Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sports

ক্রীড়া সাহিত্যের শূন্য মাঠ

শরীরচর্চার ইতিবাচকতায় ঘেরা ছিল আমাদের পূর্বজদের তৈরি, মৌলিক এই ক্রীড়াগুলি। ব্রিটিশ প্রভু শংসাপত্র দিল না বলে আমরা তাদের দেখানো পথে উনিশ শতকে শ্বেতাঙ্গদের আমদানি করা নানা খেলায় নাম লেখালাম।

sports.

—ফাইল চিত্র।

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:২৩
Share: Save:

কোন খেলায় যোগ দেয়নি বাঙালি! অথচ তাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে খুব মনোযোগে লেখালিখি হয়েছে কতটুকু? বাংলা ক্রীড়া সাহিত্য ক্রিকেট-ফুটবলে মোড়া, সঙ্গে দু’-দশটা ছিটকে আসা কবাডি, সাঁতার, দাবা, বক্সিং। স্কুল-কলেজে শারীরশিক্ষার শিক্ষক যেমন ‘পি টি টিচার’, বাংলায় খেলা নিয়ে কথাসাহিত্য যেন শুধু শিশু-কিশোরেরই মন পেয়ে সন্তুষ্ট। দরিদ্র পরিবারের জেদি সন্তান বহু বাধাবিপত্তি টপকে জয়মুকুট পরল, এই চেনা ছকের বাইরে কেউ কেউ খেলার জগতের নানা অবৈধ কার্যকলাপকে এনেছেন হয়তো, সে-ও গোয়েন্দা-রহস্য-খুন-কিডন্যাপের বাজারি কাঠামোকে মান্যতা দিয়েই। তবে আমাদের লেখকেরা খেলার মাঠে গোয়েন্দাকে আনলেও সেই ‘খেলা’ শেষ পর্যন্ত ফুটবল বা ক্রিকেট; অন্য খেলায় আম বাঙালির আগ্রহ নেই, তাই সেখানে রহস্য‌ও নেই।

অলিম্পিক্সে যত ইভেন্ট আছে তার পর্যাপ্ত বিভাগে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যোগ দেন, তাঁদের অনেকে বাঙালি ও বাংলার, তাঁদের নামটুকুও জানা হয়ে ওঠে না, মেডেল-সহ ছবি দেখিনি বলে। আর বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব যে খেলাধুলা, তাদের অস্তিত্ব কি এই নতুন শতাব্দীর সিকি দশকের মধ্যে লুপ্তপ্রায় নয়? দড়িখেলা, জোড়-বিজোড়, নৌকাবাইচ, ব‌ৌছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, গোলাপ-টগর, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি, এক্কা দোক্কা, ব‌ৌরানি, কড়িখেলা, ঘুঁটি খেলা, চু-কিত-কিত, কানামাছি, ঘুড়ি ওড়ানো, কলাগাছ লাফানো, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, এলাটিং বেলাটিং, বাঘবন্দি, রুমাল চুরি, লাঠিখেলা, লুকোচুরি, সাতখোলা, হাডুডু, কুমির-ডাঙা, লোফালুফি, ঝাল-ঝাপটা, চোর ধরাধরি, ইকির-মিকির, পিট্টু, লাল-লাঠি, গাদি, খো খো, ডান্ডা-গুলি, ব্যাঙ ডিঙানি, কাজলপাতি, সুচ-চলার মতো আড়ম্বরহীন প্রায় নিখরচার খেলাগুলিতে মুখরিত থাকত মাঠঘাট, উঠোন। গ্রাম ও মফস্‌সলের বিকেলে ছোটদের কোলাহলহীন ফাঁকা মাঠগুলোয় আর দেখা যায় না এই খেলাদের। যাদের নামই বিলুপ্ত, তাদের নিয়ে আবার সাহিত্য?

শরীরচর্চার ইতিবাচকতায় ঘেরা ছিল আমাদের পূর্বজদের তৈরি, মৌলিক এই ক্রীড়াগুলি। ব্রিটিশ প্রভু শংসাপত্র দিল না বলে আমরা তাদের দেখানো পথে উনিশ শতকে শ্বেতাঙ্গদের আমদানি করা নানা খেলায় নাম লেখালাম। জিমন্যাস্টিক্স, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদিতে বাঙালির পারদর্শিতা পরবর্তী কালে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে, এ আমাদের ইতিহাসের ললাটলিখন। সেই পর্ব থেকে বিকশিত হতে শুরু করেছিল বাংলা ক্রীড়াসাহিত্য। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এর হাতেখড়ি, উনিশ শতক শেষে কথাসাহিত্যে তার প্রবেশ। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত শিবনাথ শাস্ত্রীর উপন্যাস নয়নতারা-র নায়ক হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এক জন খেলোয়াড়। এর আগে-পিছে সংবাদপত্রের খবর ছাড়া খেলা বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধের মূল লক্ষ্য ছোট ছেলেমেয়েরা, মাধ্যম‌ও শিশুতোষ পত্রপত্রিকা। ১৯১১-য় মোহনবাগানের শিল্ড জয় বহু লেখকের কলমের মুখ খেলার দিকে ঘোরাতে বাধ্য করল। ১৯১৩ সালে ভারতবর্ষ পত্রিকায় নগেন্দ্রনাথ গুপ্তর লেখা ‘ফুটবল ফাইন্যাল’ (প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা) নিবন্ধে দর্শকের উচ্ছ্বাসের জীবন্ত বর্ণনায় কথাসাহিত্যের স্বাদ। এমন উদাহরণ মূলত ওই দশক থেকে ধারাবাহিক ভাবে আসতে শুরু করে। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আজ পর্যন্ত প্রকাশিত ক্রীড়া সংক্রান্ত রচনাবলি ও গ্রন্থাবলিকে বিষয়ানুসারে সাজাতে গেলে তার তালিকা হবে এমন: সংবাদপত্র প্রতিবেদন; ক্রীড়া শিক্ষার ব‌ই; ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের জীবনী, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা; বিভিন্ন ক্রীড়া অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, বিবরণী; প্রবন্ধ, নিবন্ধ; সাক্ষাৎকার-গ্রন্থ; কথাসাহিত্য; নাটক ও চলচ্চিত্র; ছড়া, কবিতা, গান; কমিকস ও কার্টুন; কুইজ় ও প্রশ্নোত্তর গোছের ব‌ই; ক্রীড়া-গবেষণাগ্রন্থ; অনুবাদগ্রন্থ ইত্যাদি।

এগুলি একত্র করলে দেখা যাবে সিংহভাগ দখল করে আছে ক্রিকেট ও ফুটবল। তা দোষের নয়। বরং সেই চর্চাতেও এত অযত্ন আর মানুষের আবেগ-ভক্তিকে টাকায় লুটে নেওয়ার চেষ্টা, দেখলে খারাপ লাগে। যে খেলোয়াড় যখন বাঙালির নয়নমণি হয়ে বিরাজমান, তাঁকে নিয়ে এক গুচ্ছ ব‌ই ব‌ইবাজারে ছয়লাপ। প্রচ্ছদ ও ব‌ইয়ের ভিতরে কিছু ছবি, সংগৃহীত তথ্য ও কল্পনার মিশেলে একটা কিছু দাঁড় করিয়ে দেওয়া। লেখক বুঝে উপরি পাওনা বিদেশ সফরে এক সঙ্গে ডিনারের গল্প, খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত জীবনের মুখরোচক কাহিনি। খেলা নিয়ে ‘সিরিয়াস’ পত্রিকা কই? দু’-এক জন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ কয়েকটি ট্যাবলয়েড গোছের পত্রিকা সম্পাদনা করেন তবে প্রকাশ অনিয়মিত, প্রসার শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে আটকে। সত্তর-আশির দশকে খেলা নিয়ে একাধিক পত্রিকা বেরোত, খেলা-পাগল পাঠক তাদের আদরে বরণ করেছিলেন। সেখানে মুদ্রিত উৎকৃষ্ট লেখাগুলো গ্রন্থবদ্ধ হল না, হারিয়ে গেল বাংলা ক্রীড়া সাহিত্যের অজস্র মণিমাণিক্য। মাত্র কয়েক জনের লেখা আজ‌ও মুদ্রিত অক্ষরে পাওয়া যায়, কিন্তু বাকিরা? প্রান্তিক বাংলার নানা খেলা, প্রতিভাবান খেলোয়াড় ও প্রতিযোগিতার সংবাদ সেই পত্রিকাগুলিতে লিখেছেন অনেকেই, সেগুলি সঙ্কলিত হলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার ক্রীড়া-ইতিহাসের ছবিটি অনুপুঙ্খ হতে পারত।

বাংলা ভাষার লেখক কি ফের কলম হাতে তুলে নিতে পারেন না এমন স্বর্ণাক্ষর রচনার জন্য: “পাঠক কি বুঝতে পেরেছেন ওটা লাল বল নয়, লাল আপেল? ভগবানের প্রিয় ধনুর্ধর সন্তান আদমের অধঃপতনের জন্য শয়তান ও ইভের যৌথ চক্রান্ত? পতন হয়েছিল আদমের। অনেক চেষ্টায় সাধনায় আবার স্বর্গোদ্যানে ওঠা গেছে।... শক্ত পাঁজরে দাঁড়িয়ে থাকেন আদম। বিজয় হাজারে নট আউট করে ঘরে ফিরলেন দ্বিতীয় ইনিংসের খেলা শেষে। প্রথম ইনিংসে শূন্য করেছিলেন। ক্রিকেট-ইতিহাস যাই বলুক, ইডেন গার্ডেন নামকরণের ঐ আমার ব্যাখ্যা।” (শঙ্করীপ্রসাদ বসু)। আমাদের অধুনা-লিখিয়েরা কি আয়ত্ত করতে পারলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের এই বোধ: “এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না যে মোহনবাগানের খেলার মাঠেই বাঙলা দেশের জাতীয়তাবোধ পরিপুষ্ট হয়েছিল। যে ইংরেজবিদ্বেষ মনে-মনে ধূমায়িত ছিল মোহনবাগান তাতে বাতাস দিয়ে বিশুদ্ধ আগুনের সুস্পষ্টতা এনে দিয়েছে। অত্যাচারিতের যে অসহায়তা থেকে টেররিজম জন্ম নেয় হয়তো তার প্রথম অঙ্কুর মাথা তুলেছিল এই খেলার মাঠে। তখনো খেলার মাঠে সাম্প্রদায়িকতা ঢোকেনি, মোহনবাগান তখন হিন্দু-মুসলমানের সমান মোহনবাগান— তার মধ্যে নেবুবাগান কলাবাগান ছিল না।”

বছরভর এত খেলা, তবু টিকিটের কালোবাজারি, বিদেশি খেলোয়াড়দের ময়দান ভরানো, রাজনৈতিক ক্ষমতাবানের টাকা লুটপাট, মেয়েদের ক্রীড়াক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন, কবাডি-বক্সিং-অ্যাথলেটিক্সে বাংলার নামের ক্রমবিলুপ্তি, ফুটবলের জাতীয় দলে বা সাঁতার ব্যাডমিন্টন দাবায় বাঙালির আকাল। এই নেতিবাচকতার প্রতিচ্ছবি বাংলা ক্রীড়া সাহিত্যেও। লেখার মাঠটাও ক্রমেই যেন ‘খেপ খেলোয়াড়’দের চারণভূমি হয়ে উঠছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Sports Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy