— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কয়েক দশক আগে পাড়ার চায়ের দোকানে আলোচনা হত হিন্দু ও হেয়ার স্কুলের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে কি না তা নিয়ে। পাড়ার স্কুলটার কী হাল, তা আলোচনার যোগ্য ছিল না। এটা কিছুটা আমাদের বামপন্থী বিশ্বভাবনার প্রভাব। তা ছাড়া এ-ও প্রায় সর্বজনীন জ্ঞানের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল যে, কোনও সমস্যারই সমাধান হবে না সমাজ বদল না হলে।ফলে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে না ভেবে পাড়ার স্কুল বা স্থানীয় দূষণ সমস্যা নিয়ে ভাবা বরং প্রগতিবিরোধী। যেখানে মানুষ গড়ার কাজ শুরু হয় সেই স্কুল-কলেজের ক্লাসঘর, মাঠ, শৌচালয় নোংরা থাকাটা কোনও আলোচনার বিষয় হতে পারে না। দূষণ ব্যাপারটা ছিল আমাদের অনেকটা দারিদ্র গা-সওয়া হয়ে যাবার মতন।
দীর্ঘ দিন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ছোটখাটো সভা করতে গিয়ে দেখেছি বিদ্যালয়গুলি কতটা অপরিচ্ছন্ন। শ্রেণিকক্ষে এ দিক ও দিক কাগজ পড়ে আছে, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আবর্জনা, প্রাঙ্গণের এখানে-সেখানে আগাছার ভিড়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম সেই বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ছড়িয়ে থাকত জঞ্জাল, আমাদের তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। বিভাগীয় বাড়ির ভিতরের শৌচালয়গুলি অনেক সময়েই থাকত নোংরা হয়ে, খুব একটা পরিষ্কার দুর্গন্ধমুক্ত কখনওই থাকত না। এ সব পরিষ্কার রাখার জন্য কখনও ছাত্র-আন্দোলন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ফাঁকা জায়গা ছিল অনেক, বিভাগীয় বাড়িগুলির মধ্যেও থাকত ফাঁকা জায়গা। এ জায়গাগুলি হয় ভর্তি থাকত আগাছায় অথবা আমাদের ফেলা বর্জ্যে।
ব্যাপারটা এখনও খুব একটা পাল্টায়নি। কয়েকটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় বা কিছু প্রাইভেট স্কুল ছাড়া অপরিচ্ছন্নতা এখনও তেমনই বহাল। কারণ, পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আমরা হাতেকলমে কখনও শিখিইনি বা আমাদের কেউ শেখানোর চেষ্টা করেনি। ফলে এখনও সচ্ছল শিক্ষিত পরিবারের সন্তানেরা দোকান থেকে চকলেট, আইসক্রিম বা অন্য খাবার কিনে সহজেই প্যাকেটটি রাস্তায় ফেলে চলে যায়, সঙ্গে বাবা-মা থাকলে তাঁরাও তাই করেন। এরা সবাই পরিবেশদূষণ নিয়ে রচনা লেখা থেকে বক্তৃতা সবই ভাল করতে পারে। যখন কোনও লোকাল ট্রেনে যাই দেখি যাত্রীরা বাদামের খোসা, ঠোঙা, মশলার প্যাকেট, ঠান্ডা পানীয়ের প্যাকেট সব নির্দ্বিধায় কামরার মধ্যেই ফেলছেন। এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যে সরকারি বাস টার্মিনাস আছে তার ব্যবহারকারীরা প্রায় সবাই শিক্ষিত ও একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু টার্মিনাস চত্বর যাত্রী ও সেখানে বসে আড্ডাবাজদেরফেলা বর্জ্যে নোংরা হয়ে থাকে। এতে কারও বিরক্তি হতে দেখিনি। আমরা ছোটবেলাথেকেই অভ্যস্ত হয়েছি যেখানে-সেখানে থুতু ফেলতে, নাক ঝাড়তে, গলা থেকে কফ ফেলতে। এই পরিবেশ নোংরা করা ও তা নিয়ে উদাসীন থাকার ঐতিহ্য আমরা বহন করে চলেছি।
ছোট শহরগুলির অবস্থা তো অত্যন্ত খারাপ। সারা শহরটাই আবর্জনা ফেলার জায়গা। সকালবেলায় নগরপালিকা ঝাড়ু দিয়ে কিছু পরিষ্কার করেন বইকি কিন্তু তার পর বেলা বাড়তেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি তাকে নোংরা করতে। কলকাতা শহরে বামপন্থার তিন দশকে জন-শৌচালয় বলে প্রায় কিছুই ছিল না। পুরুষদের প্রস্রাব দৃশ্য ছিল শহরের অন্যতম পরিচিতি। মনে আছে শহরের সবচেয়ে বুদ্ধিজীবীপ্রিয় প্রেক্ষাগৃহ নন্দনে চলছে চিনা চলচ্চিত্র উৎসব। তার প্রবেশের জন্য দীর্ঘ বাম বুদ্ধিজীবীদের সারি এবং তাঁরা অনেকেই এই সারির প্রায় পাশেই ঝোপঝাড়ে দৃশ্যমান হয়েই মূত্রত্যাগ করে বিপ্লবী উদ্যম পাবার জন্য অপেক্ষা করছেন। বামফ্রন্টের অবসানে বর্তমান কলকাতা এখন এই একটি ব্যাপারে অনেক নির্মল।
পরিচ্ছন্নতা কি শেখা যায় বা শেখানো যায়? ২০১৮ সালে মস্কো ফুটবল বিশ্বকাপ ও ২০২২-এর কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখেছে বিশ্ববাসী। খেলা শেষে জাপানি দর্শকরা স্টেডিয়াম পরিষ্কার করছেন। কেন করছেন? কারণ তাঁরা শিশুকাল থেকেই এই শিক্ষা পেয়ে এসেছেন। জাপানে উচ্চশ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা তাদের শৌচালয়ও পরিষ্কার করে। আর এই পরিষ্কারের কাজটা করে সবাই মিলে এক সঙ্গে। কোরিয়াতেও বিদ্যালয়ে এই প্রথা চালু, চিনেও কিছুটা চালু রয়েছে। সুতরাং, তাদের শহর গ্রাম দেশ পরিষ্কার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের বিদ্যালয়ে কোনও দিন এ সব শেখায়নি। আমরা শিখেছি বিদ্যালয় পরিষ্কার রাখা ঝাড়ুদারদের কাজ, আমাদের কাজ কেবলমাত্র লেখাপড়া করা। ভাবতে অবাক লাগে যে, ‘একটি বিদ্যালয়ের মাঠ কেন ছাত্ররাই পরিষ্কার রাখবে না’ এই ভাবনাটা আমাদের কেউ বলেনি। নিজেদের সৃষ্ট বর্জ্য নিজেদের পরিষ্কার করতে হয় এই বোধটি আমাদের হয়নি। সুতরাং আমরা বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে শহর গ্রাম পাড়া ইচ্ছেমতো নোংরা করে যাচ্ছি, বিপ্লব না-হওয়া পর্যন্ত এ চালিয়ে যাওয়ার দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যা আমাদের পকেটেই আছে।
কিন্তু ধরুন হঠাৎ আমরা জাপানি হয়ে গেলাম। ঠিক করলাম, না আমরা আর এ ভাবে শহর নোংরা করব না। তা হলেও ব্যাপারটা বেশ মুশকিল। আপনি ঝালমুড়ি খেতে খেতে চলেছেন, খাওয়া শেষে ঠোঙাটা ফেলবেন কোথায়? ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় আইন পাশ হয় যে, রাস্তায় নোংরা ফেললে জরিমানা হবে পাঁচ হাজার টাকা,আগে যা ছিল পঞ্চাশ টাকা। শোনা যায়, দক্ষিণেশ্বরে নবনির্মিত আকাশপথে যথেচ্ছ পানের পিক দেখে মুখ্যমন্ত্রী এই কড়া আইনের দাওয়াই ঠিক করেন। এ আইনে কারও শাস্তি হয়েছে কি না জানা নেই, তবে সাম্প্রতিক কলকাতা পুরসভার রাস্তা নোংরা করার জরিমানা পাঁচশো টাকা থেকে শুরু। ঠোঙা ফেললেই জরিমানা। কিন্তু ঠোঙা ফেলব কোথায়? ধারেকাছে পথের ধারে কোনও ডাস্টবিন পাওয়া যাবে না।
কিন্তু পুরসভা জরিমানা করবার আগে আমরা কি পুরসভাকে জরিমানা করতে পারি? শহরে আবর্জনা ফেলবার পাত্র বা ডাস্টবিন চালু হবার প্রায় দেড়শো বছর হতে চলল। ১৮৮৪ সালে প্যারিসে প্রথম ডাস্টবিন বা বর্জ্যপাত্র চালু করেন ইউজিন পোবেলে যার জন্য ফরাসি ডাস্টবিনের নাম হয়ে গেল পোবেলে। কিন্তু কলকাতা শহরে ডাস্টবিন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। দু’এক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা থাকে বইকি, কিন্তু তা ঠিক ওই স্থানে পৌঁছলেই ব্যবহারযোগ্য। সুতরাং ঠোঙা রাস্তায় ফেলবার জন্য আপনার জরিমানা হবার আগে শহরের পথে ডাস্টবিন না বসানোর জন্য কলকাতা পুরসভার জরিমানা হওয়া দরকার। কলকাতা পুরসভার সরকারি হিসাবে কলকাতার বড় রাস্তার মোট দৈর্ঘ্য ১৮৫০ কিলোমিটার, অপ্রধান পথের দৈর্ঘ্য ২৭৮৬ কিমি। কিছু অপ্রধান পথকে ধরে অন্তত ২৫০০ কিমি পথে আজই ডাস্টবিন বসান উচিত। প্রতি ১০০ মিটারে একটি ডাস্টবিন ধরে এখনই প্রয়োজন পথের দু’ধারে পঞ্চাশ হাজার ডাস্টবিন। পৃথিবীর সব শহরেই এ রকমই পথে ডাস্টবিন থাকে। খুব সুলভে এর ব্যবস্থা দেখেছি ইয়াঙ্গন (রেঙ্গুন) শহরে। লোহার আংটায় ঝুলছে প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্রতি দিন তাসরিয়ে নতুন ব্যাগ লাগানো হচ্ছে। কলকাতা এটুকুও করে উঠতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য পশ্চিমবঙ্গের সব ছোট বড় অন্যান্য শহরের জন্য। নিজের শহরের প্রয়োজনীয় ডাস্টবিনের হিসাব নিজেরাই করে নিন।
আমরা কি একেবারেই পরিচ্ছন্ন থাকতে পারি না? পারি। তিন দশক আগে কলকাতা যখন বিপ্লব ও আবর্জনায় ভরপুর, তখন থেকেই মাটির নীচের মেট্রো রেলের স্টেশনগুলি ঝাঁ-চকচকে পরিষ্কার। কারণ মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ স্টেশনগুলি সব সময় পরিষ্কার রাখেন আর পরিষ্কার স্থান নোংরা করতে আমরা একটু ইতস্তত করি। অর্থাৎ, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা পুরসভা যদি সত্যিই চান তবে পরিচ্ছন্নতা সম্ভব। আমরা যদি বিদ্যালয়গুলিকে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে পরিষ্কার রাখতে পারি তা হলে বিদ্যালয়ের বাইরের জগৎটাও সে রকম পরিষ্কার হয়ে উঠবে। একটি-দু’টি বিদ্যালয়ে নয়, আমাদের শিক্ষা পরিচালন কর্তৃপক্ষ সব বিদ্যালয়কে নির্দেশ দেবেন ছাত্রছাত্রীদের একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকে বিদ্যালয় পরিষ্কারে নিয়োজিত করতে। আবর্জনা পরিষ্কারের কাজটা যে কোনও ছোট কাজ নয়, সব কাজের মর্যাদার বিষয়টাও শিশুমনে স্থান পাবে। নির্মল বিদ্যালয় আর পথে আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন— এই দুই পদক্ষেপ পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারে বাংলার শহরগুলিকে। শহরের দূষিত মুখে ত্রিফলা আলোর অশালীন প্রসাধন না মাখিয়ে আমরা পথে-পথে এঁকে দিতে পারি ডাস্টবিনের আলপনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy