এরই মধ্যে ঠোঙা হয়ে গেল খবরটা?” আলুর চপ শেষ করে ঠোঙাটা পড়ছিল সূর্য। আনন্দবাজার-এর পাতা, তাতে মহম্মদ জ়ুবেরের গ্রেফতার হওয়ার খবর। “প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গিয়েছে তো,” চপের শেষ টুকরোটা মুখে পুরে উত্তর দেয় শিশির। “তবে বিজেপি কিন্তু ভয় পেয়েছে। কয়েকটা লোক প্রতি দিন আইটি সেলের রাশি রাশি মিথ্যা ধরছে, তার আড়ালে লুকিয়ে রাখা সত্যি কথাগুলো মানুষের সামনে আনছে— এই লড়াইটা ইতিহাসে লেখা থাকবে।”
কথাটা শেষ করেই শিশির তপেশকে চোখের ইশারায় দেখাল, শিবুদা নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে ক্রসওয়ার্ড পাজ়্ল করে চলেছেন। বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে ধরা সিগারেটের ডগায় প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা ছাই। “কিন্তু এক জন জ়ুবের বা এক জন প্রতীক সিংহকে দিয়ে হবে না, তাই না শিবুদা? বিজেপি যেমন আইটি সেল তৈরি করে মিথ্যা ছড়ায়, সত্যি কথাগুলো প্রচার করার জন্য তেমন একটা পাল্টা আইটি সেল চাই,” শিবুদার উদ্দেশে বলল তপেশ।
“আঠারোর উপর-নীচ, চার অক্ষর, নির্বোধ... হুঁ, আহাম্মক,” শব্দছকে শব্দটা লিখে কাগজটা টেবিলের উপরে রাখলেন শিবুদা। “তোকে আহাম্মক বলিনি, তবে বলাই যায়। জ়ুবেররা যে লড়াইটা লড়ছে, তা হাজার বার কুর্নিশযোগ্য। কিন্তু, পাল্টা আইটি সেল যদি তৈরিও হয়, সেটা সমান না হোক, অন্তত মোটামুটি সফল হবে— এই কথাটা বলার মতো কোনও প্রমাণ আজ অবধি নেই। বরং উল্টোটা আছে। ‘সাইবারসিকিয়োরিটি ফর ডেমোক্র্যাসি’ নামে একটা সংগঠন আছে আমেরিকায়, ওরা গত বছর একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজকে ওরা পাঁচ ভাগে ভেঙেছিল— অতি-দক্ষিণপন্থী, দক্ষিণপন্থী, মধ্যপন্থী, বামপন্থী এবং অতি-বামপন্থী। পাঁচ মাস ধরে আশি লক্ষ পোস্টের পরিসংখ্যান বিচার করে জানা গেল যে, অতি-দক্ষিণপন্থী পেজের ভুয়ো খবরে সবচেয়ে বেশি এনগেজমেন্ট হয়। পেজের প্রতি এক হাজার ফলোয়ারপিছু গড়ে ৪২৫ জন তেমন পোস্ট লাইক করেন, তাতে কমেন্ট করেন, শেয়ার করেন। যে অস্ত্রে তুই এর পাল্টা যুদ্ধ লড়ার কথা বলছিস, তার দৌড় শুনবি? মধ্যপন্থী পেজ থেকে যথাযথ তথ্য শেয়ার করলে প্রতি হাজার ফলোয়ারে এনগেজমেন্ট ৮০, বামপন্থী পেজে ১০০, অতি-বামপন্থী পেজে ১৪৫। সব যোগ করেও অতি-দক্ষিণপন্থী মিথ্যার ৭৫ শতাংশ। স্রেফ অঙ্কের হিসাবেই রোজ গোল খাবি।”
“এটার মধ্যে কিন্তু ফেসবুকের খেলা আছে, শিবুদা,” সূর্য বলে। “সোফি ঝ্যাংয়ের কথাগুলো ভাবুন— বিনা বাধায় অজস্র দক্ষিণপন্থী ফেক অ্যাকাউন্ট রাখতে দেয় ফেসবুক। সেগুলো এই সব পেজের এনগেজমেন্ট বাড়ায়। ফেসবুকের অ্যালগরিদম সেই পোস্টগুলোকে আরও ছড়িয়ে দেয়, এনগেজমেন্ট বেশি বলেই। এটা দিয়ে কি সাধারণ মানুষের মন মাপা যায়?”
উত্তর দিতে গিয়ে থমকালেন শিবুদা। একটা সিগারেট বার করে দেশলাইয়ের বাক্সের উপর ঠুকতে ঠুকতে বললেন, “গোলমালটা তো মানুষের মন নিয়েই রে। সব গবেষণা বলছে, সাধারণ লোকদের মনে অতি-দক্ষিণপন্থী ভুয়ো খবরের গ্রহণযোগ্যতা সত্য তথ্যের চেয়ে বেশি। দুঃখজনক, কিন্তু সত্যি। কেন বল দিকি?”
শিবুদার কথার মধ্যেই তপেশ ফোন ঘাঁটছিল। বলল, “এ তো দেখছি আইকিউ-এর গল্প। রিসার্চ বলছে, যাদের বুদ্ধ্যঙ্ক কম, তারাই অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট হয়।”
চায়ে একটা চুমুক দিয়ে সিগারেটটা ধরালেন শিবুদা। বললেন, “গর্ডন হাডসন আর মাইকেল বুসেরির কাজটা দেখলি? ওরা দীর্ঘ সময় ধরে কাজটা করেছিল। প্রথমে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আইকিউ বা বুদ্ধ্যঙ্ক মেপেছিল। তারাই যখন বড় হল, তখন তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুযায়ী সাজিয়ে দেখা গেল, যাদের বুদ্ধ্যঙ্ক কম ছিল, তাদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ রকম বেশি। অন্য কথায়, যারা দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, তাদের বুদ্ধ্যঙ্ক তুলনায় কম।”
“একটা স্টাডির ভরসায় এতটা দাবি করা কিন্তু বিপজ্জনক,” শিবুদার কথা শেষ হতে নিচু গলায় বলল সূর্য। তবে, কথাটা শিবুদার কানে গিয়েছে। বললেন, “যতটুকু দাবি করা যায়, তার বেশি করব না, এটুকু ভরসা করতে পারিস। হাডসন আর বুসেরির ২০১২ সালের স্টাডিটাই তো একমাত্র নয়। ২০১৮ সালে বেলজিয়মের ঘেন্ট ইউনিভার্সিটির ছ’জন গবেষক একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স আর দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসের প্রবণতা নিয়ে। তাঁরাও দেখিয়েছেন যে, ইমোশনাল কোশেন্ট— যাকে আবেগাঙ্ক বলতে পারিস— কম থাকলে দক্ষিণপন্থী হওয়ার সম্ভাবনা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাড়ে। বুদ্ধ্যঙ্কের কথাটা বোঝা তুলনায় সহজ— বুদ্ধ্যঙ্ক কম থাকলে সাধারণত লেখাপড়ার পরিমাণও কম, ফলে নিজের বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে চেনাজানা হয় না তেমন। কিন্তু, আবেগের সঙ্গে দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসী হওয়ার সম্পর্ক কোথায়?”
শিবুদা দম নেওয়ার জন্য থামলেন। গোপালকে ইশারায় বললেন আর এক কাপ চা দিতে। তার পর বললেন, “আবেগ বস্তুটা আমাদের আচরণের উপর হরেক প্রভাব ফেলে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। আবেগাঙ্ক যার যত কম, নিজের আবেগের উপরে নিয়ন্ত্রণও তার ততই কম। সে সহজে রেগে যায়, ভয় পায়, প্রতিশোধ নিতে তৈরি হয়ে যায়। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির তো এই রকম লোকই দরকার, মুসলমানরা সংখ্যায় বেড়ে হিন্দুদের সব অধিকার কেড়ে নেবে বললে যারা ভয় পেয়ে যাবে; বিশ্বাস করবে যে, হিন্দুদের ঘরের মেয়েদের ফুসলে নিয়ে যাওয়াই সব মুসলমানের উদ্দেশ্য।”
“অর্থাৎ, বোকা লোক দেখলেই সাবধান!” হালকা সুরে বলল শিশির।
“ইয়ার্কি মারছিস বটে, কিন্তু কথাটা অতখানি সহজ নয়,” শিবুদা শিশিরের কথাটা ধরে নিলেন। “মনস্তত্ত্ববিদরা মানুষের মাথাকে দুটো আলাদা প্রসেসে— প্রক্রিয়ায়— ভাগ করে দেখেন। বিভিন্ন গবেষক তার বিভিন্ন নাম দিয়েছেন। ড্যানিয়েল কানেম্যান ব্যবহার করেছেন কিথ স্টানোভিচ আর রিচার্ড ওয়েস্টের দেওয়া নাম, সিস্টেম ওয়ান আর সিস্টেম টু। সে ভাবেই বলি। সিস্টেম ওয়ান হল মগজের সেই সব কাজ, যা অতি দ্রুত হয়, যার জন্য আলাদা ভাবনাচিন্তা লাগে না। সিস্টেম টু সে সব কাজ করে, যার জন্য আলাদা করে মগজ খাটাতে হয়। সিস্টেম ওয়ান আমাদের বিবর্তনের সূত্রে পাওয়া ধন— যে ভয়, যে সতর্কতা, যে তৎপরতার জোরে প্রজাতি হিসেবে মানুষ বেঁচে থাকল, এগিয়ে গেল ক্রমশ, সেগুলো সিস্টেম ওয়ান দিয়েই পরিচালিত হয়। দূরে ঘাসের ভিতর হালকা নড়াচড়া দেখে হিংস্র প্রাণীর অস্তিত্ব টের পেলে কিংকর্তব্য, তা যদি আলাদা করে ভাবতে হত, সিস্টেম টু ব্যবহার করতে হত, বাঘের পেটে যাওয়াই ভবিতব্য হত!
“এ বার দেখ, অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতি যে কথাগুলো প্রচার করে, সেগুলো সিস্টেম ওয়ানের খাপে খাপে বসে যায়। সেই প্রচারের কেন্দ্রে রয়েছে ভয়— ‘অপর’, অর্থাৎ অজানার ভয়— মেরে ফেলবে, সম্পত্তি দখল করে নেবে, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবে। ভয় আমাদের আদিমতম প্রবৃত্তিগুলোর একটা, ফলে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সিস্টেম ওয়ান থেকেই হয়— কোনও ভাবনাচিন্তা ছাড়াই, ভয়টাকে সত্যি ভেবে নিয়ে। এর উল্টো দিকের কথাগুলো সবই যুক্তির কথা। অর্থাৎ, কেউ যদি বলে যে, মুসলমানরা গন্ডা গন্ডা বাচ্চার জন্ম দিয়ে দেশটাকে দখল করে নিতে চাইছে, তার উত্তরে ফার্টিলিটি রেটের হিসাব দেওয়া, দেখানো যে, ভারতের সব জনগোষ্ঠীর মতো মুসলমানদের ক্ষেত্রেও জন্মহার ক্রমশই কমছে। এই কথাগুলোর আবেদন সিস্টেম টু’র কাছে।
“এ দিকে, সিস্টেম টু এমনিতেই অলস। ভাবতে রীতিমতো পরিশ্রম হয়, ফলে সিস্টেম টু-র উপর বেশি কাজের চাপ পড়লে সে জবাব দিয়ে দেয়। সিস্টেম টু-র ক্ষমতার সীমা আছে। সেই সীমা পার করলেই যা হয়, তার নাম ইগো ডিপ্লিশন— ইচ্ছাশক্তির ক্ষয়। তখন আর সিস্টেম টু কাজ করে না। গবেষকরা দেখিয়েছেন, ইগো ডিপ্লিশন হলেই কমতে থাকে মানুষের বুদ্ধ্যঙ্ক।
“মারাত্মক ইগো ডিপ্লিশন কিসে হয়, জানিস? প্রতি মুহূর্তে অভাবের সঙ্গে লড়তে হলে। কেন, সেটা নাহয় অন্য কোনও দিন বলব। কিন্তু, অভাবে ইগো ডিপ্লিশন হয়, তাতে এক দিকে বুদ্ধ্যঙ্ক কমে— এতখানিই কমে যে, এক জন সাধারণ বুদ্ধির মানুষ নেমে আসতে পারেন বর্ডারলাইন মেন্টাল রিটার্ডেশনের বুদ্ধ্যঙ্কের স্তরে— আর অন্য দিকে আমাদের মাথার দখল নেয় সিস্টেম ওয়ান। এই রকম লোককেই তো দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চাই, ভয় দেখালেই যারা প্রবল ভয় পেয়ে যায়।
“কয়েক দিন আগে কৌশিক বসুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, বুঝলি। কৌশিকদা বলছিলেন, দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির হাতে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছে যারা, তারাই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমর্থক। কেন জানিস? কারণ, তাদের আর্থিক বিপন্নতা সব সময় তাদের বুদ্ধ্যঙ্ককে চেপে রাখে, আর ফাঁক গলে ঢোকে আদিম রিপুর রাজনীতি।
“পাল্টা আইটি সেল খুলে এই লড়াই জেতা যাবে না রে। জেতার একমাত্র উপায়, সবার উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে পারে যে রাজনীতি, তার কথা বলা— যত ক্ষণ না সবার জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো মেটে, সেই রাজনীতিকে জিরোতে না দেওয়া।” একটানা কথা বলে শিবুদা থামেন।
পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন এখনও গেল না লোকটার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy