আড়াই হাজার বছর আগে গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ছড়ানো সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন অশোক। ব্যক্তিগত ভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও অশোকের শিলালেখতে বার বারই ফুটে উঠেছে ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণদের প্রতি সমদর্শিতার কথা। ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ শ্রমণ, ধর্মীয় দর্শনের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি প্রান্তে অবস্থান। রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিপরিসরে বৌদ্ধ অশোক কিন্তু ভিন্নমতের অনুসারীদের প্রতি বৈর দেখাননি। তাঁর প্রায় দু’হাজার বছর আকবরও বৈরের পথে হাঁটেননি। নিজে মুসলমান হয়েও তিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের দূরে ঠেলে দেননি। বরং বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিতর্কের আহ্বানও করেছেন। রাষ্ট্রকে সব ধর্ম থেকে সমান দূরত্বে রাখার পন্থাও ছিল তাঁর।
ভারতের ইতিহাসে কখনও কোনও একটা মত গোটা রাজত্বের উপরে চেপে বসেনি। ভিন্ন মতের মধ্যে বিতর্কের পরিসর তৈরি করেই ক্রমাগত সচল থেকেছে দেশ। প্রাচীন সময় থেকে চলে আসা এই বিরুদ্ধ স্বরের প্রাসঙ্গিকতা উঠে এসেছে রোমিলা থাপরের ভয়েসেস অব ডিসেন্ট বইয়েও। উপমহাদেশের মানুষ কী ভাবে বিরোধিতা করেছে এবং কী ভাবে পরস্পরবিরোধিতা থেকেও ঐকমত্যে উত্তীর্ণ হয়েছে, তা দেখিয়েছেন রোমিলা।
তা হলে ভারতে কি বহু আগে থেকেই গণতন্ত্র ছিল? মোটেও না। আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা অনেক পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্য থেকে এসেছে। কিন্তু গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন নয়, বরং গণতন্ত্রের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সংলাপ। বিতর্ক, ভিন্ন মতের দ্বন্দ্ব সেই সংলাপকেই জারি রাখে। সেই পরিসর কিন্তু ভারতের অতীতে বার বার এসেছে। শুধু রাষ্ট্রীয় আচারেই নয়, সামাজিক বা ধর্মীয় পরিসরেও ভিন্ন মতের স্বীকৃতি ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে, যা স্বাধীন ভারতের গণতান্ত্রিক রীতিতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তাই ডান, বাম, হিন্দুত্ববাদী, নাস্তিক— সকলেই সংসদীয় ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছিলেন। জওহরলাল নেহরুর আমলে সংসদে হওয়া একের পর এক বিতর্ক, শাসককে বিঁধে বিরোধীদের চোখা চোখা বাক্যবাণ আজও দেশের সংসদীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল রত্নভান্ডারের অংশ।
উপমহাদেশে বিরুদ্ধ মতের স্বীকৃতি এবং তর্কের পরিসরের কথা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন অমর্ত্য সেন। তাঁর দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান বইয়ে বলেছেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম, পুরাণ, মহাকাব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই গুরুত্বকে মুসলিম শাসকেরাও অগ্রাহ্য করেননি। আবার একই সঙ্গে সংশয়বাদী ভাবনাও ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত আছে। তাই পুরাণ এবং মহাকাব্যের পাশাপাশি সংশয়বাদী দর্শনকে বাদ দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে বুঝতে চাওয়া ‘বোকামি’।
অধ্যাপক সেনের সূত্র ধরেই এক বার মহাকাব্যে চোখ ফেরানো যাক। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে যুদ্ধ শুরুর আগে অর্জুন বেঁকে বসলেন। বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞাতিভাইদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে নারাজ তিনি। সেই যুদ্ধ শুরুর আগেই পার্থ এবং তাঁর সারথির ‘বাগ্যুদ্ধ’ হয়ে গেল। সেই বিতর্কই সঙ্কলিত হল ‘গীতা’ হিসেবে। অথবা বৌদ্ধ ধর্মের কথাই ধরা যাক। খোদ গৌতম বুদ্ধই বার বার বিতর্কের কথা বলেছেন, দ্বন্দ্ব-বিতর্কের মাধ্যমেই নতুন পথের সন্ধান করতে বলেছেন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পরে তাই সঙ্গিতীর মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম তার নতুন ভাবনা, নতুন রূপকে খুঁজে নিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশই বৈদিক দর্শনের পাশাপাশি নাস্তিক্যবাদী দর্শনকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সংখ্যালঘু হয়েও মোগল আমলেও চার্বাক দর্শন বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বরং আকবরের আয়োজিত বিতর্কসভায় চার্বাক দার্শনিকদের উপস্থিতির কথাও জানা যায়।
প্রতিবেশী দুই দেশে মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখে ভারতীয় উপমহাদেশের চরিত্র সন্ধান আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনে রাজনৈতিক ভাবে দু’টি ভিন্ন (১৯৭১ সালের পর তিনটি) রাষ্ট্র তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু সংস্কৃতিগত ভাবে ভিন্নতা তৈরি হল কেন? তার উত্তর খুঁজতে গিয়েই যে কথা সামনে আসে, তা হল, পাকিস্তান গঠন হয়েছিল মুসলিমদের রাষ্ট্র হিসেবে। অর্থাৎ যে ভারতীয় উপমহাদেশ হাজার-হাজার বছর ধরে বিবিধ ধর্ম, সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র এবং আবাসস্থল হয়ে ছিল, তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করে তৈরি হয়েছিল পাকিস্তান। পরবর্তী কালে বাংলাদেশও পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুবাদের উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পাকিস্তান গঠনের সময় রাষ্ট্র নিজের ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণ করে ফেলায় ভিন্ন মত এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের পরিসরও উবে গিয়েছিল। রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে অনবরত সংলাপের পরিসর না থাকায় গণতান্ত্রিক কাঠামো সে দেশে কার্যত পাটকাঠির প্রাসাদ হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার নিয়ে তৈরি হওয়া বাংলাদেশও কিন্তু গণতন্ত্রের সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি।
বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে আছে ভারত। এ দেশেও গণতান্ত্রিক পরিসরকে খর্ব করার চেষ্টা, সংখ্যাগুরুবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। ভারত ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা দেখেছে। চরম সঙ্কটেও সে কিন্তু প্রত্যুত্তর দিতে ভরসা রেখেছে গণতন্ত্রে। ১৯৭৭ সালে দেশ জুড়ে কংগ্রেসের পরাজয়ই ছিল দেশবাসীর উত্তর। বর্তমান ভারতেও যে হিন্দুত্ববাদী প্রচার চলছে, ‘এক দেশ, এক শাসন’-এর ঢক্কানিনাদ শোনা যাচ্ছে তা রুখতেও নাগরিক স্বর সরব। সেই স্বরকে রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়নি, এমন বলা যায় না। তবে তার খেসারত লোকসভা ভোটে বহু রাজ্যেই দিতে হয়েছে দেশের শাসক দলকে।
এই আকালে ভারতের ধমনীতে বয়ে চলা এই বিরুদ্ধ মতের স্বীকৃতিটুকু, শাসকের বিরুদ্ধ ভাষ্যের উপস্থিতিই আমাদের আশার আলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy