অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কলকাতা-সহ রাজ্যের কয়েকটি জেলায় যে ভাবে একের পর এক অনুপ্রবেশকারী এবং বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের সন্ধান মিলেছে, তা গোটা দেশের পক্ষেই যথেষ্ট উদ্বেগের। আর, পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসাবে আমরা অবশ্যই সেই উৎকণ্ঠার অন্যতম বড় শরিক। কারণ, ওই ধরনের লোকজন ‘বাসিন্দা’ হয়ে থেকে যেতে বা যাতায়াতের রাস্তা হিসাবে কার্যত ‘বেছে’ নিতে চাইছে এই রাজ্যকে।
এতে নানা ভাবে প্রশ্ন উঠছে এখানকার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ‘গাফিলতি’ নিয়ে। উড়িয়ে দেওয়া যায় না অবৈধ আর্থিক লেনদেনের সন্দেহও। যাদের হাত দিয়ে এ সব হয়ে থাকে, তারা কোনও না কোনও স্তরে ক্ষমতাধর অথবা ক্ষমতার ছায়ায় পুষ্ট হবে, এ তো সহজ বুদ্ধি। অন্যথায় এ সব সম্ভব হবে কী করে!
এখন পর্যন্ত যাদের ধরা গিয়েছে, তাদের প্রায় সকলেরই মূল শিকড় বাংলাদেশে। কিন্তু তারা সবাই যে সে-দেশ থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রাণ ‘বাঁচাতে’ এখানে ঢুকে পড়েছে, এমন নয়। তদন্তে জানা যাচ্ছে, ভুয়ো নথিপত্র বানিয়ে, ভোটার কার্ডে নাম তুলে অনেকে কম করেও দু’চার বছর পশ্চিমবঙ্গের ‘বাসিন্দা’ হয়ে রয়েছে। যাদের একাংশের ‘দায়িত্ব’ ছিল (বা, আছে) বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের হয়ে এখানে ‘স্লিপার সেল’ গড়ে তোলা।
আমরা জানি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অশান্তি এখন কার্যত হিন্দু-নির্যাতনে কেন্দ্রীভূত। নির্যাতিতরা বাঙালি, তাই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবেই এপার বাংলায় বেশি। আর, তাকে ঘিরে এখানকার ঘরোয়া রাজনীতিতে হিন্দুত্বের চাপানউতোর আটকানোও কঠিন। যদিও অন্য দেশের ব্যাপারে কখন কী করা হবে, সেটা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু, সে সবের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের ‘এজেন্ট’দের এখানে ঢুকে ‘ভোটার’ হয়ে কোথাও মাদ্রাসা খুলে, কোথাও ব্যবসা ফেঁদে বসা তুলনীয় হতে পারে না। আরও শঙ্কার হল, ওরা যে পশ্চিমবঙ্গে বসত করছে, সেটা প্রকাশ্যে এল ভিন রাজ্যের পুলিশ তাদের সন্ধানে তৎপর হয়ে এখানে আসার পরে। অর্থাৎ, আমার বাড়িতে কে রয়েছে, সেটা জানতে হচ্ছে অন্য পাড়া থেকে! এই অবস্থা আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট ৪০৯৬ কিলোমিটার সীমান্তরেখার মধ্যে ২২১৭ কিলোমিটারই পশ্চিমবঙ্গের। বিবিধ বাস্তব কারণে সীমান্ত-পাহারায় বহু ফাঁকফোঁকর আছে। প্রধানত সে সব ফাঁক বা ফাঁকির ‘সুযোগ’-এ চিরকাল পাচার হয়— সে গরুই হোক, কিংবা মানুষ। এ ক্ষেত্রে ভারতের দিকে পাহারায় থাকা বিএসএফ-কে তার প্রাথমিক দায় নিতেই হবে। সেটা যে রাজ্যের সীমান্ত দিয়েই হোক না কেন।
এ বার বাংলাদেশে গোলমাল শুরু হওয়ার পরে এই রাজ্যের সীমান্ত এলাকার কয়েক জায়গায় ওপারের কিছু মানুষ ভিড় করেছিলেন। বিএসএফ সে সময় খুব কড়া নজর রেখেছিল। যদিও ওই ধরনের অনুপ্রবেশ অবৈধ হলেও যাঁরা স্ত্রী-সন্তান-ঘটিবাটি নিয়ে ‘নিরাপত্তা’র জন্য সীমান্ত পেরোতে আসেন, তাঁরা সচরাচর জঙ্গি হন না। তবে রাজনীতির কারবারিদের ‘সৌজন্য’-এ অনেকে সুযোগমতো ‘ভোটার’ হয়ে যান!
কিন্তু অন্য যে অনুপ্রবেশ, তার বিপদ ভয়ঙ্কর। সেখানে বাংলাদেশের ভারত-বিদ্বেষী কিছু গোষ্ঠী ও দল যেমন রয়েছে, তেমনই উৎসমুখে পাকিস্তান-পালিত সন্ত্রাসীদের ভূমিকাও ক্রমশ প্রকাশ্যে এসে পড়ছে। টের পাওয়া যাচ্ছে চক্রান্তের বিস্তার কত গভীরে। এদের সীমান্ত পেরোনো কিন্তু বিএসএফের ভূমিকার দিকেও আঙুল তোলে।
মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে জঙ্গি-যোগাযোগে অভিযুক্ত যে দু’জন ধরা পড়ল, তারা বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লা বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত। তাদের ধরতে এসেছিল অসম পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স। ওরাই তাদের নিয়ে গিয়েছে। ক্যানিং থেকে ধৃত লোকটির সন্ধান পেয়ে বাংলায় এসেছিল জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের এসটিএফ। সে পাক যোগসাজশের সংগঠন তারিক-ই-মুজ়াহিদিন’এর সদস্য বলে সন্দেহ, এবং এখন জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের হেফাজতে। দু’জায়গাতেই ধৃতেরা ‘বাসিন্দা’ হয়ে স্থানীয় এলাকায় ‘মিশে’ গিয়েছিল। মুর্শিদাবাদেরই ধৃত এক জন মাদ্রাসা খুলেছিল। আর এক জন ছিল কলের মিস্ত্রি। এই জেলার সমশেরগঞ্জ থেকে তিন ইরানি অনুপ্রবেশকারীর গ্রেফতারও উদ্বেগ অনেকটা বাড়িয়েছে। স্থানীয় থানা, তাদের ইনফর্মার, এলাকার রাজনৈতিক ‘দাদা’ থেকে সাধারণ মানুষ— কারও কি কখনও কোনও প্রশ্ন জাগেনি এদের অস্তিত্ব এবং অবস্থান নিয়ে? জানা-বোঝার চেষ্টাটুকুও থাকে কি? জাল নথি তৈরি তো প্রায় কুটিরশিল্প। এ ভাবে যারা এখানে ‘কাগজপত্র’ বানিয়ে দিব্যি ভোটার পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল, অসমের পুলিশ এসে ‘ঘুম’ না ভাঙালে তারা হয়তো বাংলায় বসে কোনও বড় নাশকতার ‘অপারেটর’ হত।
কলকাতার কেন্দ্রস্থল মার্কুইস স্ট্রিটের একটি ঠিকানা এবং রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের একটি হোটেল থেকে যে দু’জনকে ধরা হয়, তাদেরও এখানে ‘তৈরি হওয়া’ আধার কার্ড, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট ইত্যাদি অনেক কিছু সঠিক নয় বলে পুলিশের সন্দেহ। এখন নজর পড়েছে খিদিরপুর ও সংলগ্ন কিছু এলাকার উপরেও। দেখা হচ্ছে, সেখানে আপাতভাবে ‘সন্দেহজনক’ কারা আছে। এটা জানা কথা যে, জাল নথি তৈরি, ঘরের খোঁজ করা ইত্যাদি কাজে যেমন এক শ্রেণির তথাকথিত দালাল থাকে, তেমনই বিভিন্ন প্রভাবশালীকে ‘ব্যবহার’ করা হয়। বহু ক্ষেত্রে রাজনীতির লোকেরাও তার অংশ। বৃত্ত এ ভাবেই সম্পূর্ণ হয়।
বারাসত-মধ্যমগ্রাম অঞ্চলেও জাল নথি তৈরির চক্র কাজ করে বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। কিন্তু এত দিন কেন এ সব জানা যায়নি? স্থানীয় পুলিশ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীরা কি নিজেদের এলাকা সম্পর্কে সত্যিই অবহিত নন, না কি কোনও অলিখিত ‘বন্দোবস্ত’ এ সব জায়গায় সক্রিয়? যেটাই হোক, তা ক্ষমাহীন অপরাধ।
মুর্শিদাবাদে জঙ্গি-যোগে অভিযুক্ত দুই ধৃতের এক জন তো জেলার দুই বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার— হরিহরপাড়া ও নওদা! অবশ্যই ভুয়ো নথিপত্রে! কিন্তু সরকারের ও দলের কারা সরেজমিন ঘুরে তালিকা যাচাই করেন, কারা সংশোধনের কাজ করেন, কারা তদারকি করেন, সেটা তো গোপন কিছু নয়। তা সত্ত্বেও কেউ কিচ্ছু জানতে পারেননি? না কি জানতে চাননি? বিরোধীরাই বা ছিলেন কোথায়? জটায়ুর কথা ধার করে বললে, এ সবই ‘হাইলি সাসপিশাস’!
এই সূত্রেই এসে পড়ে ভুয়ো ভোটারের হিসাব। ভোটার তালিকার চলতি সংশোধনের সময় খসড়া তালিকায় রাজ্যে প্রায় ১৭ লক্ষ ভুয়ো ভোটারের সন্ধান মিলেছে বলে বিরোধীদের দাবি। হতে পারে, ‘প্রকৃত’ সংখ্যা হয়তো দশ বা আট বা ছয় লক্ষ। কিন্তু বোঝা দরকার, রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে কোথায় কী ভাবে নামগুলি ছড়িয়ে আছে। কারণ, তার উপরে যেমন দলগুলির ভোট-ভবিষ্যৎ খানিকটা নির্ভর করে, তেমনই আঁচ পাওয়া যেতে পারে এ সব জাল-জালিয়াতির চক্কর কোন ধরনের এলাকায় বেশি। যেমন, হাতের সামনে উদাহরণ মুর্শিদাবাদ। খড়ের গাদায় এ ভাবে আরও কত সুচ ঢুকে রয়েছে, বলা খুব দুষ্কর। শঙ্কার দুয়ারও তাই খোলা থেকেই যাচ্ছে।
ভুয়ো ভোটারের ভূত যে তালিকায় বাসা বেঁধেছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং সেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মৌচাকে ঢিল মেরে আঙুল তুলেছেন বুথ স্তরের অফিসার বা বিএলও-দের দিকে। মুখ্যমন্ত্রীর উষ্মা, বিএলও-রা সকলে ঠিক মতো কাজ করলে এ সব হতে পারে না।
সবাই জানি, এক সময় ভুয়ো ভোটারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলেন মমতা। তখন তিনি রাজ্যের বিরোধী নেত্রী। ভোটার কার্ড ছাড়া ভোট নয় বলে তাঁর প্রতিবাদে ধুন্ধুমার বেধেছিল। নীতিগত ভাবে সেই অবস্থান তাঁর আজও। অথচ তাঁরই রাজ্যে জঙ্গি-এজেন্টের পকেটে ভুয়ো ভোটার কার্ড বিপদের সূচক। কান্ডারির হুঁশিয়ার হওয়ার এটা চরম সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy