আর্থিক নিশ্চলতা এবং মূল্যবৃদ্ধি একই সঙ্গে আগে এ ভাবে দাপিয়ে বেড়ায়নি। প্রতীকী ছবি।
সারা পৃথিবীতে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া ও মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়া নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে। তেলের দাম উনিশশো সত্তরের দশকেও বেড়েছিল, মূল্যবৃদ্ধির হারও বেড়েছিল, কিন্তু স্ট্যাগনেশন বা আর্থিক নিশ্চলতা এবং মূল্যবৃদ্ধি একই সঙ্গে এ ভাবে দাপিয়ে বেড়ায়নি।
১৯৩০-এর ভয়ানক মন্দার সময়েই কেন্স ও কালেচ্কির মন্দার অর্থনৈতিক তত্ত্বের জন্ম। যার মূল বক্তব্য হল, মন্দার সময় জিনিসের দাম কমিয়ে জিনিস বিক্রি করা যায় না। কারণ, মন্দার সময়ে চাহিদার স্তর, লোকের হাতে খরচের টাকা, ব্যবসায়ীর বিনিয়োগ প্রবণতা, সবই তলানিতে ঠেকে। তাই, মন্দা দূর করার নিদান হল, সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো। বিগত প্রায় একশো বছর ধরে এই তত্ত্ব কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই তত্ত্বে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তেমন আলোচনা নেই— কারণ, মন্দা মানেই তো মূল্যহ্রাসের অবস্থা।
ক্রমে ক্রমে নতুন গবেষণায়, বিশেষত এ ডব্লিউ ফিলিপস নামে এক অর্থনীতিবিদের কাজের সূত্রে দেখা গেল যে, বিত্তশালী জগতে চাহিদা বৃদ্ধির নীতি মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। বেশি তাড়াতাড়ি বা জোর করে বৃদ্ধি ঘটাতে গেলে, কর্মসংস্থান বাড়াতে গেলেই মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাচ্ছে। সহজ ভাবে বুঝতে গেলে বলা যায় যে, চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে জোগান বৃদ্ধি তাল রাখতে পারছে না। ফলে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়ছে। তখন সে দেশগুলো আর মহামন্দার অবস্থায় নেই। গুদামজাত বাড়তি সব পণ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। এই সব বিশ্লেষণ করার জন্য তৈরি হল নিয়োক্লাসিক্যাল অর্থনীতির তত্ত্ব এবং নতুন কেন্সীয় অর্থনীতির তত্ত্ব। কিন্তু দুটোই আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত। বৃদ্ধি হলে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়বে না এক থাকবে, সে সব নিয়ে আলোচনা। এ বিষয়ে জাপানের আর্থিক অবস্থার আখ্যান বরং বেশি প্রাসঙ্গিক— দীর্ঘ কাল আয়বৃদ্ধি এবং মূল্যবৃদ্ধি দুইয়েরই মন্দাবস্থার কাহিনি।
কোনও সর্বজনগ্রাহ্য বহুচর্চিত সামাজিক অর্থনীতির তেমন তত্ত্ব নেই, যা এ যাবৎ জমে ওঠা তত্ত্বের আধারে নতুন করে বলেছে যে, কী ভাবে মন্দার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়তে পারে। এটি যে-হেতু পশ্চিমি অর্থব্যবস্থাগুলিতে ঘটেনি, তাই মূল পাঠ্যপুস্তকেও এ বিষয়ে খুব কিছু লেখা হয়নি। আজ যখন আশঙ্কার বাণী পশ্চিমে আলোড়ন তুলছে, কোনও সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব নিয়ে কেউ কিছুই বলছেন না বা বলতে পারছেন না। এটা এমনই একটা অঘটন যে, তাকে সামলাতে অর্থনীতির নতুন প্রযুক্তি প্রয়োজন।
মূল্যবৃদ্ধির হার যে কোনও কারণে হঠাৎ বেড়ে গেলে বা খানিকটা লাগামছাড়া হলেই সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলো সুদের হার বাড়িয়ে ঋণ করে খরচের প্রবণতায় রাশ টানতে চায়, কারণ সরকারের কাছে সরাসরি খরচা কমানো দুষ্কর। এ বার সেই নীতিতে অবাঞ্ছিত বৃদ্ধির হার খানিকটা কমল, তাতে দাম না কমে বাড়তে থাকায় মাথায় হাত! এই মুহূর্তে আমেরিকার ফেডারাল রিজ়ার্ভ ভাবছে, নগদের জোগানে রাশ টানলে অর্থনীতি কোন দিকে যাবে।
চাহিদা কমালে কোনও ভাবে যদি জোগানের উপর চাপ পড়ে, তা হলে এটা হতেই পারে। জোগানের নিম্নগতি যে মূল্যবৃদ্ধিকে উৎসাহ দেয় সেটা উপেক্ষা করা যায় না। আর এত দিনের চেনা-জানা অর্থনীতির শিক্ষা জোগানে ধাক্কা লাগার ব্যাপারে তেমন কিছু বলে না। তেলের দামের সমস্যা ছাড়াই বিত্তশালী বিশ্বে শ্রম এবং শ্রমিকের, অর্থাৎ কাজকর্ম করার লোকের অভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরেই। আশ্চর্য ভাবে কোভিডের পর এই ঘাটতি বাড়ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশাল বিশাল দোকানে একটি দু’টির বেশি কর্মী দেখা যায় না। সম্প্রতি শুনলাম, জার্মানিতে একটি জুতোর সোল পেতে নাকি এক মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কমবয়সি কর্মীর বিপুল অভাব এখন ভয়ঙ্কর এক বাস্তব অবস্থা।
বাজারে জোগান স্থির থাকলে চাহিদা কমালে দাম কমবেই। কিন্তু চাহিদা কমানোর আগে থেকেই বা এখন কোনও কারণে ক্রমাগত জোগান কমতে থাকলে দাম বেড়ে যেতেও পারে। চাহিদা জোগানের এই যুগলবন্দি বোঝানোর মতো জ্ঞানচক্ষু তেমন উন্মীলিত হয়নি। আর তাই এই প্রচারমুখী উন্মাদনার যুগেও কেউ কোনও তত্ত্বের উল্লেখ করে ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে পারছেন না। কেউ ভাবছেন এই মন্দার মধ্যে যদি আবার মন্দা বাড়ে, কেউ ভাবছেন যদি মূল্যবৃদ্ধির হার না কমে আর আয়বৃদ্ধিও কমে যায়, তা হলে এ কূল ও কূল দুই-ই যাবে।
এক কালে রুগ্ণ উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের নীতি ছিল ঋণের বদলে সরকারের অতিরিক্ত খরচ কমানোর দাওয়াই। সেই নীতি অনেক জায়গাতেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কারণ, মন্দার সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়েছিল। আজ প্রথম বিশ্ব সেই সমস্যার মুখে পড়েছে।
কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে নিম্নবিত্ত দেশগুলোর অর্থনীতি ধনী দেশগুলোর চেয়ে দ্রুত হারে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ভারতে এই মুহূর্তে স্ট্যাগফ্লেশন-এর সম্ভাবনা কম, কারণ এ দেশে কর্মক্ষম লোকের জোগানে অভাব নেই। তা ছাড়া, অসংগঠিত ক্ষেত্র-প্রধান অর্থব্যবস্থা হওয়ায় এ দেশে মজুরিবৃদ্ধির চাপও কম। যদি প্রকৃতিমাতার আশীর্বাদ এ দেশের উপর পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে, তা হলে খাবার দাবারের দাম অতটা বাড়বে না। যদিও তেলের দাম বাড়ায় মূল্যবৃদ্ধির হার খানিক বাড়বে।
কিন্তু শ্রমের জোগানের যে করুণ অবস্থা ইউরোপ এবং আমেরিকাকে গ্রাস করছে, তাতে শুধু চাহিদা ম্যানেজ করে কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না। মূল্যবৃদ্ধি রুখতে যদি চাহিদা কমাতে হয়, তা হলে আর্থিক বৃদ্ধি তেমন একটা না কমলেও, সেই সময়ে জোগান সঙ্কোচন মূল্যবৃদ্ধিকে কমাতেই দেবে না। তাই তেলের দামবৃদ্ধি এবং শ্রমের জোগান হ্রাস, দুটোই এখন মাথাব্যথার কারণ। ব্রেক্সিটের পর ইউরোপ হয়ে পণ্যসামগ্রী এবং মানুষ চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে। ইংল্যান্ডের অনেক দোকানে জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় আয়বৃদ্ধি ক্রমাগত নিম্নমুখী আর ঐতিহাসিক ভাবে মূল্যবৃদ্ধি দুই-ই সামলাতে হচ্ছে। চাহিদা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে গেলে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়বে। আর এখন যদি চাহিদা কমিয়ে দেওয়া হয়, তা হলেও মূল্যবৃদ্ধি বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, উন্নত বিশ্বে এখন শাঁখের করাতের মতো অবস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy