডিমুখী হন শুধুমাত্র সরকারকে ধান বিক্রি করতে, হেনস্থা হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে। সরকারি মান্ডি চালকল মালিক এবং ফড়েদের নিয়ন্ত্রণে। নিয়ন্ত্রিত বাজার যদি চাষির জন্য সুবিধেজনক হত, চাষি নিজেই সেখানে যেতেন, তাঁর উন্নতির জন্য বিডিও-এডিওর কাছে ডেপুটেশন দিতেন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে চাষি মান্ডির চাইতে বেশি দাম পান খোলা বাজারে। আরও বেশি দাম দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে চাষি পান ‘সুপারমার্কেট চেন’-কে বিক্রি করে। ২০১৩ সালে সব রাজ্যের কৃষিমন্ত্রীকে নিয়ে তৈরি কমিটি বলেছিল, বাজার এলাকায় একটাই মান্ডি থাকায় একচেটিয়া দর তৈরি হয়। দামে স্বচ্ছতা থাকে না।
এ কথাগুলো কৃষি আইনের আলোচনায় টেনে আনতে কেউ চাইছেন না, পাছে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়! কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নির্লজ্জ সাঙাততন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, আর মদত দেওয়া হয় পেটমোটা কর্পোরেটদের। যাঁরা দারিদ্র নিয়ে লেখালিখি করেন, আন্দোলন করেন, গরিবকে নানা সহায়তা করেন, কৃষি আন্দোলন তাঁদের ফাঁপরে ফেলেছে। তাঁদের অনেকে, বিশেষত বামপন্থীরা, এই অবস্থান নিয়েছেন যে, বড় ও ছোট চাষির স্বার্থে নানা সংঘাত থাকতে পারে (ক’দিন আগেও পঞ্জাবের ভূমিহীন চাষিরা আন্দোলন করছিলেন বড় চাষিদের বিরুদ্ধে), কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে আজ হাত মিলিয়ে লড়তে হবে। এ কেবল পঞ্জাবের চাষির আন্দোলন মাত্র নয়।
অবশ্যই, সিংঘু সীমান্তের আন্দোলন কেবল পঞ্জাব-হরিয়ানার নয়, এমনকি কেবল চাষিরও নয়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার গরিবের প্রতি নির্মম, সমালোচকদের প্রতি নিষ্ঠুর। সেই ক্ষোভে দেশ আন্দোলিত হচ্ছে বার বার— কখনও নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায়, কখনও গোরক্ষক কিংবা ধর্ষকদের প্রতি সরকারের প্রশ্রয়ের বিরুদ্ধে, আর এখন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে। এ সব আন্দোলনের প্রতিটাই ‘জনগণদুঃখত্রায়ক’ ভারতের ধারণাকে আঁকড়ে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা। স্বাধীন ভারতের জাতীয় আন্দোলন।
বড় কাজ। তবু তাতেও কাজ শেষ হয় না। দেশ মানে দেশের মানুষ। চাষির রোজগার কিসে বাড়ে, তা দেশেরই প্রশ্ন। কৃষি নীতি কেমন হওয়া চাই, সে কথার গুরুত্ব ‘বিজেপির সুবিধে করা হয়ে গেল কি না’ সেই উদ্বেগের চাইতে অনেক বেশি। নাগরিক সমাজ কথাটা চেপে যাবে কেন? রাজনীতি তো আর কথাটা তুলবে না— একের পর এক বিরোধী রাজ্য কৃষি আইন বাতিলের প্রস্তাব পাশ করছে, আর বিজেপি রাজ্যগুলো আইনের সমর্থনে অধ্যাদেশ বার করছে। কোনও পক্ষই আলোচনার ধার ধারে না। তা হলে চাষির কথাটা বলবে কে? পঞ্জাবের চাষি রাজধানী প্রায় দখল করে নিজের কথা গোটা দেশকে শোনালেন। বাংলার চাষির সে ক্ষমতা নেই। তাঁর কথা তাঁর কাছে গিয়ে শুনতে হবে।
চাষি মুখ খুললেই বোঝা যায়, কাগুজে কথা কত অসার। চুক্তি চাষ নিয়ে অনেকের ভয়, কর্পোরেটের সঙ্গে ছোট চাষি পারবেন কেন? চুক্তি সই করে বেচারি দাস-শ্রমিকে পরিণত হবেন। বাংলায় কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষির সঙ্গে চুক্তি হয় না। হয় ‘ভেন্ডার’-এর সঙ্গে। এই ভেন্ডার বড় চাষি-ব্যবসায়ী। চুক্তির ঝুঁকিটা তাঁরাই বহন করছেন— নিজের টাকায় কোম্পানির থেকে কিনছেন চিপস তৈরির (‘প্রসেসিং ভ্যারাইটি’) আলুর বীজ, রোগ প্রতিষেধক। কোনও ভেন্ডারের সঙ্গে আছেন কয়েক ডজন আলুচাষি, কারও সঙ্গে কয়েকশো। এক বস্তা বীজ পিছু কোম্পানিকে ১০-১৬ বস্তা আলু দেন ভেন্ডাররা, বিনিময়ে পান কমিশন।
চাষির প্রথম সুবিধে, আগাম ঘোষিত দাম। তাতে বাজারের দাম পড়লেও চাষির গায়ে আঁচ লাগে না। পূর্ব-নির্ধারিত দরে ফসল বিক্রি করতে পারে। দুই, উৎপাদন খরচের কিছু অংশ (বীজ, প্রতিষেধক) ভেন্ডার বহন করছেন। চাষির খরচ সার, সেচ আর শ্রম। তিন, রোগ-দুর্যোগের জন্য ফসল মার খেলে চুক্তিভঙ্গের ঝুঁকি ভেন্ডারের, চাষির নয়। চার, বহুজাতিক সংস্থার কর্মীরা চাষিকে জলবায়ুর আগাম খবর দেন, মনে করান কবে প্রতিষেধক দিতে হবে, রোগ হলে ওষুধ বলে দেন। পাঁচ, হিমঘর প্রভৃতি সংরক্ষণ পরিকাঠামোয় উন্নতি। ছয়, হার্ভেস্টার প্রভৃতি যন্ত্র ব্যবহারে বৃদ্ধি।
তার পরেও কি চাষি বিপদে পড়েন না? পড়েন বইকি। বাজারে আলুর দর পড়ে গেলে অনেক সংস্থা যৎসামান্য আলু কিনে চাষিকে এড়াতে চায়, বাড়তি আলু নিতে চায় না। আবার বাজারে দর যদি চড়ে, চাষিরা কোম্পানিকে এড়িয়ে বিক্রি করেন বাজারে। বাঁকুড়ার চাষিরা খোলাখুলি বললেন, গত বছর জ্যোতি আলুর দাম বেড়েছিল বলে তার মধ্যে তাঁরা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন চিপসের আলু। যদিও সে আলু তরকারিতে খেতে মোটেই ভাল না। শর্করা কম, তাই অতি বিস্বাদ।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy