৮ মে কোভিডে চিকিৎসক স্মরজিৎ জানার (ছবিতে) মৃত্যু ঘটেছে। এত আতঙ্ক আর মৃত্যুর মাঝখানে, যেন খানিক অলক্ষ্যেই। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্য তাঁকে স্মরণে রাখা জরুরি। আশি-নব্বইয়ের দশকে বিশ্বকে আতঙ্কিত করেছিল অন্য অতিমারি— এডস। সংক্রমণ মূলত ঘটছিল যৌনরস আর রক্তের মাধ্যমে। যৌনকর্মীদের সংক্রমণের সম্ভাব্য শিকার ও বাহক ধরা হচ্ছিল। কলকাতায় বিশ্ব এডস নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম হিসেবে তৈরি হয় ‘সোনাগাছি প্রজেক্ট’, কারণ সোনাগাছিকে এশিয়ার বৃহত্তম যৌনবৃত্তির কেন্দ্র ধরা হয়। কার্যক্রমের দায়িত্ব পান স্মরজিৎ জানা ও তাঁর সহযোগীরা। ‘সোনাগাছি প্রজেক্ট’-এর সাফল্য, ‘সোনাগাছি মডেল’-এর বিশ্ব জুড়ে এডস প্রতিরোধে পথ দেখানোর মূলে ডাক্তার জানার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কেবল চিকিৎসাকামী বিপন্ন গোষ্ঠী হিসেবে না দেখে, যৌনকর্মীদের প্রকল্পটির অংশীদার করে নেওয়া হয়েছিল। স্মরজিৎবাবুরা বুঝেছিলেন, রোগকে ঠেকাতে হলে যৌনকর্মীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। ছড়িয়েছিল স্লোগান— ‘নো কন্ডোম, নো সেক্স।’ যৌনপেশায় জড়িত অসংখ্য মেয়ে, পুরুষ আর অনির্দিষ্ট লিঙ্গের মানুষদের আগে ‘মানুষ’ হিসেবেই কেউ ধরেননি। এঁদের ক্ষমতায়ন না হলে ‘কন্ডোম ছাড়া যৌন সম্পর্ক নয়’ কথাটা বলার জোর আসত না। প্রজেক্ট সেই কাজই শুরু করে। সেই পথেই তৈরি হয় যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংগঠন ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’।
এডসকে নৈতিক ব্যাধি হিসেবে না দেখে পেশাগত রোগ হিসেবে দেখা হল। পাথর খাদানের কাজে যেমন সিলিকোসিস রোগ বা ম্যানহোল পরিষ্কারে কার্বন মনোক্সাইডে মৃত্যুর ভয় বেশি, তেমনই যৌনকাজেও যৌনরোগের ভয়। পাপ-পুণ্যের প্রশ্ন নেই। বাংলা ভাষায় জরুরি বদলও এল। অবমাননাকর সম্বোধন, পরিচয়ের বদলে পেশাভিত্তিক ‘যৌনকর্মী’ শব্দটা চালু হল। দুর্বার স্লোগান তুলল— ‘গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই’। ফলে যৌনকর্মীদের নিজেদের কাছেও আত্মপরিচয় বদলাল। যৌনকর্মীরা পরিবার পালন করে, হাড়ভাঙা খেটেও ঘৃণা আর অনুকম্পা সহ্য করে নিজেদের অস্তিত্বকে পাপ মনে করে, অলীক উদ্ধারের জন্য উতল অসহায় হয়ে রইলেন না। শ্রমের আর বাঁচার অধিকার দাবি করলেন।
যৌনকর্মীদের আঙিনার বাইরেও সামাজিক অসাম্যের কাঠামোকে প্রশ্ন করার জন্য দুর্বারের আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র, ধর্ম, শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে চালু থাকে সমাজ। তার মধ্যে একেবারে প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান পরিবার। নারী-পুরুষ উভয়ের, মূলত মেয়েদের যৌনতার উপর লাগাম পরিবারের ভিত্তি। কারণ, পরিবার হল পূর্ব‘পুরুষ’ থেকে উত্তর‘পুরুষে’ সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রতিষ্ঠান, তাই তার অস্তিত্ব এবং কার্যকারিতার শর্ত মেয়েদের যৌনতায় নিয়ন্ত্রণ জারি। স্ত্রী বহুগামী হলে উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের প্রশ্ন জটিল হয়। মেয়েদের যৌনতাকে বিয়ের মধ্যে আটকে রাখার পিতৃতান্ত্রিক দায়ের মূল শিকড়টি থেকেই গজিয়ে ওঠে মেয়েদের নানা স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ। মেয়েরা মূলত উত্তরাধিকারী নির্মাণের কারখানায় অন্যায্য মূল্যে গার্হস্থশ্রম জোগানের দাসশ্রমিক হয়ে ওঠেন, যৌনতাকে সব রকমের আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাধ্যতামূলক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সামাজিক পাহারায় আদায়ও করা হয়। মেয়েদের উপর নানা শোষণের কথা নারী আন্দোলন বললেও, যৌনদাসত্বের মূল ভূমিকাটি ততটা আলোচিত নয়। মেয়েদের যৌনসম্পর্কে ‘না বলার অধিকার’ নিয়ে আন্দোলন ভাল। কিন্তু তাতেও পিতৃতন্ত্রের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়, কারণ যৌনতায় ‘না’ বলা হচ্ছে। দুর্বারের আন্দোলন মেয়েদের যৌনতায় ‘হ্যাঁ বলার অধিকার’-এর আন্দোলন। তা সমাজের গোড়া ধরে টান মারে।
তবে কি বলা হচ্ছে, পরিবার ধ্বংস হোক? উত্তর অত সরল নয়। মুক্তির উপায় নিয়ে শেষ কথা এখনও কেউ বলেননি। চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া অনেক ধারণাই ঘেঁটে যাচ্ছে। পরিবারের বিকল্প এখনও খুঁজে পাইনি। তার মানে এই নয়, নারী-পুরুষের যৌন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, মেয়েদের অধিকার হননের ক্ষেত্রে পরিবারের দমননীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। চার্চের আগুনে পুড়ে মরা ‘অবিশ্বাসী’রা যে প্রশ্ন করেছিলেন, টেলিস্কোপে স্বর্গ দেখতে না পাওয়া যে সঙ্কট তৈরি করেছিল, নানা ‘অচলায়তন’কে ভাঙতেই সেই খোঁজ চলছে, চলবে।
সৎ সামাজিক সুবিচারকামী মানুষরা বোধ হয় স্বীকার করবেন যে, নারীমুক্তির প্রশ্নকে বাদ দিয়ে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের অধিকারকে দমিত রেখে শ্রেণিভিত্তিক সাম্য হয় না। পিতৃতন্ত্র এক ধরনের ‘শ্রেণিবৈষম্য’ তৈরি করে, যা দিয়ে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়। পরিবারই পিতৃতন্ত্রের ঢাল। তাই বধূর শত্রু হয়ে ওঠেন বারবধূ।
যৌনকর্মের অধিকারকে শ্রমিকের অধিকার বলে স্বীকৃতি দাবি করে মৌচাকে ঢিল মেরেছিল যৌনকর্মী আন্দোলন। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভূমিকাকে কেবল যৌনকর্মীদেরই নয়, বৃহত্তর অর্থে নারীর, শ্রমিকের ও সমাজমুক্তির অধিকার-বিরোধী বলে চিহ্নিত করেছিল। গান গেয়েছিল: “রাস্তার মেয়েরাই পথ দেখাচ্ছে/ সূর্যের দিকে আজ দু’হাত বাড়াচ্ছে।” দুর্বার আমাদের সবাইকে মিছিলে ডেকেছিল। আমরা যদি যেতে না পারি তার কারণ আমাদের সব রাজনৈতিক বিশ্বাস আর অভ্যাসের মজ্জায় ঢুকে থাকা পিতৃতন্ত্র। মিছিল চলবে, সেই মিছিলে হাঁটবেন স্মরজিৎ জানা।
ঋণ: নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy